হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ: কিছু প্রিয় কিছু অপ্রিয় কথা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

নভেম্বর ২৭ ২০২০, ২৩:৪২

হুসাইন আহমদ মিসবাহ: বাংলাদেশের বহুল পরিচিত ও সমাদৃত নাম “হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ”। সম্ভবত দেশের সর্ববৃহৎ ও সার্বজনীন মুসলিম দলের নাম ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’। আমাদের জানা ভুল না হলে, দেশে জাতীয় পর্যায়ে এটা একমাত্র প্লাটফর্ম, যেখানে দল-মত নির্বিশেষে সকল মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ। রাজনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, মাসলাকী, সকল প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে হেফাজত’র ব্যানারে সবাই এক কাতারে।

সেই হেফাজত নিয়ে অঘোচালো কিছু কথা বলতেই আজকের প্রয়াস। কথাগুলো কারো কাছে প্রিয় আবার কারো কাছে অপ্রিয় হতে পারে। যাদের কাছে অপ্রিয় বা অযৌক্তিক মনে হবে, তাদের থেকে গঠনমূলক সমালোচনা প্রত্যাশা করবো।

এক.

হেফাজতে ইসলামের সূসনা হয়েছিল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে আঞ্চলিক হিশেবে। ২০১৩ সালে ইসলাম বিদ্ধেষী ব্লগার ও ধর্ম বিদ্ধেষী নাস্তিকদের জন্য হেফাজতে ইসলাম “এদের বিচার ও সংসদে ‘ব্লাসফ্রেমী’ আইন প্রনয়ন” এর একদফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে। সময়ের পালস বুঝে কর্মসূচি ও নেতৃত্বে দেশের সর্বজন স্বীকৃত শীর্ষ আলেম আল্লামা শফি থাকায় দাবানলের মত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে হেফাজত। বিনা দাওয়াতে, বিনা গণ সংযোগে, স্বপ্রনোদিত ভাবে প্রায় সকল মুসলমানরা সম্পৃক্ত হয় হেফাজতের সাথে। নিমিষেই সারাদেশে বিস্তৃত, গ্রহণযোগ্য ও সার্বজনীন দলে পরিণত হয়।

দুই.

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ প্রথমে ইসলাম বিদ্ধেষী ব্লগার, ধর্ম বিদ্ধেষী নাস্তিকদের বিচার ও সংসদে ব্লাসফেমী আইন প্রণয়নের একদফা দাবী নিয়ে মাঠে নামলেও পরবর্তীতে হেফাজতের আভ্যন্তরিণ কিছু নেতাদের রাজনৈতিক যাতাকলে পিষ্ট হয়ে একদফা থেকে ১৩ দফা দাবীতে পরিণত হয়। বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্বিক বিবেচনায় হেফাজতের মৌলিক একদফা দাবী মেনে নেওয়াও চিন্তা করছিলেন। তখন ঐ রাজনৈতিক নেতারা ভাবেন, প্রধানমন্ত্রী দাবী মেনে নিলেই হেফাজত ঘরে ফিরে যাবে। অথচ রাজনৈতিক স্বার্থে হেফাজতকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত মাঠে রাখা প্রয়োজন। হয়তো হেফাজত দিয়েই সরকার পতন ঘটানো যাবে। তাই এমন কিছু দাবী যুক্ত করতে হবে, যেগুলো মেনে নেওয়া শেখ হাসিনা কেন, বাংলাদেশের কোন সরকারের জন্যই সম্ভব না হয়। সেই চিন্তা থেকেই আসে ১৩ দফা। ফলে যা হবার তাই হয়। ঘটে ৫মে ২০১৩ ট্রাজেডি। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, এসবের ব্যাপারে হেফাজতের মরহুম আমীর আল্লামা আহমদ শফি ও তৎকালিন মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী অবগত ছিলেন না।

তিন.

৫মে ২০১৩ ট্রাজেডির পর হেফাজত অনেকটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। একে একে উম্মুচিত হতে থাকে হেফাজতে ভেতরে ঘাপটিমেরে থাকা দালালদের মুখোশ। হেফাজত নিয়ে ব্যবসায়ীদের চেহারা। প্রকাশ হতে থাকে, কারা রাসুল সা. ও ইসলামের মহব্বতে হেফাজতে কাজ করেছেন, আর কারা নিজের আগের ঘোচাতে সিঁড়ি হিশেবে হেফাজতকে ব্যবহার করেছেন।

দীর্ঘদিন ভাল-মন্দের মিশ্রণে, স্বার্থ-নি:স্বার্থের দন্ধে অস্তিত্ব ঠিকিয়ে রেখছে হেফাজত। অবশেষে গত ১৫ নভেম্বর ২০২০ ইংরেজি তারখে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায় অনুষ্টিত শুরা অধিবেশনের মাধ্যমে হেফাজতের নতুন কমিটি হয়। শুরু হয় নবোদ্যোমে যাত্রা।

চার.

সম্প্রতি পূণর্গঠন হওয়া হেফাজতের নতুন কমিটি আগের থেকে অনেকটা সুসংহত, গতিশীল, হলেও এই কমিটির গঠন প্রক্রিয়ায় কিছু সিস্টেমলস করা হয়েছে। ফলে কেউ কেউ নব কমিটির দিকে আঙ্গুল তুলছেন। সিস্টেমলস এর মধ্যে হল-

প্রথমত, আগের কমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য অনেককে এই শুরা অধিবেশনে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। মুফতি ফয়জুল্লাহ, জুনায়েদ আল হাবিব, মাইনুদ্দিন রুহি, আনাস মাদানী, আবুল হাসানাত প্রমুখদের ব্যক্তিগত ভাবে আমি পছন্দ করিনা। তারা হেফাজতের মুল কমিটিতে থাকুক, সেটা আমি চাইনা। তাদেরকে মাইনাস করতে হবে বিধি মোতাবেক। শুরা সদস্য হিশেবে শুরা অধিবেশনে তাদেরকে দাওয়াত দেওয়া উচিৎ ছিল। তাদের অতীত কর্মের ফল সরূপ সম্মানিত শুরা সদস্যরাই তাদেরকে মাইনাস করতো। কিন্তু দাওয়াত না দেওয়ায়ই কমিটি প্রশ্নবিদ্ধ।

দ্বিতীয়ত, হেফাজত এখন আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠন নয়। এটা একটি সার্বজনীন জাতীয় সংগঠন। এমন একটি সংগঠনের শুরা অধিবেশনের স্থান দেশের একপ্রান্ত চট্টগ্রামে কেন? রাজধানীতে এই অধিবেশন করা যেতনা। রাজধানীতে করলে এর আবেদন কি আরো বিস্তৃত হতনা।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় ইসলামী রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্তা হেফাজতে আছে, শুধু শাসনতন্ত্র আন্দোলন নেই। শাসনতন্ত্রকে সম্পৃক্ত করার কি কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল?

না হলে কি নেওয়া যেতনা? শাসনতন্ত্র থাকলে হেফাজত কি আরো গতিশীল হতনা?

পাঁচ.

সম্প্রতি ২১ নভেম্বরে অনুষ্টিত সিলেটের হেফাজত প্রোগ্রাম নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। যার মূল বিষয় ছিল জেলার প্রোগ্রামে জেলা সভাপতির অনুপস্থিতি। জেলার প্রোগ্রামে কেন্দ্রীয় আমীর, নায়েবে আমীর, মহাসচিব উপস্থিত হলে শেষ পর্যন্ত জেলা আমীর প্রোগ্রামে আসেন নি। হেফাজতের সিলেট জেলা আমীর মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী হুজুর দা. বা. প্রোগ্রামের আগের রাতে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সমাবেশে না আসার যে কারণ ঘোষণা করেছিলেন, তার সারাংশ হলো, “সভাপতি হিশেবে উনাকে যতটুকু মূল্যায়ন করার নিয়ম ছিল, উনাকে ততটুকু মূল্যায়ন করা হয়নি! তাই তিনি পরের দিনের সমাবেশে যাবেন না”।

এখানে প্রথম কথা হলো, উনাকে কেন মূল্যায়ন করা হল না? সভাপতি বহাল থাকাবস্থায় উনাকে অবমূল্যায়ন করা, অবজ্ঞা করা, উনার যৌক্তিক দিক নির্দেশনা না মানা, সর্ব বিষয় উনাকে অবহিত করে অনুমোদন না নেওয়া, কোনটিই ঠিক নয়। যৌক্তিক কোন কারণে সভাপতিকে অবমূল্যায়ন করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে হয় উনাকে অপসারণ করতে হবে নতুবা ব্যাপারটি স্পষ্ট করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, গাছবাড়ী হুজুরের মত একজন বড় মাপের আলিম, যিনি নিজের মূল্যায়ন না পাওয়ার রাসুল সা. এর মুহাব্বাতের সমাবেশ বর্জন করেছেন!। যেখানে দেশের শীর্ষ আলেমরা উপস্থিত হবেন, নবী সা. এর ভালবাসায় ঈমানী দায়িত্ব পালন করবেন, এমন সমাবেশে নিজের অবমূল্যায়নের কারণে গাছবাড়ী হুজুরের মত শীর্ষ আলিম যাননি! বিষয়টি হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। হুজুর কি নিজের মূল্যায়ন অবমূল্যায়নের উপর রাসুল সা. এর ভালবাসার প্রাধান্য দিতে পারলেন না! নিজের ও নিজের পদের মর্যাদার উপর রাসুল সা. এর ভালবাসাকে স্থান দিতে পারলেন না!। গাছবাড়ী হুজুর চাইলে, রাসুল সা. এর মুহাব্বাতে ঈমানী দায়িত্ব হিশেবে সব কিছুকে সাময়িক ভাবে পিছনে ফেলে সমাবেশে উপস্থিত হয়ে, সমাবেশ পরে যারা উনাকে অবমূল্যায়ন করেছে, তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারতেন! বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাতে পারতেন!। এরকম করলে আর কেউ হুজুরের দিকে আঙ্গুল তুলতে পারতোনা।

ছয়.

হেফাজত নিয়ে সিলেট যা হচ্ছে, সেটাও কাম্য নয়। গত ৪ নভেম্বর সিলেটে গাছবাড়ী হুজুরের আহবানে বিশ্বনবী সা. এর অবমাননার প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। কথাহল, হুজুর হেফাজতের সিলেট জেলা সভাপতি থাকার পরও কেন নিজের একক আহবানে সমাবেশ করলেন? সেটা কি হেফাজতের ব্যানারে করা যেতনা?

সত্যমিথ্যা জানানেই, শুনেছি ঐ সমাবেশ প্রথমে “সমমনা ইসলামি দল” বা এ জাতীয় কোন ব্যানারে হবার কথা ছিল। পরবর্তীতে নাকি হুজুরের একক উদ্যোগে সমাবেশ করার ‘ইলহাম’ হয়েছে! এসব কি খুব জরুরি ছিল?

তারপর সিলেট জেলা হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা জিয়া উদ্দিন দা. বা. কে প্রধান অতিথি ও নায়বে আমীর মাওলানা মজদুদ্দিন আহমদ দা. বা. সভাপতি করে ১২ নভেম্বর হেফাজতের সমাবেশ ঘোষণা করা হয়। তারপর সিলেট জেলা আমীর ও মহাসচিব কর্তৃক যৌথ ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ১২ নভেম্বরের তারিখ বাতিল করে ১৪ নভেম্বর সমাবেশের তারিখ ঘোষণা হয়। সবশেষে ১৪ নভেম্বরও বাতিল করে ৪ জনের আহবানে ২১ নভেম্বরে সমাবেশ ঘোষণা করা হয় এবং সেই সমাবেশে ৪ জনের প্রথমজন জেলা আমীরের অনুপস্থিতি!

এসব কি ভাল লক্ষণ? এই অরাজনৈতিক সংগঠন নিয়ে কেন এত রাজনীতি?

সাত.

“ইখতেলাফুল উলামাউ রাহমাতুন” যত্রতত্র আমরা এর ব্যবহারে ইতিমধ্যেই বেশ পারদর্শীতা দেখিয়েছি। ভবিষ্যতে ‘ইখতেলাফে’ কোন পুরস্কার ধার্য্য করে হলে, সেটা আমরাই পাবো, নিশ্চিত। যদিও উল্লেখিত আরবী বাক্যটি ‘মাসআল-মাসাইল’ বের করা সংক্রান্ত ‘ইখতেলাফের’ প্রশঙ্গেই বলা হয়েছে।

রাজনৈতিক ভাবে, মাসলাকী ভাবে, আধ্যাত্মিক ভাবে, তথা বিভিন্ন ভাবে আমরা আজ দিধাবিভক্ত। ‘হেফাজত’ নামক এই প্লাটফরমটিকে কি এসবের উর্ধ্বে রাখতে পারিনা? একটি জায়গা কি এমন রাখা যায়না, যেখানে আমরা সব মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে উম্মতে মুহাম্মাদী হিশেবে একত্রিত হবো! সর্বত্র আমরা পদ, মর্যাদা, অবস্থান, যোগ্যতা, স্বার্থের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে, দ্বীনের বৃহৎ স্বার্থে ঐক্যের জন্যে শুধু ‘হেফাজত’ এর প্লাটফরমে কি আমরা এসব হিসেব-নিকেস পরিহার করতে পারিনা?

আমারতো মনে হয়, হেফাজতের এই ব্যানারে যদি আমরা এক হতে না পারি, তাহলে আল্লাহর বিশেষ ফায়সালা ব্যতিত ভবিষ্যতে আমরা কোন দিন আর এক হতে পারবোনা। আল্লাহ আমাদেকে বুঝার তাওফিক দিন।