বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী একটি নাম প্রিন্সিপাল হাবীব রাহ.

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ১৯ ২০১৯, ২৩:০৮

মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দীন আহমদ

প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান (রাহ:) দেশব্যাপী আলোচিত একটি নাম। আন্দোলন সংগ্রামের উত্তাল মিছিলে প্রথম কাতারে থাকা সাহসী যোদ্ধাদের একজন । মানুষ সিলেটের হলেও খ্যাতির সীমা ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশে।

হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)এর তাওবার রাজনীতি থেকে আন্দোলনের সূচনা । তসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলন,শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করণ আন্দোলনের মাধ্যমে চলে আসেন লাইম লাইটে ।

জন্ম

তিনি ৮ জুলাই ১৯৫৩ খৃস্টাব্দে রোজ বুধবার সিলেটের গোলাপগন্জ থানার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের হাজীপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । বাবা :- মাওলানা মাহমুদ আলী(রাহ:) মাতা :- আছিয়া খাতুন

 

শিক্ষা জীবন :

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯৬২ সনে ফুলবাড়ী আজিরিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় দাখিল তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৬৬ সনে দাখিল ৬ ষষ্ঠ বর্ষে প্রথম বিভাগে মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ হন । ১৯৭০ খৃস্টাব্দ ফাজিল ১৯৭৩ সনে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে কামিল পাশ করেন।

কর্মজীবন :

তিনি ১৯৭৩ সনে সুরমা নদীর তীরে কাজির বাজার পেয়াজহাটা মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন।

এরিপার্শ্বে প্রিন্সিপাল( রাহ.) এর হাত ধরে ১৯৭৪ সালে জুন মাসে দেশের শীর্ষ উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠা হয় ঐতিহ্যবাহী ইসলামী বিদ্যাপীঠ জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার সিলেট ।

প্রিন্সিপাল যেমনি ছিলেন একটি ইতিহাস তেমনি তার হাতে গড়া এ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে একটি ইতিহাস । যার অস্তিত্ব সংরক্ষণে প্লাবিত হয়েছিল মাদানি কাফেলার সাহসী ছাত্র সেনাদের তাজা রক্ত ।মহান আল্লাহর সাহায্যে শত্রুপক্ষ থেকে মাদ্রাসা ধ্বংসের সকল অপচেষ্টাকে দমন করে জামেয়াকে এ পর্যন্ত বিশ্বনন্দিত একটি দ্বীনী বিদ্যাপীঠ ও সিলেট সহ বিশ্বের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ঈমান আকিদা সংরক্ষণের দূর্গ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন প্রিন্সিপাল(রাহ.)।

 

রাজনৈতিক অবস্থান:

তিনি হাফেজ্জী হুজুর(রাহ.)এর পরে শায়খুল হাদীসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে কাজ করেন । দীর্ঘকাল নায়েবে আমির হিসেবে ছিলেন। ২০১২ সালে ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক( রহ.)এর ইন্তেকালের পর দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সিদ্ধান্তে পরবর্তী আমীর হিসেবে তিনিই দায়িত্ব প্রাপ্ত হন ।

তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতার সাথে সকল নেতা কর্মীদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা নিয়ে আমৃত্যু আমীরের দায়িত্ব পালন করে যান ।

 

আন্দোলন সংগ্রাম :

তিনি ছাত্র জীবন থেকেই ছিলেন জীবন পথে ক্লান্তিবিহীন এক জাগ্রত সংগ্রামী বীর।

ইসলামের জন্য বাতিলের বিরুদ্ধে হেরার ধ্বনী কণ্ঠে ঈমানী চেতনা নিয়ে সর্বদা আন্দোলন সংগ্রাম করা ছিল তার আত্মার প্রশান্তি ও খোরাক ।

তিনি বলতেন জীবনের সফলতা ব্যর্থতা আমি বুঝিনা শুধু এটা জানি আমি আমার জীবন আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করেছি ।

আমার কাজ হচ্ছে হকের পক্ষে বাতিলের বিরুদ্ধে কথা বলা । আল্লাহর জমিনে তার খেলাফত প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া । কবুল করা না করা আল্লাহর ব্যাপার ।তাই আমার জীবনে কোনো ব্যর্থতা হয়েছে বা হবে মনে করিনা সবই আমার সফলতা ।

তিনি এমন দৃঢ় বিশ্বাস ও সাহসী আশা নিয়ে ১৯৮১ তে এমসি কলেজের অধ্যাপক সর্দার আলাউদ্দিন কর্তৃক কুরআন অবমাননা,নাস্তিকতা ও ইসলাম বিরোধী আন্দোলন শাহজালালের পুন্যভূমী বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট থেকে শুরু করেন । তার নেতৃত্বে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশময়।

১৯৯২ ভারতের বাবরী মসজিদ ভাঙা,১৯৯২ সাহাবায়ে কেরামদের বিরুদ্ধে জামায়াত ইসলামী কর্তৃক অবমাননা সহ যখনি কোন ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো তখনি তিনি নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন ।

বিশেষ করে ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্করে লিপিবদ্ধ রয়েছে থাকবে । কেননা তাসলিমা নাসরিন সেদিন প্রাণনাশের ভয়ে ছদ্মবেশে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল ।

প্রিন্সিপাল সেদিন থেকে হয়েছিলেন নাস্তিক মুরতাদ ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তির মরন ফাঁদ ও আতঙ্কের মুল কারন যেদিন তাসলিমা নাসরিনের কর্তিত মস্তক এনে দিতে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। আজ পর্যন্ত সেই কুখ্যাত তাসলিমা নাসরিন প্রিন্সিপালের হুংকারের ভয়ে দেশে ফেরার কল্পনা করতে পারেনি পারবেনা ইনশাআল্লাহ ।

তিনি এ আন্দোলনকে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে তুলেছিলেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)এর নেতৃত্বে । যার কৃতিত্বের সোনালী দিকগুলো ভুলে যাওয়া অসম্ভব ।

প্রিন্সিপাল(রাহ:) বলেছেন আমার আন্দোলন সংগ্রামে শায়খুল হাদীসের সহযোগিতার সৃতিগুলো বর্ণনা করে শেষ হবেনা।

কারাগারের দিনগুলো:

আন্দোলন সংগ্রামে প্রিন্সিপাল(রাহ.)কে বিভিন্ন সময়ে নানামুখী ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হতে হয়েছে ।বাতিল ও শত্রুপক্ষের চরম মিথ্যাচার ও অপবাদের কারণে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয়েছে তাকে ।তথাপি সকল প্রকার বাধাবিপত্তি প্রতিকূলতা রোধ ও জুলুম নির্যাতন সহ্য করে নাস্তিক মুরতাদদের সময়ের সঠিক দাতভাঙ্গা জবাব দিতে বিজয়ের জয়ধ্বনি বাজাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ।

তিনি যখন কারাগারে বন্ধি হন তখন ছিল ১৯৯০ সাল ২৪-২৫ জুন । এদুদিন কারাগারে হুজুরের সঙ্গী ছিলেন দীর্ঘদিনের সহকর্মী আল্লামা আব্দুস সোবহান হোস্টেল সুপার হুজুর (দা:বা) ।

পর্যায়ক্রমে ২০০৭ ইংরেজী ১৬ ই মে মধ্য রজনীতে তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকারের যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হয়ে ২০০৮ ইংরেজী ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে সাত মাস কারাবাস থাকেন প্রিন্সিপাল(রাহ.) ।

কারাগারে সম্মান:

পৃথিবীর বন্ধিশালা কারো জন্য সম্মান আবার কারো জন্য অপমান। যারা ইসলাম ও হকের পক্ষে কথা বলায় বাতিলের ষড়যন্ত্রে কারাবরণ করেন তারা সুন্নতে আম্বীয়ার অংশ হিসেবে বিবেচিত হন।

যারা পার্থিব জগতের অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে জেল হাজতে আসেন তারা তাদের অপমানের চিহ্ন সমাজে প্রকাশ করতে বাধ্য হন।

বিশেষ করে উলামায়ে হক্কানির কারাবরণ আল্লাহর পক্ষ থেকে খাস একটি অনুগ্রহ,যার ফলে রব্বে কারীমের সান্নিধ্য গভীর হয় ।

যেমন :- প্রিন্সিপাল হুজুর(রাহ:) কে যখন ১৬ ই মে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল তখন ওসি সাহেব তার বাথরুম দেখিয়ে ওজুর ব্যবস্থা এবং জায়নামাজ দেন ।ওসি সাহেব চা পানের ব্যবস্থা করে বললেন হুজুর রাত প্রায় দুটো বেজে যাচ্ছে । ফজরের পরে আপনার সাথে দেখা হবে এ কথা বলে ওসি সাহেব চলে যান । এই হচ্ছে উলামায়ে কেরামের সম্মান যা আল্লাহ পাক ওদের দ্বারা ব্যবস্থা করান ।

শুধু তাইনা ওসি সাহেব বললেন হুজুর আপনি চিন্তা করবেন না কোন সমস্যা হবেনা আপনার । দেখুন এটা আসলে মিডিয়ার ষড়যন্ত্র ।

কারাগারে স্বপ্ন শান্তির কারণ

৫ জুন ২০০৭ ইংরেজী মঙ্গলবার :- রাতে স্বপ্ন দেখি হাফিজুল হাদীস আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী(রাহ:) একখানা সাদা প্লেন নিয়ে সরাসরি আমাকে দেখতে এসেছেন । খুব শান্তনা দিলেন । তিনি আমাকে কারাগার থেকে বের করে নিতে এসেছেন।

ঘুম থেকে উঠে মনে একধরনের ফুরফুরে ভাব লক্ষ করলাম । আমি আমার আকাবিরীনদের রূহানী তা”আল্লুক থেকে ছিটকে পড়িনি ভেবে মনে শান্তি লাগলো ।

জেল হাজত সোনালী সুযোগ

প্রিন্সিপাল(রাহ:) বলেন, যখন আমাকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে নেয়ার আদেশ আসে তখন আমি সন্তুষ্টচিত্তে একথা মনে করি যে,হযরত ইউসুফ(আ:), মহানবী(সা:),ইমাম আবু হানিফা(রাহ :), ইমাম বুখারী(রাহ:), ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল(রাহ:),হযরত শায়খুল হিন্দ(রাহ:),হযরত শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী(রাহ:) প্রমুখের সুন্নতের উপর আমল করার সৌভাগ্য লাভ করেছি ।

এমন সোনালী সুযোগ ক’জনের ভাগ্যে জোটে! এভাবে সৌভাগ্যের কথা ভেবে নিজেকে ধন্য মনে করে সেদিন হাজতে প্রবেশ করলাম ।

সাহসী যোদ্ধার প্রতি জনতার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা

হকের সাহসী সৈনিক বন্ধি হলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয়ে আঘাত চলে আসে তারা তা সহ্য করতে পারেননা ।

যার বাস্তব চিত্র:- প্রিন্সিপাল (রাহ.)কে গ্রেফতার করা হয়েছে এ খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে সিলেটের হাজারো তাওহিদী জনতা তাদের সিংহ পুরুষকে মুক্তি ও দেখার জন্য জেল গেইটে আল্লাহু আকবরের ধ্বনী দিয়ে উপস্থিত হন।

জেল কর্তৃপক্ষ পুলিশ প্রশাসন তাওহিদী জনতার আল্লাহু আকবরের ধ্বনিত কন্ঠে আকাশ বাতাস মুখরিত পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি বরং ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ।

পরিশেষে মুক্তির দিনেও এভাবে তারা তাদের সাহসী যোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রদর্শন করেন ।

প্রিন্সিপালের প্রাণ জামেয়া মাদানিয়া

প্রিয় নবীজি(সা:) যখন মক্কা ছেড়ে মদিনার পথে হিজরত করতে ছিলেন তখন তিনি তার হৃদয়ের দৃষ্টি মাতৃভূমি মক্কার দিকে বারবার ফিরে তাকাতেন। আর মনের কষ্ট বেদনা আবেগ ও ভালোবাসা প্রকাশ করতেন অশ্রুজল ফেলিয়ে।

মন চাইতো না ভালোবাসার জন্মভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে । মদিনায় অবস্থান করেও রাসুলের হৃদয় তাকিয়ে থাকতো মক্কার দিকে । কেননা মক্কার ভুমির সম্পর্ক ছিল রাসুলের হৃদয় ও জন্মের সাথে ।

যে বস্তুর সম্পর্ক জন্ম থেকে আত্মার সাথে প্রতিষ্ঠিত থাকে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও মহব্বত অন্য সব কিছু থেকে ভিন্ন হয়। তা মহান রব্বে কারীম প্রদত্ত প্রকৃত ভালোবাসার একটি রূপ ।

তেমনি প্রিন্সিপাল (রাহ:) এর হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল তারি হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার সিলেটের সাথে ।

তিনি আল্লাহর অশেষ কৃপায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশিষ্ট বুযুর্গ উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে এ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক কষ্ট জুলুম নির্যাতন সহ সকল প্রকার ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে । তাই এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি হুজুরের ভালোবাসা ছিল অন্য সবকিছু থেকে আলাদা।

মাদ্রাসার প্রতি তার ভালোবাসা এমন ছিল মনে হত এটাই তার প্রাণ এটাই তার প্রশান্তি । কারণ তিনি মাদ্রাসার আঙ্গিনায় মহান রব্বে কারীমের অশেষ করুনার নিদর্শন অনুভব করতেন । সেখানে রাসুলের প্রতি ভালোবাসার অধিক গভীরতা খুজে পেতেন । অনুভব করতেন সাহাবায়ে কেরাম(রা:)এর সে দৃশ্যগুলো যা দারে আরকাম ও আসহাবে সোফ্ফায় রাসুলের সাথে সম্পর্কিত ছিল। কেননা তা ছিল রাসুলের ইলমে ওহীর ফুল বাগান।

সকাল দশটার পর থেকে রাত প্রায় দশটা কখনো আরো অধিক সময় তিনি মাদ্রাসায় অবস্থান নিতেন। পার্থিব সকল প্রয়োজনকে পিছনে ফেলে মাদ্রাসায় অবস্থান করা বা সময় দেয়াকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। সফরে কিংবা বাসায় যেখানে যখন প্রয়োজনে যাওয়া হত সেখানে তখন দেহ থাকলেও হৃদয় পড়ে থাকতো মাদ্রাসার দিকে ।

আমরা যখন মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম তখন দেখেছি তিনি আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি কেমন আশিক ছিলেন । আমরা দেখতাম যখন মাদ্রাসার মসজিদ মিনারে আযানের ধ্বনী বেজে উঠতো সঙ্গে সঙ্গে তিনি মসজিদের দিকে ছুটে আসতেন । হুজুরের অভ্যাস ছিল শত ব্যস্ততা পিছনে ফেলে নামায কে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা । এটা তার বিশেষ উপদেশও ছিল মাদ্রাসার সকল আসাতিজায়ে কেরাম ও ছাত্রদের প্রতি ।

তিনি নবীজির বাগানকে সর্বদা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর সুগন্ধিময় পরিবেশে রাখতে পছন্দ করতেন।

তাই তিনি মাদ্রাসার ভিতর আঙ্গিনায় ফুলগাছ লাগিয়ে সুসজ্জিত রাখতেন। অনেক সময় দেখা যেত অপছন্দ কোন জিনিস দৃষ্টিগোচর হলে নিজেই তা সরিয়ে নিতেন বা জামেয়ার ক্লিনার ম্যানকে ডেকে পরিস্কার করাতেন ।

তিনি অফিস কক্ষে যতক্ষন অবস্থান নিতেন ততক্ষণ হয়তো কিতাব মুতালা বা বই লিখনিতে কিংবা আল্লাহর তাসবীহ যিকির ও রাসুলের প্রতি ভালোবাসার দুরূদ পাঠ করতে ব্যস্ত থাকতেন ।

তিনি কুরআন হাদীসের ফেকহী বা তাফসীর বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিয়ে তাহকিক করতেন । কোনো মাসআলায় সন্দেহ হলে এর সঠিক সমাধান খুঁজতে নির্ভরযোগ্য কিতাব মুতালা করতেন ।

যেমন একদিন আমার উস্তাদ মুফতি মুহাম্মদ শফীকুর রহমান(দা:বা) তিনি আমাকে পুরাতন ছাপার এক খন্ড ফতোয়ায়ে শামী দিয়ে বললেন প্রিন্সিপাল হুজুর কে নিয়ে দিয়ে এসো । আমি কিতাব খানা প্রিন্সিপাল হুজুরের অফিস কক্ষে নিয়ে যাই । গিয়ে দেখি হুজুর কামরার দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ।

আমি হুজুরকে দেখে সালাম করি আর বলি হুজুর মুফতি সাহেব হুজুর আপনাকে এ কিতাব দিতে বলেছেন ।

তিনি বলেন আচ্ছা আনছোনি বা বললাম জি হুজুর আপনি যে মাসআলা জানতে চেয়েছেন তার আলোচনা ঐ পৃষ্ঠা থেকে করা হয়েছে মুফতি সাহেব হুজুর সেভাবেই বের করে দিয়েছেন যেভাবে আপনি বলেছিলেন ।

আচ্ছা তাহলে আমার টেবিলে রেখে এসো । আমি হুজুরের কথা মত সেখানে রেখে হুজুরকে সালাম দিয়ে ক্লাস রুমে ফিরে আসি ।

আমি এটাই বুঝাতে চেয়েছি প্রিন্সিপাল হুজুর(রাহ:) কেমন তাহকিকি একজন বিজ্ঞ আলেম ছিলেন ।

আলহামদুলিল্লাহ আমার জানামতে বা তত্ত্ব ভিত্তিতে প্রিন্সিপাল(রাহ:) কুরআন হাদীসের যা কিছু বর্ণনা করেছেন লিখনি বা বাকশক্তির মাধ্যমে তা ছিল সঠিক ও তত্ত্বনির্ভর । এটা ছিল মহান আল্লাহর এক বিশেষ করুনা হুজুরের প্রতি।

আল্লাহর প্রতি ভয় প্রিন্সিপাল হুজুরের কেমন ছিল তা অনুভব হত যখন তিনি সকল ছাত্র উস্তাদ নিয়ে জহর ও এশার নামাজের পর সুন্নতি ও বিশেষ আমল শেষে একসাথে যিকির ও দোয়া করতেন ।

আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি তার প্রকৃত ভালোবাসা ছিল বলেই জামেয়ার সকল ছাত্র উস্তাদ এমনিতেই তার প্রতি আশিক হয়ে যেত ।

যে কারণে প্রিন্সিপালের ডাকে তার রূহানী সন্তানরা ইসলামের জন্য জান কুরবান করতে কুণ্ঠাবোধ করতনা ।

নেই আপনার তুলনা :- প্রিন্সিপাল হাবিব

আল্লাহর প্রিয় বান্দা যারা তাদের নেই কোন ভয় নেই কোন চিন্তা । ওরা কারা কীভাবে হতে পারেন?

ওদের পরিচয় স্বয়ং রব্বে কারীম বলে দিচ্ছেন । যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ভয় রাখেন তথা মুত্তাকি হন তারা হলেন আওলীয়া-আল্লাহ আল্লাহর প্রিয় । আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে চাইলে দুটি গুণ পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করতে হবে ।

● আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস তথা ঈমান খালিস হতে হবে । ● আল্লাহর প্রতি ভয় রাখা তথা মুত্তাকি হতে হবে ।

যখন এদুই গুণে কোনো ব্যক্তি গুণান্বিত হয়ে যাবে সে পার্থিব ক্ষণস্থায়ী ও পরকালীন চিরন্তন জীবনের দুটি বিষয় অর্জনের নিশ্চয়তা লাভ করবে।

● যেমন :- পরকালিন জীবন কবর,হাশর,মিজান, পুলসিরাত ইত্যাদির ভয়াবহ অবস্থা থেকে নিরাপদ থাকবে ।

অর্থাৎ পরকালীন জীবনের ভয়াবহ অবস্থা তার ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হবেনা । আল্লাহ পাক নিজেই তার রহমত দ্বারা সাহায্য করবেন।

● পার্থিব জীবনে রেখে আসা আমানত তথা পরিবার আত্মীয় স্বজন ইত্যাদির ভবিষ্যত জীবনের ব্যাপারে চিন্তা মুক্ত থাকবে । অর্থাৎ ওরা কোন অবস্থায় কিভাবে জীবন পরিচালনা করবে?

ওরা আল্লাহর সন্তুষ্টি পথে প্রতিষ্টিত থাকতে পারবে কি না এসব বিষয়ে যে পেরেশান বা চিন্তিত হওয়ার কথা তা হবেনা ।

মহান আল্লাহ পাক নিজেই তার প্রিয় বান্দার পার্থিব জগতে রেখে আসা এসব আমানত সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন ।

সুতারাং আমাদের দৃঢ় আশা ও বিশ্বাস মহান আল্লাহ পাক প্রিন্সিপাল(রাহ:) কে এদুটি বিষয়ে পুরস্কৃত করবেন ।

পরকালীন জীবনের প্রতিটি মহলে নিরাপদ ও শান্তিতে রাখবেন এবং পার্থিব জীবনে রেখে যাওয়া আমানত যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন ইনশাআল্লাহ ।

বিশেষ করে হুজুরের হাতে গড়া জীবনের সফল স্বপ্ন ঐতিহ্যবাহী ইসলামী বিদ্যাপীঠ জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার মাদরাসাকে মহান রব্বে রাহীম সর্বদা সমস্ত ফিতনা ফাসাদ ও শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত রাখবেন । কেননা তিনি এদুই গুণে গুণান্বিত ছিলেন আমাদের প্রবল ধারণা ও বিশ্বাস ।

তাছাড়া প্রিন্সিপাল(রাহ:) তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে হকের বিজয় অর্জনে যেমন ছিলেন রাজপথের এক সাহসী বীর সিপাহসালার ।

তেমনি তিনি ছিলেন জাগ্রত রজনীতে খোদার কুদরতী পায়ে মাথানত করে সেজদারত অবস্থায় আহাজারি করতে এক ইবাদতগুজার বান্দা ।

তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রহমত লাভের জন্য সর্বদা নিশির আধারে অশ্রুজল ফেলতেন ।

শেষ রজনীতে মহান আল্লাহর কুদরতী পায়ে এভাবে লুটিয়ে পড়ে তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সাহস যোগাতেন প্রতিনিয়ত । যার ফলে বাতিল তার নাম শুনলেই সহজে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে যেত। এভাবেই সাহসী প্রিন্সিপাল জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

তাই কবির ভাষায় বলি

হৃদস্পন্দন প্রিন্সিপাল কত কবি তোমায় নিয়ে লিখেছে কবিতা । কত মুজাহিদ তোমায় নিয়ে গেয়েছে জিহাদের জয়গান। কত লোক দিয়েছে তোমার উপমা। কিন্তু আমরা তোমার কোনো উপমা দিতে চাইনা । তুমি উপমাহীন তুলনাহীন নজিরবিহীন এই সময়ের ।

প্রিন্সিপাল(রাহ:) এর চাওয়া

● তিনি চাইতেন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর খেলাফত প্রতিষ্ঠা হোক । ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তি পৃথিবী থেকে উৎখাত হোক। সেজন্য তিনি তিনটি মূলনীতি নিয়ে আমৃত্যু কাজ করেছেন।

● তালীমুদ্দীন ● তাবলীগে দ্বীন ● তাগলীবে দ্বীন তথা জিহাদ । তিনি সেগুলোর উপর ছাত্রদের শিক্ষা দীক্ষা গ্রহণ করতে মাদ্রাসার কাঠামো হিসেবে এ তিনটিকে নির্বাচন করেন।যা ইসলামের মৌলিক মূলনীতিও বটে।

তিনি যেভাবে ছিলেন একজন বীর মুজাহিদ আলেমে দ্বীন,বিশিষ্ট লেখক ও বক্তা তেমনি ছিলেন আধ্যাত্মিক রাহবর ।

নিশি রাত্রিতে মুসল্লায় চুপিচুপি রব্বে কারীমের নিকট আহাজারি করতেন এবং তাহাজ্জুদ পড়তেন। কেননা এটা ছিল রাসুল(সা :)এর আদর্শ ও নির্দেশ । নিরাপদে জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম ।

●তিনি সর্বদা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন তার শেষ নিঃশ্বাস যেন শুক্রবার দিন বা রাতে অথবা শহীদী মৃত্যু হয় ।

আলহামদুলিল্লাহ আমরা দৃঢ় আশা ও বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি আল্লাহ পাক যেমনি তার আন্দোলন সংগ্রামের সফলতা কৃতিত্বের সাথে দান করেছেন তেমনি হুজুরের মৃত্যুর উভয় আকাঙ্খা পূর্ণ করেছেন ।

কেননা হাদীসের মধ্যে এসেছে কোন মুসলমান যদি শুক্রবার রাতে বা দিনে মৃত্যু বরণ করে তাহলে তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করা হয় এবং হাশরের ময়দানে শহীদের চিহ্ন নিদর্শনসহ উত্থিত হবেন । আর প্রিন্সিপাল হুজুর শুক্রবার রাতে ইন্তেকাল করেন ।

লিখিত গ্রন্থ সমুহ

প্রিন্সিপাল(রাহ:) শিক্ষকতা ও আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি করে গেছেন গ্রন্থ রচনার কাজ । তিনি তার জীবনে ত্রিশটিরও অধিক বই লিখে গেছেন ।

তিনি যেমন ছিলেন রাজপথ কাপানো ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তির বিরুদ্ধে এক সাহসী যোদ্ধা ।

তেমনি ছিলেন তিনি নাস্তিক মুরতাদ ইসলাম বিরোধী অপশক্তি ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি বিদ্বেষ লালন কারীদের বিরুদ্ধে এক সাহসী কলম সৈনিক ।

তিনি তার লিখনিতে নাস্তিক মুরতাদ ইসলাম বিদ্বেষী অপশক্তি এবং মওদুদী ফিতনা সম্পর্কে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে লিপিবদ্ধ করেছেন ।আলহামদুলিল্লাহ মুসলিম উম্মাহ এ থেকে উপকৃত হয়েছে ভবিষ্যতে হবেন ইনশাআল্লাহ।

প্রিন্সিপাল হুজুরের ইন্তেকাল :

১৮ অক্টোবর ২০১৮ ইং: বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ছিল এক শোকাহত বেদনাদায়ক রজনী ।সে রাত্রিতে প্রায় ১২:১০ মিনিটে বাংলার উজ্জ্বল নক্ষত্র আমাদের প্রাণ-পুরুষ প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান (রাহ.) ইন্তেকাল করেন ।

তিনি সেদিন রাতে ঘুমানোর পূর্বে অভ্যাস মোতাবিক অজু ইস্তেন্জার পর কুরআনের বিশেষ কয়টি ছোট সুরা তিলাওয়াত করেন। তারপর যিকির রত অবস্থায় অদৃশ্য কারো তথা সম্ভবত মৃত্যুকালিন রহমতের ফেরেশতার প্রতি দৃষ্টিপাত করে সুন্নতি সালাম প্রদানের পর পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে মৃত্যুকালিন কষ্ট অনুভব ছাড়াই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মাওলায়ে কারিমের সান্নিধ্যে চলে যান । ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন▪

তিনি মৃত্যুকালে স্ত্রী,চার ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তান সহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজন মুহিব্বিন আশেকিন রূহানী সন্তানদের রেখে যান।

জানাযার প্রস্তুতি 

১৯ অক্টোবর শুক্রবার সকাল, হযরতের মৃত্যুর সংবাদ শুনা মাত্রই সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল সহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে উলামায়ে কেরাম ছাত্র সমাজ ও ধর্মপ্রাণ সর্বস্তরের ভক্ত অনুরাগী তাওহিদী জনতা তাদের প্রাণ-পুরুষের নামাযে জানাযায় অংশ গ্রহণ করতে এবং তার মোবারক চেহারাকে শেষবারের মত দেখতে বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিয়ে ছুটে আসেন জামেয়া মাদানিয়া কাজীর বাজার মাদরাসায় ।

সকাল ৯ টার পর হুজুরের মরদেহ নিজ বাসা থেকে মাদ্রাসায় আনা হয় । সেখানে হাজারো মুসল্লি সারিবদ্ধ হয়ে জানাযার নামাযের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত এক নজরে ভালবাসার প্রিয় মানুষটির বরকতময় চেহারা দেখতে থাকেন ।

জানাযার নামাযের স্থান :

জুমআর নামাজ শেষে মরদেহ নিয়ে আসা হয় সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে । সেখানে বেলা সাড়ে তিন ঘটিকায় লাখো তাওহিদী জনতার উপস্থিতিতে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয় ।

ইমামতি :

প্রিন্সিপাল (রাহ.) এর দ্বিতীয় ছেলে মুফতি আব্দুর রহমান ইউসুফ জানাযার নামাযে ইমামতি করেন । জানাযার পূর্বে দেশের শীর্ষ উলামায়ে কেরাম বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ,সুধীজন,লেখক সাহিত্যিক ইসলামিক স্কলাররা প্রিন্সিপাল হুজুর (রা:) এর জীবন ও কর্মের উপর স্মৃতিচারণ মুলক সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন ।

সমাহিত :

জানাযার নামায শেষে প্রিন্সিপাল হুজুর(রাহ.)এর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া কাজির বাজার মাদরাসার প্রাঙ্গনে ফুল বাগানে তাকে দাফন করা হয় । আল্লাহ পাক প্রিন্সিপাল হুজুর (রাহ.)কে ক্ষমা করত জান্নাতুল ফিরদাউসে উচু মাকাম দান করেন । এবং হুজুরের শোকাবহ পরিবারকে সবরে জামিল দান করেন । আমীন