২০ দলীয় জোট ত্যাগের হিড়িক এবং শরিক দলগুলোর পাওনাদেনা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ০৪ ২০২১, ১৮:১০

শামছুল হক ইবনে সিরাজ: প্রায় ২২ বছর আগে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চারটি মৌলভিত্তির ওপর গঠিত হয়েছিল চারদলীয় ঐক্যজোট। নগদে ফলাফলও পেয়েছিল তারা। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তখন সরকার গঠন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে ৫ বছর অতিক্রম করে তারা। মাঝপথে ২০০৫ সালে জোট ত্যাগ করে শায়খুল হাদিস আজিজুল হক রহ.-এর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। কারণ হিসেবে তারা বলেছিলেন, এই জোটের মাধ্যমে একটি শাসকের পতন হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি। চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদ শেষে নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশে নতুন করে আমেজ-উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয়। পুরো দেশ তখন দুটি জোটে বিভক্ত। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১১ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস তখন মহাজোটের সামনে সুদূরপ্রসারী ৫ দফা প্রস্তাব পেশ করে, যা তৈরি হয়েছিল দেশ-জাতি ও ধর্মের বৃহৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুল জলীল খেলাফত মজলিসের ৫ দফায় স্বাক্ষর করে ইসলামি এই দলটিকে মহাজোটে গ্রহণ করেন; কিন্তু জোট শরিক বামপন্থি কয়েকটি দলের চরম তোপের মুখে পড়েন আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক। বামপন্থিরা ইসলামি সংগঠনের সাথে করা চুক্তির চরম বিরোধিতা করে বলেন, বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে করা চুক্তি ও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে করা চুক্তি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। একপর্যায়ে বামপন্থিদের চাপে মরহুম আব্দুল জলীল খেলাফত মজলিসের দেওয়া শর্তে পরিবর্তন আনতে বলেন, যা ছিল চরম নীতি বিবর্জিত ও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। ফলে খেলাফত মজলিস এমন অবান্তর প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মহাজোটের বাইরে চলে যায়। অবশ্য সেই নির্বাচনও সময়মতো অনুষ্ঠিত হয়নি। যথা সময়ে নির্বাচনের পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতা চলে যায় দুই উদ্দীনের হাতে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত দুই বছরের সেনাশাসনসহ পরবর্তী সময়ে তিন তিনটা জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল। দীর্ঘ এ সময়ে তিস্তা-পদ্মায় অনেক জল গড়ায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে টানা আন্দোলন-সংগ্রাম, হরতাল-অবরোধ চলে। চারদলীয় জোট বর্ধিত হয়ে ২০ দলীয় জোটে রূপ নেয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও অংশ নেয়। তবে রাজনীতির বুথ-খেলায় পেরে ওঠেনি তারা। ফলাফল ক্রমান্বয়ে চরম অবনতি। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ড. কামাল হুসেনের নেতৃত্বে আরও বাজে ও লজ্জাস্কর পরিণতি উপহার দেওয়া হয়! অবশ্য ভোটের মাঠে ২০ দলীয় জোট কিংবা ঐক্যফ্রন্টের এই ভরাডুবি বাস্তবেই ছিল, নাকি কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটা বহু তর্কসাপেক্ষ বিষয়।

এরই মধ্যে ২০১৩ সালের হেফাজত আন্দোলনের পর থেকে জোটপন্থি ইসলামি দলগুলোর ওপর সরকারের তরফ থেকে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। আর এটা খেই হারানোর পর্যায়ে চলে যায় ২০২০-২১ সালে। বহু আলেম ও ইসলামি রাজনীতিক কারান্তরীণ হন। ইসলামী দলগুলোর ওপর সরকারের নজরদারি ও চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সরকার তাদের দুর্বল পয়েন্টগুলোও ধরে ফেলে। জোট-রাজনীতি না ছাড়লে চাকুরি- প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসার নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি সামনে চলে আসে। একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিরোধী শক্তিকে দমিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকার আশাতীত সফলও হয়।

২০১৬ সালে মরহুম ফজলুল হক আমিনির ইসলামি ঐক্যজোট ২০ দলীয় জোট থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার পর ইসলামি দলগুলোর মধ্যে এ বছরের জুলাই মাসে প্রথম জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয় মাওলানা জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশ। তবে তারা জোট ছাড়ার কারণ উল্লেখ করে যে বক্তব্য মিডিয়ায় প্রচার করেছেন, সেটাকে রাজনীতিজ্ঞরা শিশুসূলভ বলে মন্তব্য করেছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা জমিয়তের বক্তব্যে হতাশ হয়েছি। সরকারের চাপে টিকে থাকতে না পেরে জোট ছেড়ে জমিয়ত এখন চরম অসত্য বক্তব্য দিচ্ছে। আলেমদের কাছ থেকে এটা কেউ আশা করে না।’ ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান আরেকটু কঠিন স্বরে বলেছেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পরপরই জোট ত্যাগের ঘোষণা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।’ তবে যাই হোক, দেরিতে হলেও জমিয়তের এমন সিদ্ধান্তকে দলীয় নেতাকর্মীসহ আলেমগণ সাধুবাদ জানিয়েছেন এবং একে ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

২০ দলীয় জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল অনেক আগে থেকেই। এ ছাড়া ইসলামী ঐক্যজোট, ন্যাপ, এলডিপি, লেবার পার্টি ও আন্দালিব রহমান পার্থের বিজেপি ইতিমধ্যে জোট ত্যাগ করেছে। খোদ বিএনপির ভেতর থেকেও জোট ভেঙে দেওয়ার সুর উঠেছে বেশ জোরেসুরে। সর্বশেষ সে পথে যোগ দিল অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইসহাকের খেলাফত মজলিস বাংলাদেশ। তবে জোট ত্যাগের ঘোষণায় আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তাদের বক্তব্যটি ছিল বেশ গোছালো ও সতর্কতাপূর্ণ। জোটের মূল দল কিংবা শরিক দলের কাউকে দোষারোপ করা অথবা ‘না পাওয়ার’ অভিযোগ তুলে নিজেদের অসহায়ত্ব কিংবা কোনো প্রকার হীনম্মন্যতা প্রকাশ করেনি তারা। এ জন্য তারা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।

খেলাফত মজলিস তাদের দুই বছরের পর্যবেক্ষণ থেকে বলেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোট কার্যত তাদের পথ হারিয়েছে। তারা এটাও বলেছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের এক মাসের মধ্যেই অর্থাৎ, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে খেলাফত মজলিস শুরা অধিবেশন আহ্বান করে। সেখানে জোটের কার্যক্রম থেকে নিজেদের আপাতত গুটিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ২০ দলীয় জোটকে পর্যবেক্ষণ করার মতামত গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ অক্টোবর মজলিসে শুরার অধিবেশনে খেলাফত মজলিস দিনব্যাপী আলোচনা-পর্যালোচনার পর ২০ দলীয় জোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ২২ বছরের যুগপৎ রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটায় খেলাফত মজলিস। দেরিতে হলেও জোট ত্যাগের এই সিদ্ধান্তকে দলীয় নেতাকর্মী ও রাজনীতিজ্ঞরা বলছেন ‘সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত’।

সদ্য জোটত্যাগী দলগুলোতে অনেক মেধাবী ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ আছেন। জোটে থাকা কিংবা জোট ছাড়ার যৌক্তিকথা তারা না বোঝার কথা নয় এবং এর একটা ভালো ব্যখ্যাও হয়তো তাদের কাছে রয়েছে। তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বললে, ‘নির্বাচনকালীন এই জোটকে এত দীর্ঘ পথ টেনে নিয়ে আসাটা মোটেও সঠিক ছিল না। এটা শুধু নিজেদের আদর্শ ও নীতিকেই বাধাগ্রস্ত করেনি; বরং সাংগঠনিকভাবেও দলগুলোকে অন্তত দুই যুগ পেছনে নিয়ে গেছে। এই লেজুড়ভিত্তির খেসারত কত দিনে দিতে হবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।

যাই হোক, দেরিতে হলেও জোট ত্যাগের এই সিদ্ধান্ত দেশ-জাতি ও ধর্মের কল্যাণে কাজ করবে বলে আমরা আশাবাদী। বিশেষ করে অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইসহাকের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য ইসলামি রাজনীতির জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। কেননা, তাঁর বক্তব্যে রাজনৈতিক শিষ্টাচার গুরুত্ব পেয়েছে। বক্তব্যের কোনো অংশ দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গীদের আঘাত করেনি; সে জন্যই বোধহয় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগিরও বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘দলগুলো এখন আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য নিজেদের মতো তৈরি করতে সুযোগ পাবে।’

আমরাও চাই, ইসলামি দলগুলো সব দুর্বলতা কাটিয়ে ফিরে আসুক খেলাফত প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত শপথ নিয়ে। লেজুড়বৃত্তির মানসিকতা ঝেড়ে বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতির চর্চা করুক ঘরে-বাইরে। স্বপ্নীল আগামী বিনির্মাণের জন্য প্রস্তুত করুক নিজেদের।

লেখক : শিক্ষক ও সংগঠক