জগলুল হায়দারের ঐতিহাসিক ছড়া শিকড়

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ১৮ ২০২০, ১৪:২৭

[এইবারের বিজয় দিবসে ২০০৬ সালে প্রকাশিত আমার ১ ছড়ার (৫শতাধিক লাইনের) বই ‘স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস’ নিয়া একটা বয়ান দেই। বইটা থিকা কিছু অংশ শেয়ার করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বইয়ের কুনো কপি না থাকায় তা সম্ভব হয় নাই। কিন্তু এতে অন্য একটা কাজ হইছে। এই দেশ আর জাতির কোর আইডেন্টিটি বা মূল পরিচয় সন্ধানে গত দুইদিনে (মূলত বিজয় দিবসেই) ইতিহাস যাত্রার আরেকটা ছড়া হইছে আমার। সিংগেল কলামে ইতিমধ্যে ৪শ লাইন লেইখা ফেলছি। কিন্তু ফেসবুকে ‘লম্বা পোস্টের ভাত নাই’ বিধায় ছড়াটাকে ডিসিতে (ডাবল কলামে) পোস্ট দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই, এতে ছড়ার দৈর্ঘ অর্ধেক কইমা ২শ লাইনে দাঁড়াইছে। কিন্তু ২শ লাইনও ফেসবুকের এক পোস্টের জন্য ঢের বড়। তাই ছড়াটাকে কয়েক পর্বে শেয়ার করতে যাইতেছি। আজ এর প্রথম পর্ব। ছড়াটায় আপনার মনোযোগ আশা করতেছি। কারণ বাঙাল/বাঙালি/বাঙালি মুসলমান কিম্বা বাংলাদেশিদের জাতিগত যে আত্মপরিচয় সংকট সেই সংকটের একটা ইতিহাস সম্মত সমাধানেই আমার এই ছড়া প্রয়াস। ধন্যবাদ।]

শিকড়

জগলুল হায়দার

এই মায়াময় দেশটা বলেন আমরা পেলাম কি করে?
জানতে সেটা ঢুকতে হবে ইতিহাসের শিকড়ে।
এই ইতিহাস সত্য এসব মন্দ কিম্বা বুড়া না
গাঙ্গেয় এই বদ্বীপ ছিল অনেক কালের পুরানা।

গুপ্ত শাসন বাদে কিছু মাৎস্যন্যায়ের কারবারে
শাসনবিহীন এই বদ্বীপে বলবানের ঘাড় বাড়ে।
মটকে দিতে তার অবিচার শশাঙ্ক নেয় ক্ষমতা
বেশি না হোক যা করেছে নয় এতোটুক কমও তা।

তার পরে তো শাসন কাজে আসলো ছুটে পালেরা
বহু যুগের পরিক্রমায় হারায় শেষে তাল এরা।
সেই সুযোগে ডেকান থেকে ব্রাহ্মণরূপ সেনেরা
বললো এসে বাংলাজুড়ে দে ক্ষমতায় দে নাড়া।

সেই নাড়াতে ব্রাহ্মণবাদ তুললো মাথা এদেশে
কোথায় গেলো ভিক্ষু নেড়ে? ঘুরলো পথে কেঁদে সে।
সেই শাসনের টনক নড়ে সতরো ঘোড়ার খুরেতে
বখতিয়ারের নুতুন বীণায় পালটে গেলো সুর এতে।

পালিয়ে গেলো সেনের সেনা সয়ং রাজা লক্ষণে
নিপীড়িত মানুষ বলে এই নাজাতের পক্ষ নে।
পক্ষ নেয়ায় দেশটা দ্রুত সাজলো সবুজ নিশানে
ক্লান্ত নেড়ে গলা ছেড়ে বললো- শান্তি দিশা নে।

বখতিয়ারের আগেই এসে যে পথ দ্যাখায় সুফিরা
মাসি পিসী পালটে তাতেই করলো খালা ফুপি রা।
এর পরে সেই সাম্য ছায়ায় আসলো শাসন সুলতানি
পড় ইতিহাস জানতে পাবি, নয় তো এসব ভুল তানি।

২.

মধ্যিখানে বারোভুঁইয়া, নবাব এলো পরে তো
তারই মাঝে বর্গী এসে ফেলছে লোকের ধড় এতো।
স্বাধীন নবাব বিহিত করে বর্গী তবু ভাগালো
তাই তো সিরাজ বললো এবার দেশের চোখে লাগ আলো।

কিন্তু সেটা নিভিয়ে দিতে উতল ইঙ্গ বেনিয়া
কলোনি চায়, লাগলো লড়াই তাই তো শেষে এ নিয়া।
আসলো শেষে সোনার দেশে প্রহসনের পলাশী
একশ সেনার মধ্যে করে পুতুল সেজে ছল আশি।

সেই আশিতে জগৎশেঠ আর উমিচাঁদের টাকাতে
পুতুল জাফর রায় দুর্লভ সুরুত করে বাঁ কাতে।
মীর মদন ও মোহনলালের ত্যাগ হলো তাই জলো তো
জাফর-শেঠের গাদ্দারিতেই আজাদি যায় ফলতঃ।

সেই আজাদি ফেরত পেতে লড়লো কতো ফকিরে
কলোনি রুল নেয়নি মেনে, তাদের আবার বো কিরে?
বো করেনি আলেমরা কেউ হয়নি নত তাহারা
কেউ দিয়ছে ঘাড় পেতে আর কেউ হলো হাত পা হারা।

সেই লড়াইয়ে সন্যাসিরাও যোগ দিয়েছে পরে তো
রব উঠেছে কলোনিকে কেউ দেবে না কর এতো।
শরীয়তুল্লাহ দুদু মিয়া বুক চিতানো ফরাজি
লড়ছে তিতু, বলছে সাহেব গোলামিতে হ রাজি।

হয়নি রাজি, লড়ছে যেমন ফকির মজনু শাহা রে
লড়ছে তারাও গ্রাম-গঞ্জ আর বন বনানী পাহাড়ে।
মহিসুরে টিপু গেছে আর সিপাহীর সংগ্রামে
ব্রিটিশ দালাল সাজছে কিছু ভুল রহিম আর রং রামে।

পলাশীর যুদ্ধ

 

 

 

 

 

৩.

দিল্লি দখল করে নুতুন চাল চেলে দেয় কোম্পানি
হিন্ধুকে দেয় দুইহাতে জল মুসলিমকে কম পানি।
ডিভাইড এন্ড রুলের খেলায় শাসন চলে শান্তিতে
হিন্দু কিছু মজা পেলেও মুসলিম সব পান তিতে।

হিন্দু মিডেলক্লাস ভারতে উঠলো ফুলে ফেঁপে তো
মুসলমানের আঁধার কালে তারাই আলোর রে পেতো।
ম্যাকলে সাবের ‘কালা সাহেব’ হিন্দু হলো বেশি তো
মুসলমানের শীতনিদ্রা- লম্বা হলো সে শীতও।

স্যার সৈয়দের আওয়াজ উঠে তাই মুসলিম মুক্তিতে
এসব দেখে কারো আবার হয় অহেতুক মুখ তিতে।
তিতা মুখে লাগাম দিতে সলিমুল্লাহ লতিফে
জাতির জন্য করতে নামে নিজের গাঁটের ক্ষতি পে।

বঙ্গদেশেও সওয়াল উঠে, চাও মুসলিম ভালো কে?
চাইলে পরে এই জাতিকে আনতে হবে আলোকে।
জাতির আওয়াজ ব্রিটিশ কানে পৌঁছে দিলে নবাবে
বাবুরা দেয় প্রতিক্রিয়া চাঁছাছোলা র ভাবে।

পূর্ববাংলা আসাম নিয়া নবাব তবু আঁক আঁকে
ম্যাপ হয়ে যায়, রাজধানীও করতে হবে ঢাকাকে।
সেখান থেকে ম্যাপের শুরু লালসবুজের ঠিকানা
এই বাংলা বাঘের বাংলা এইটা বিড়াল চিকা না।

নুতুন প্রদেশ- নুতুন স্বদেশ এবং নুতুন ভার্সিটি?
মুসলমানের কি আনন্দ- ঢাকা হবে তার সিটি!
সেই আনন্দ তোলা আছে ইতিহাসের রেহালে
এই মাটি এই ম্যাপ পেয়েছি লড়াই করে এ হালে।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ তথা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়। সেই যুদ্ধে অংশ নেয়ার অপরাধে কলোনিয়াল ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক জীবন্ত কামানের মুখে বাঁইধা অগণিত আলেমকে হত্যা (শহিদ) করার দৃশ্য।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ তথা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়। সেই যুদ্ধে অংশ নেয়ার অপরাধে কলোনিয়াল ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক জীবন্ত কামানের মুখে বাঁইধা অগণিত আলেমকে হত্যা (শহিদ) করার দৃশ্য।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

৪.

কিন্তু সে ম্যাপ মুছলো আবার বর্ণ হিন্দুর খ্যাপামি
স্বপ্নাহত মুসলিম কয় মারবো কতো ক্ষ্যাপ আমি!
কলকাতাতে বাবুরা সব হুলস্থুলের ধান্দাতে
প্রদেশ রদের যজ্ঞে চাবায় আয়েশ করে পান দাঁতে।

বাজলো কঠিন আন্দলোনে জিঙ্গোজিমের নাকাড়া
‘মুচুরমানের’ প্রদেশ আবার! বাবুর মুখে বাঁকা রা।
রবি ঠাকুর গান বানালেন বঙ্গ মাতার বন্দনা
হিন্দু ভজে মায়ের চরণ, ব্রিটিশ ভাবে মন্দ না!

শঙ্কা বাড়ে ময়মনসিংহ শিলং ঢাকা সিলেটে
হিন্দুরা চায় নগদ হুকুম, হুকুম এলো কী লেটে?
লেট হলো না ছয় বছরেই বঙ্গভঙ্গ ফুরালো
‘আমার সোনার বাংলা’ বলে হিন্দু ঢালে সুর আলো।

সেই সুরে সেই ম্যাপ গিয়েছে স্বাধীনতার সীমানা
উষ্ণতাকে হারিয়ে ক্ষ্যাপে আবার তো সেই হিম আনা।
হিন্দু মিডেলক্লাসের পথে কগ্রেসের অই হালতে
মুসলিমরাও লীগ বানালো পালটে দিতে ভাল ওতে।

লখনৌর প্যাক্ট ভেঙে যাওয়ায় মুসলমানের হাহাকার
প্রশ্ন জাগে মনে তাদের- ভারত তুমি আহা কার?
যদিও সবাই প্রতিবাদি খিলাফতের বিনাশে
নামলো পথে,আবার বুঝি সেই মিলনের দিন আসে?

কামাল আগায় সঙ্গে নিয়ে তরুণ তুর্কি পা সেনা
খিলাফতের সমাপ্তিতে সেই সেদিন আর আসে না।
গান্ধী আলীভাইয়ের তবু চেষ্টা ছিলো মিছিলে
ঐক্য তুমি- ঐক্য জানো, সেই বিভেদে কি ছিলে?

(চলবো)

ঐতিহাসিক খিলাফত আন্দোলনের দুই নেতা মাওলানা আলী ভ্রাতৃদ্বয় এবং সেই আন্দোলনে সামিল ও পরে যুগপৎ অসহযোগ আন্দোলন আহ্বানকারী গান্ধীজী।