আশরাফ বিন আহমেদ: হারিয়ে যাওয়া এক অনন্য ব্যক্তিত্ব

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ১১ ২০২১, ১৪:৩৮

হুসাইন আল আমীন: মৃত্যু মানব জীবনের এক অনিবার্য সত্য। কেউই মরণের ভয়াবহ সাক্ষাতকে অস্বীকার করতে পারবে না। সবাইকে তার নাগাল পেতেই হবে। চাই সে বাঁচার জন্য যতই উপকরণ অর্জন করুক না কেন মৃত্যু তাকে পাকড়াও করবেই। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন- প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতেই হবে।

মৃত্যু যুবক-বৃদ্ধ কাউকে চিনে না। সে আলিম-জাহিল কারোর‌ই তাবেদার নয়। নেককার-পাপী কার‌ও প্রতি দয়া করে না। তার সময়ের ঘন্টাধ্বনি বাজলেই তৎক্ষণাৎ কোনো বাধা ছাড়াই চলে আসে। আল্লাহ ব্যতিত কারও সাধ্য নেই তাকে রুখে দাঁড়াবার। তাকে আগলে রাখার জন্য কোনো পরাশক্তি এই দুনিয়াতে সৃষ্টি হয়নি আর কখনো হবেও না। সবার সাথে তার সাক্ষাৎ অনিবার্য। তার থেকে পালাবার জন্য কেউ যদি পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন গুহায়ও আশ্রয় নেয় সেখানেও তার খেদমতে হাজির হতে তার কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। এর নামই মৃত্যু।

এই মৃত্যুর কাছে হার মেনে নেয়া আমার এক সহপাঠী, বন্ধুবর আশরাফ বিন আহমেদ। এই তো কিছুদিন আগে সে ইহকাল ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি জমায়। প্রায় বাইশ বছরের তরুণ নওজোয়ান সে। এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে কস্মিনকালেও ভাবিনি।

মাত্র কয়েকদিন আগে আমরা একসাথে শিক্ষা সফরে গেলাম। যাত্রাপথে একসাথে ইসলামি সঙ্গীত পরিবেশন, গল্পসল্প, হাসিঠাট্টা কতই না মজা করেছিলাম আমরা। সেই দিনটিকে তুমি আমাদের জন্য একটি উপহার হিসেবে রেখে গেলে ভাই। সেইদিন তুমি, আমি আর খুবাইব ভাই দুপুরের খাবার প্রস্তুতি করেছিলাম। শিক্ষার্থী শিক্ষক এবং অভিভাবকসহ সবাইকে আমরা তিনজন খাবার পরিবেশন করেছিলাম। কিন্তু তখনও আমরা তিনজন খাইনি। সবাইকে যার যা প্রয়োজন তা তাদের প্লেটে তুলে দিয়েছিলাম। তারা সবাই আনন্দ করে খেয়েছিল। অবশেষে সবার খাবার শেষ হল। রয়ে গেলাম আমরা তিনজন। খাবারে হাল্কা শর্ট ছিল আর এমন হওয়াটাই স্বভাবিক। কিন্তু আমাদের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমরা যে সবাইকে এভাবে আনন্দ দিতে পেরেছি এটাই আমাদের জন্য অনেক উপভোগের বিষয় ছিল।

যাইহোক, খাবার স্বল্প থাকায় আমরা তিনজন এক প্লেটে আল্লাহর নাম নিয়ে বসে পড়লাম কিন্তু আল্লাহর বরকত থাকায় আমাদের খাওয়া শেষে অনেক পরিমান খাবার অবশিষ্ট ছিল। এই দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে। তখন আমরা স্মৃতি হিসেবে একটি ফটো তুলে রেখেছিলাম। সবাই তখন আমাদের খাওয়া উপভোগ করেছিল আর আমরা তো করেছিই।

সেই মুহুর্তগুলো কতইনা সুন্দর ছিল! তখন কি জানতাম এটিই তোমার সাথে শেষ খাবার! এটিই শেষ কথা! এটিই হবে আমাদের শেষ দেখা! হায় যদি জানতাম তুমি এভাবে চলে যাবে তাহলে তোমার সাথে কথা বলা শেষই করতাম না। তোমার হাতটা আমরা শক্ত করে ধরে রাখতাম, যেতেই দিতাম না। কেন তুমি এভাবে চলে গেলে?

তোমার না অনেক স্বপ্ন ছিল! নিজেকে নিয়ে! ফ্যামিলিকে নিয়ে! এখন কি এই স্বপ্নগুলো পূরণ হবে! কিভাবে হবে! এগুলোর বাস্তব রূপ দেয়া তো তোমার কাজ ছিল! কিন্তু তুমি যে চলে গেলে, না ফেরার দেশে! আর ফিরে আসবে না কখনো! কিভাবে এগুলো বাস্তবায়ন হবে! তোমার স্বপ্নে তো এখন আর তোমার মায়ের মুখ ভরা হাসির ঢেউ ভেসে উঠবে না! তোমার স্বপ্নে তো আর তোমার ভাই বোনের চিত্র অঙ্কিত হবে না!

তুমি তো তাদের অনেক বড় সম্বল ছিলে! তাদের দেখাশোনা, তাদের আদর যত্ন তো তুমিই করতে! এখন কে তাদের ছায়া দেবে! কে তাদের মনের যাতনা দূর করার সান্ত্বনা দিবে! তাদের কথা কি একবারও ভাবলে না যে তুমি যাওয়ার পর তাদের অবস্থা কেমন হবে! কে তাদের এই জীবনের অভিভাবক হবে! তোমার বাবা তো তোমার আগেই চলে গেছেন আর এখন তুমি! একের পর এক আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা কি এই মানুষগুলোর আছে! কিভাবে পারলে তুমি!

তোমার ছোট বোন তাহিয়ার কথা কি একবারও ভাবলে না! সে যে এখনো অনেক ছোট! ক্লাস ফাইভে পড়ে মাত্র। সে আর কাকে ভাইয়া বলে ডাকবে! সে তো প্রতিদিন তোমার পথ চেয়ে বসে থাকত, কখন তুমি আসবে আর তার হাতে কয়েকটা চকলেট ধরিয়ে দিবে! তোমার হাত ধরে প্রতিদিন সে মাদ্রাসার বারান্দায় পা রাখত। ক্লাস শেষে মাদ্রাসার কেন্টিনে নিয়ে যেতে তুমি। তার ইচ্ছে মত বিভিন্ন কিছু কিনে দিতে। রিকশায় তোমার পাশে বসে সে বাসায় ফিরত। তার তো হরেক রকম বায়না ছিল। পরীক্ষার পর তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। ভালো রেজাল্ট হলে দামী কোনো রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিবে। তাকে তার চাহিদানুযায়ী কোনো বিলাসী ড্রেস কিনে দিবে। এরকম আরও কতকিছু। কিন্তু হায়! ছোট্ট বোনটির সব পরিকল্পনা তুমি ভেস্তে দিলে ভাই! এখন কে তার এই সব আবদার পুরা করবে! কে তার মাথায় স্নেহের পরশ বুলাবে! তোমার মায়া মমতা তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে তোমার মৃত্যুর সংবাদ তার কাছে দুঃস্বপ্নের ন্যায় মনে হল, বারবার সে চোখ ডলছিল যেন তা দুঃস্বপ্নই রয়ে যায় কিন্তু তা যে বাস্তব সেটা তার বুঝতে আর বাকি রইলো না। অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়লো অবুঝ বোনটি। সে বুঝতে পারছিল তার আদরের ভাইটা এই দুনিয়ায় আর নেই। আর ফিরে আসবে না তার কাছে। এইসব ভেবে সে নিজেকে আর কন্ট্রোলই করতে পারছিল না।

বোন নাজিয়া, সে এখন অনেক বড়। ইতিমধ্যে সে ইন্টারমিডিয়েট সমাপ্ত করেছে। বাবা চলে যাবার পর তুমিই ছিলে তার একমাত্র আশ্রয়। তোমরা দুজন একইসাথে বেড়ে উঠেছ, যদিও সে তোমার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট। বড় ভাই হিসেবে তুমি ছিলে তার সকল বিষয়ে যত্নশীল। তুমি ভাই হয়েও বাবার অভাব তাকে বুঝতে দাও নি। তুমি থাকা অবস্থায় সে বাবার কমতি অনুভব করার সুযোগটাও পায় নি। সবসময় তার পাশে থেকে তাকে সমর্থন করেছ। তার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছ।

তোমরা দুজন শুধু ভাইবোনই ছিলে না। ছিলে দুই বন্ধু। একে অপরের সাথে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করা, নিজেদের সব সমস্যা পরস্পর মিলে সমাধান করা, এগুলো তো তোমাদের নিত্যদিনের কাজ ছিল। বন্ধু হিসাবে তুমি ছিলে তার দুঃসময়ের সাথি আর সে ছিলো তোমার অভীষ্টসিদ্ধির প্রেরণাদাতা।

তোমাকে নিয়ে তার কত আশা ভরসা ছিল। তোমার হাত ধরে সে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন ছুঁতে চেয়েছিল, কারণ তার স্বপ্নের মানচিত্রে তুমি ছিলে তার পথপ্রদর্শক। বোন হিসাবে তোমার মত ভাইয়ের থেকে সে এমনটাই আশা করে থাকে। কিন্তু যখন তার স্বপ্নগুলো মুক্ত হাওয়ায় ডানা মেলতে শুরু করল তখনই তোমার চলে যাওয়ার সময় হল! আর একটু সময় অপেক্ষা করতে পারলে না! বোনটিকে তুমি এভাবে একা ফেলে গেলে! এখন তার কি হবে! তার সুখ দুঃখের সাথী ছিলে তুমি, তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে তো তুমি ভবঘুরে হয়ে যেতে, সবসময় একটা বিষন্নতার ছোঁয়া থাকতো তোমার চেহারায়, তাহলে কেন আরেকটু ধৈর্য ধরলে না ভাই? কেন এভাবে নিজেকে তিলেতিলে শেষ করে দিলে?

আহসানের কথা কি বলব। তোমার ছোট ভাই সে। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। এই সময়ে তার একজন বন্ধুসূলভ অভিভাবক খুব প্রয়োজন ছিল। তুমিই সেই স্থান পূরণ করতে পারতে। বড় ভাই হিসাবে তোমাকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতো। তোমার দেয়া দিকনির্দেশনা সে অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পালন করত। তোমাকে সে মডেল হিসাবে নিজের মধ্যে চরিতার্থ করত। সবসময় তোমাকে, তোমার চলাফিরা, ভাবভঙ্গি তোমার সব বিষয়ে ফলো করতো।

তোমার মায়ের কথা কি বলবো! মা তো মা! মায়েদের ভাবাবেগের বিবৃতি দেয়ার মতো যোগ্যতা কারো আছে বলে জানা নেই রে ভাই। হয়তো মা তোমার বেডের এক কোণে শুয়ে বালিশে কান্না চাপা দিচ্ছেন। না হয় তোমার পরা পাঞ্জাবীর ঘ্রাণ অনুভব করছেন। আর না হয় ছেলে হারানোর ব্যথায় তার ব্যথাতুর হৃদয় খানখান হয়ে যাচ্ছে। ছোট বেলার সেই আশরাফকে ভাবতে ভাবতে কখন জানি মায়ের অশ্রুসজল আঁখিদ্বয় নিথর হয়ে যাচ্ছে কে জানে! আল্লাহ তায়ালা তোমার মাকে সবরে জামিল দান করুন।

বাবা হারা একটি পরিবারের বড় ছেলে হয়ে অপ্রাপ্তির বেদনা সহ্য করতে না পারা তুমি এভাবে চলে যাবে কেউ কখনো ভাবেনি। আল্লাহ তায়ালা তোমায় অনেক সুখে রাখুন। তোমার সকল ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদৌসের অধিকারী করুন। আল্লাহুম্মা আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।

(এই লেখাটা গত বছরের। প্রিয় আশরাফ ভাই চলে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর লেখা। কি একটি কারণে লেখাটি পাবলিশ করা হয়নি। আজ লেখাটি সামনে পেয়ে পাবলিশ করলাম। লেখাটা পড়ে আমাদের আশরাফ ভাইকে সবার পুনরায় মনে পড়বে আর সবাই তার জন্য দোয়া করবেন, এই আশায় লেখাটি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করলাম। আল্লাহ তায়ালা আশরাফ ভাইকে কবরের জগতে সুখে শান্তিতে রাখুন। আমীন।)