আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রাহ. ইলমে হাদিসের এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ০৫ ২০২০, ২১:৩৭

ইলিয়াস মশহুদ
মাওতুল আলিমে মাওতুল আলমে। ওহে পৃথিবী! তুমি কি জানো না- তুমি মৃত? তোমার মৃত্যু হয়ে গেছে! ওহে প্রাণহীন নশ্বর ভূমি? তোমাতে এই আমি থেকে আর কী লাভ? তুমি না মৃত!
ঝরে পড়লো একটি নক্ষত্র। ইলমে হাদিসের উজ্জল এক তারকা। একজন অভিভাবক। হারিয়ে ফেলেছি লেখার ভাষা। আমি আজ অভিভাবকহারা। আমি হতবাক। আমি নির্বাক।
তিনি চলে গেলেন। না ফেরার দেশে। হাসতে হাসতে। তিনি হাসলেন আর কাঁদলো জগৎবাসী। অঝোর ধারায় কেঁদে উঠল আকাশ-ভুমি। আআ আকাশ এভাবে কেঁদে উঠবে, এর পূর্বাভাস ছিল না। কিন্তু কাঁদল, কাঁদল একই সঙ্গে বাংলাদেশের উপরে ছাদ হয়ে থাকা পুরো আকাশ। কাঁদল অজস্র মানুষ। কারণ, তিনি ছিলেন একাধারে একজন খ্যাতিমান হাক্কানি আলেম, ছিলেন শায়খুল হাদিস। ছিলেন একজন আপাদমস্তক আবেদ। ছিলেন মুত্তাকি।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন আকাবির আসলাফের অন্যতম প্রতিচ্ছবি।
তিনি এখন আমাদের মাঝে বেঁচে নেই। বেঁচে আছে বর্ণাঢ্য জীবনেতিহাস। আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর কর্মময় আল্লাহওয়ালা জীবনের সোনালী অধ্যায়। আজ এর সব কিছুই শুধু স্মৃতি। স্মৃতি আর স্মৃতি। তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের ছাপ, মহব্বতের অনুপম লক্ষণ। আজীবন খেদমত করে গেছেন দ্বীনের তরে। হাজারো তালেবকে ঝপিয়েছেন ওয়াবিহী কালা হাদ্দাছানা…। তাঁর এসব মহান কীর্তি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- তিনি মরেও অমর। তিনি দুনিয়াতে বেঁচে নেই, কিন্তু বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে।
মানুষ মরণশীল। সবাইকে মরতেই হবে একদিন। এ আল্লাহর চিরবিধান। মরা লাগবেই। জোর করে কেউ এ ধরায় চিরকাল থাকতে পারবে না। আজরাঈল আ.’র থাবা থেকে কেউ রেহাই পাবে না। নির্ধারিত সময়ে তাঁর কাছে ধরা দিতেই হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই। পালানোরও পথ নেই। কারণ, মৃত্যু অবধারিত এক বিষয়। তবে কেউ মরবে আগে, কেউ পরে।
জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদিস, দেশের অন্যতম আলেমে দ্বীন ও বুজুর্গ, শায়খুস তাফসির হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রাহ.। তিনি হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র অন্যতম খলিফাও।
বিশ্বব্যাপী রয়েছে শায়খুল হাদিস হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী দা.বা.’র খ্যাতি। প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টির এক জীবন্ত মহীরোহ তিনি। সামগ্রিক ব্যক্তিত্ব ও ব্যাপকতায় তিনি সমকালে এক বিরল দৃষ্টান্ত। সুলুক ও এহসানের এক অতুলনীয় রাহবার।
শায়খুল হাদিস হযরত মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী দা.বা. ১৩৫৯ হিজরি মোতাবেক ১৯৩৮ সালে হবিগঞ্জের কাঠাখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শায়খ আব্দুন নূর রাহ. (মৃত্যু ১ আগস্ট ১৯৯৯ সাল), মাতা মরহুম শামসুন নেসা রাহ.। তাঁর নানা হযরত মাওলানা আসাদুল্লাহ রাহ. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম সারির এক মুজাহিদ ছিলেন।
পিতা-মাতার কাছেই শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ.’র পড়াশোনার হাতেখড়ি। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন তাঁর পিতার কাছে, কাটাখালী মাদরাসায়। এটি তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা। এরপর তিনি হবিগঞ্জের অদূরে রায়ধর গ্রামে ‘জামেয়া সাদিয়ায়’ ভর্তি হন। সেখানে তিনি তাঁর মামা হযরত মাওলানা মুখলিসুর রাহমান রাহ.’র কাছে আরবিব্যাকরণ ও আরবিভাষা রপ্ত করেন। তাঁর মামা ছিলেন শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রাহ.’র ছাত্র। প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে তিনি জামিয়া আহলিয়্যা মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে চলে যান। সেখানে ফিক্হ, উসূলে ফিক্হ, তাফসির, উসূলে তাফসির, হাদিস, উসূলে হাদিস, মানতিক-ফালসাফাসহ ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শাখার জ্ঞান অর্জন করেন। এখানে তিনি মুফতি ফায়যুল্লাহ রাহ.’র বিশেষ সান্নিধ্য লাভে ধন্য হন। তিনি হাটহাজারী মাদরাসা থেকে ১৯৬০-৬১ সালে ‘দাওরায়ে হাদিস’ সম্পন্ন করেন।
দাওরায়ে হাদিস শেষ করে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে ‘জামেয়া আশরাফিয়া লাহোর’ এ দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদিসে ভর্তি হন। সেটা ১৯৬১-৬২ সালের কথা। এরপর তিনি কানপুর চলে যান। সেখানে হাফিযুল হাদিস আব্দুল্লাহ দরখাস্তি রাহ. (মৃত্যু : ১৪১৫ হিজরি)’র কাছে তাফসিরের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করেন। এরপর ‘জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া করাচি’ মাদরাসায় শায়খুল হাদিস ইউসূফ বাননূরী রাহ.-’র সান্নিধ্যে যান। সেখানে তাঁর কাছে তিনি তিনটি কিতাবের বিশেষ দারস গ্রহণ করেন। সেগুলো হচ্ছে, সাহিহুল বুখারি, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ও তাফসিরুল কুরআন।
পাকিস্তান থেকে তিনি ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দে পাড়ি জমান। ভারত-পাকিস্তান ভাগের জেরে দারুল উলূম দেওবন্দে তখন পাকিস্তানি ছাত্র ভর্তি বন্ধ ছিলো। শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী দা.বা. দেওবন্দে যখন পৌঁছেছেন, তখন ভতির্র সময়ও শেষ। এই দুই কারণে তিনি নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে পারেননি। তবে তৎকালীন মুহতামিম ক্বারি তায়্যিব রাহ.’র অনুমতিতে দারুল উলুম দেওবন্দে ‘খুসূসি দারস’ (বিশেষ পাঠ্য) গ্রহণ করেন। ওইসময় তিনি জামে তিরমিযি পড়েন শায়খ ইবরাহিম বলিয়াভি রাহ.’র কাছে। তাফসিরে বায়যাবি পড়েন হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান রাহ.’র কাছে। হযরত মাওলানা ক্বারি তায়্যিব রাহ.’র কাছ থেকে নেন হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার খুসূসি দারসও।
সহিহ বুখারির সাথে শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ.’র এক নিবিড় সর্ম্পক গড়ে উঠে। তিনি এ কিতাবটি পাঁচজন শায়খুল হাদিসের কাছে পড়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে বুখারির দারস প্রদানের অনুমতিও পেয়েছেন।
প্রথমবার পূর্ণরূপে পড়েছেন হাটহাজারী মাদরাসায় শায়খ আব্দুল কাইয়্যূম রাহ.’র কাছে। দ্বিতীয়বার পড়েছেন মুফতিয়ে আযম শায়খ ফায়যুল্লাহ রাহ.’র বাড়িতে। তৃতীয়বার পড়েছেন লাহোরে মাওলানা শায়খ ইদরিস কান্ধলভি রাহ.’র কাছে। চতুর্থবার পড়েছেন শায়খ ইউসুফ বানুরি রাহ.’র কাছে। পঞ্চমবার পড়েছেন দারুল উরুম দেওবন্দে শায়খ ফখরুদ্দিন আহমদ মুরাদাবাদি রাহ.’র কাছে। সাহারানপুরে শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রাহ.’র কাছেও বুখারির একাংশ পড়েছেন। এভাবে ‘খুসূসি দারস’ শেষে ১৯৬৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
১৯৬৪ সালে কুমিল্লার দারুল উলুম বরুড়া মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। ৬৪ সাল থেকে ৬৬ সাল পর্যন্ত তিন বছর এ মাদরাসায় হাদিস, তাফসিরসহ বিভিন্ন কিতাবের দারস দেন।
১৯৬৬ সালের শেষ দিকে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব রাহ.’র নির্দেশে ময়মনসিংহের আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদরাসায় শায়খুল হাদিস হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর বালিয়া মাদরাসায় হাদিসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯-৭১ সালের ১৬ ডিসম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়ায় দারসে হাদিসের খেদমত আঞ্জাম দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হবিগঞ্জে আসেন। এলাকাবাসীর অনুরোধে ও হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র নির্দেশে হবিগঞ্জের জামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর মাদরাসায় যোগদান করেন। ইন্তেকাল অবধি এ মাদরাসাতেই মুহতামিম ও শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন।
মহান আল্লাহ তায়ালা হযরতকে বুখারির দারসের জন্য কবুল করে নিয়েছেন। আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদরাসা থেকে শুরু করে সুদীর্ঘ প্রায় ৫৩ বছর থেকে সহিহ বুখারির দারস দিয়েছেন। ১৪৪০ হিজরির ২৮ রমজান থেকে তিনি জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদিস হিসেবে নিয়োগ পান। ১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার তিনি জামেয়ায় প্রথম দরস প্রদান করেন। মধ্যখানে তিনি তুরস্ক ও যুক্তরাজ্য সফরে ছিলেন। ওই দুই দেশ সফর শেষে সিলেট বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি জামেয়া রেঙ্গায় তাশরিফ নেন। সেখানে দারস প্রদান শেষে বাড়ি ফিরেন।
শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ. জীবনের দীর্ঘ সময় বিভিন্ন মনীষার সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিজেকে উচ্চতর আসনে উন্নীত করেন। আধ্যাত্মিক সাধনায় প্রথমে তিনি মুফতিয়ে আযম শায়খ ফায়যুল্লাহ রাহ.-’র কাছে বায়আত হন। তাঁর ইন্তেকালের পর শায়খুল ইসলাম মাদানি রাহ.’র কয়েকজন খলিফার সাথে পরামর্শ, ইস্তেখারা ও দিলের রুজহানের কারণে হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র কাছে বাইয়াত হন। শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী দা.বা. তাসাউফের উপর দীর্ঘদিন রিয়াযত ও মুজাহাদা করেন। এরপর এক সময় হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ. তাঁকে ইজাযত প্রদান করেন।
শুধু দারস তাদরিস ও তাযকিয়ায়ে নাফসই নয়- শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ. রাজনীতির ময়দানেও সমান অবদান রেখেছেন। আমৃত্যু তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও হবিগঞ্জ জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ইসলামি আন্দোলনের এক অগ্রণী নেতৃপুরুষ হিসেবে তিনি সারা দেশে নন্দিত ও সমাদৃত ছিলেন। ইসলাম ও মুসলিম জাতির স্বার্থে তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা সুবিদিত।
শায়খুল হাদিস হবিগঞ্জী রাহ. ময়মনসিংহের বিখ্যাত আলিম হযরত মাওলানা আরিফ রব্বানি রাহ. {মৃত্যু-১৯৯৭সাল}’র ৪র্থ কন্যা আইনুন নাহার লুৎফার সাথে ১৯৬৭ সালে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। শায়খের ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ে। এক ছেলে শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। বাকি সবাই যোগ্য আলিম ও আলিমা হয়ে দ্বীনের বহুমুখী খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
জগতে যাদেরই আগমন হবে, প্রস্থান এক সময় তার ঘটবেই। প্রতিদিন কতোশতো মানুষ এই পৃথিবীতে শুভাগমন করছে আবার প্রস্থান করছে, তার হিসাব কে রাখে? এই ‘আসা যাওয়া’র মিছিলে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হয়না। তবে কিছু মানুষ এমন আছেন, যাদের আগমনে পৃথিবী আনন্দিত হয় আর প্রস্থানে ব্যথিত হয়। তাদের বিদায়ে আর সবার সাথে পৃথিবীও কাঁদে। কারণ, মাওতুল আলিমি মাওতুল আলমে। একজন আলেমের মৃত্যু মানে পৃথিবীর মৃত্যু! ঠিক তেমনই একজন বিদ্ব্যান আলেম হলেন আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী হুজুর রাহ.।
যে সকল পীর বুযূর্গের আবির্ভাবে ধন্য হয়েছে বাংলার ভূমি, যারা নিজেদের সর্বস্ব মানবকল্যাণে উৎসর্গ করে স্মরণীয় হয়ে আছেন, আধ্যাত্মিক জগতে যারা অমর আসন দখল করে নিয়েছেন, হযরতুল আল্লাম শায়খ তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী হুজুর রাহ. নিঃসন্দেহে তাদেরই একজন।
তাঁদের মত মহামানবদের মৃত্যুতে জগতবাসীর হৃদয়ে রক্তকরণ ঘটায়। কারণ, তাঁরা ভালোবাসার রাজপথ দিয়ে মানুষের আত্মার আত্মীয় হয়ে মনের গভীরে স্থান করে নিয়েছিলেন। মোমবাতির ন্যায় নিজেকে বিলিয়ে অপরকে আলো বিকিরণ করেছেন। তেমনই একজন আলোকিত মানুষ হলেন হযরত শায়খে হবিগঞ্জী হুজুর রাহ.।
দুনিয়ার এই জীবন ক্ষণিকের। পরকালের জীবন অনন্ত, অসীম। যার শুরু আছে শেষ নেই। কিন্তু দুনিয়ার জীবনে রয়েছে সূচনা ও সমাপ্তি। অতএব, ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীতে আগমনকারী প্রতিটি আত্মাকেই মৃত্যুর তিক্তস্বাদ আস্বাদন করতে হবে। এটাই অনিবার্য এক বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতার স্বীকার হযরত মুহাদ্দিসে হবিগঞ্জী হুজুর রাহ.।
ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার বুকে কত হাজার কোটি মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, ক্ষণজন্মা কত মনীষীর পদদূলিতে ধন্য হয়েছে এই পৃথিবী। কিন্তু কেউ চিরদিন বেঁচে থাকেন নি। স্রষ্টার চিরায়ত নিয়মের মধ্য দিয়েই একদিন তাকে চলে যেতে হয়েছে পরপারে। ভক্ত-মুরিদ, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, যশ-খ্যাতি, ধন-সম্পদ সব কিছুই বিসর্জন দিয়ে। লাব্বায়েক বলতে হয়েছে মহান মাওলার ডাকে সাড়া দিতে। পৃথিবীর বুকে বিচরণশীল প্রত্যেক প্রাণীকেই একদিন না একদিন তাকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হবে। সে যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন। এজন্য বুযুর্গরা কখনো মৃত্যুকে ভয় করতেন না। মহান মাওলার সান্নিধ্য লাভের আশায় তারা সদা-সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। তেমনই আল্লাহপ্রেমিক এক বুযূর্গ ছিলেন আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী হুজুর রাহ.।
কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের একটি জামাত হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, তিরস্কারকারীদের তিরস্কার তাদের কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না। কথাগুলো বলে গেছেন স্বয়ং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে, হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত হতেই থাকবে। হক ও হক্কানিয়্যাতের একটি কাফেলা দরদভরা রাহনুমায়ীর মাধ্যমে উম্মতকে সত্যের পথে ডেকেই যান। উম্মতের কল্যাণ চিন্তায় অহর্নিশি তারা জার জার করে কেঁদেই যান। পার্থিব লোভ লালসা, ভয়ভীতি কিংবা কারো চোখ রাঙানী ক্ষণিকের জন্যও তাদেরকে বিচ্যুত করতে পারে না। যাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই হকের আওয়াজ আজো স্বগৌরবে ঠিকে আছে এবং ইসলামের সুশীতল শামিয়ানার নীচে এখনও আমাদের স্থান রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে সেই কাফেলার অসংখ্য মনীষীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ক্ষণজন্মা এমন সব মহামনীষীদের অন্যতম একজন হলেন হযরত শায়খে হবিগঞ্জী হুজুর রাহ.।
প্রতিটি মানুষের জীবনে মৃত্যু অনিবার্য। একদিন না একদিন সবাইকেই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে পরপারের অনন্ত উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে হয়। চলমান এ নশ্বর ধরা কারো বিদায়ে থেমে থাকেনা, এগিয়ে চলে তার আপন গতিতে সামনের পথপানে। তো পৃথিবীর গতিধারা যেমন থেমে থাকছেনা, তেমনি যারা চলে যাচ্ছেন তাদের স্মৃতি ধারণ করে কেউ আজীবন বসেও থাকছেনা। কিন্তু তারপরও এই অগনিত-অসংখ্য মানুষের ভেতরে এমনও কিছু মানুষ থাকেন যাদেরকে মানুষ ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারেনা। তাঁরা মানব স্মৃতিতে হয়ে থাকেন চিরঞ্জীব, থাকেন চিরঅম্লান। ইতিহাস সৃষ্টিকারী এ সমস্ত মানুষকেই বলা হয় “মরেও অমর” জাতি তাদের গুণের কদর করে, মর্যাদা দেয়। তাদের আদর্শ মেনে চলে এগিয়ে যায় সম্মুখ পানে। ক্ষণজন্মা এই সব মহামানব তারাই হয়ে থাকেন, যারা আল্লাহপাকের অপর করুণায় লালিত হয়ে জ্ঞানে-গুণে, সততায়-দক্ষতায়, দয়ায়-মায়ায়, চরিত্রে ও সামাজিক আচার-আচরণে, এক কথায় জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় একনিষ্টতায় নিজেদের জীবনকে গড়ে তুলতে পারেন। এমনি একজন ওলীয়ে কামিল হলেন হযরত শায়খে  হবিগঞ্জী হুজুর রাহ.।
কোন মানুষ আজীবন বেঁচে থাকেনি। বেঁচে থাকবার চাইলেও পারবে না। কেননা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘কুল্লু নাফসিন যা ইক্বাতুল মাউত’ প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে মহান মাওলার সান্নিধ্যে। তাঁর ডাকে একদিন সাড়া দিতেই হবে। কেউ রেহাই পায়নি; রেহাই পাবে না। এটাই চরম বাস্তবতা। প্রতিটি মানবই মৃত্যুর পরেও যুগ যুগ বেঁচে যাকে তার সৃষ্টিশীল কর্মের মধ্যে। বয়সের মধ্যে নয়। কর্মেই ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পায়। আদর্শবান এই সব মহা মনীষীদের ত্যাগ, সংগ্রাম, কর্ম ও সাধনা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুস্মরণীয় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। সুন্নাতে নববীর বাস্তব নমুনা হিসেবে সমাজে তাদের পেশ করা হয়। তাদের জীবনালোচনায় পরবর্তীরা সঠিক পথে এগিয়ে যাবার দিশা পায়। এসবেরই বাস্তব প্রতিকৃত হলেন আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী হুজুর রাহ.।
২০২০ ঈসায়ি। জানুয়ারির ১ম সপ্তাহ চলছে। আজ ৫ জানুয়ারি, রোববার বিকাল পৌনে ৫টার দিকে তিনি দেশকে এতিম করে পাড়ি জমান পরপারে। ইন্নালিল্লাহি ওইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতের উচ্চাসনে সমাসীস করুন। আমিন।