হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও একটি আত্মস্মৃতি

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ১৭ ২০১৯, ২০:৩৫

তাওহীদুল ইসলাম

ক’দিন আগে শুধু বাংলাদেশের রাজনীতি অঙ্গন থেকেই নয় বরং নশ্বর এই পৃথিবী থেকেই চিরতরে বিদায় নিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব এইচ এম এরশাদ সাহেব৷ তিনি দেশের জন্য, মানুষের জন্য, মানবতার জন্য, ইসলামের জন্য অনেক কিছুই করে গিয়েছেন৷ তিনি তার সেই কীর্তিমান অবদানগুলোর মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে৷ আল্লাহ তাকে ওপারে ভাল রাখুক৷ তাকে জান্নাত বাসী করুক৷ আমিন৷

ভাল মন্দ মিলেই মানুষ৷ সাবেক এই প্রেসিডেন্টের বিশেষ একটি গুণ ছিলো তিনি ইসলামকে ভালবাসতেন, আলেমদের যথেষ্ট মর্যাদার পাত্র হিসেবে দেখতেন৷ দেশের বিখ্যাত আলেমদের কাছে যেতেন৷ তাদের কাছে থেকে দোয়া নিতেন৷ যে কোন উদ্দেশ্যেই হোক হক্কানী আলেমদের দরবারে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের আগমন কিছু ভাল দিক রয়েছে৷

আজ থেকে ১৪ বছর আগেকার একটি স্মৃতি৷ ২০০৬ সাল৷ তখন আমি উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন কাসেমুল উলূম( জামিল মাদ্রাসা)৷ জামিল মাদ্রাসার তৎকালীন মুহতামিম ছিলেন মাওলানা ইউসুফ নিজামী (রহ.)৷ তার দেশের সব শ্রেণীর মানুষ তার কাছে আসতো সাক্ষাৎ করতে, দোয়া নিতে, তাঁর পরশে কিছু প্রশান্তির সময় কাটানোর জন্য৷

তখন আমি বগুড়ার মিজান জামাতের একজন ছাত্র৷ কওমি শিক্ষা বছর শেষের দিকে। উত্তরবঙ্গের কওমি শিক্ষা বোর্ড তানযীমুল মাদারিসের পরীক্ষা মাথার উপর৷

এমন সময় কোন একদিন দুপুরের পর মাওলানা ইউসুফ নিজামী (রহ.) এর সাথে সাক্ষাৎ করতে, দোয়া নিতে হঠাৎ আগমন করলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ৷ শেষ জীবনের তুলনায় রাজনীতির ময়দানে তখন তার প্রভাব ছিল অনেকগুণ বেশি৷

প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গদেরকে স্বচোখে দেখা, তাদের সাথে সাক্ষাত করা এটা কম বেশি সব মানুষেরই একধরণের ঝোঁক থাকে৷ ছোটদের মাঝে এই প্রবণতা আরো বেশি থাকে। এইচ এম এরশাদ সাহেবের আগমনের খবর শুনে গোটা মাদ্রাসার সব ছাত্ররা ছুটে গেল তাকে একনজর দেখার জন্য৷ ছাত্রদের ছুটাছুটির আওয়ায শুনে একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে? সে উত্তর দিলো আরে জানেন না! এরশাদ চাচা এসেছে। চলেন যাই দেখে আসি৷ বললাম, আপনি যান আমার পড়া আছে৷

তখন আমার ইমাম মালেক ( রহ.) একজন ছাত্রের ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া আল-লাইছী, আল-আন্দালুসী( ১৫২-২৩৪ হি. ) এর একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। একদিন তিনি ইমাম মালেক ( রহ.) মসজিদে নববীতে হাদিসের দরস প্রদান করছিলেন ৷ হঠাৎ মদিনাতে এক বিশাল আকৃতির হাতির আগমন ঘটল। আমি আরবের মরু এলাকায় হাতি পাওয়া যেতো না৷ তাই মদিনাবাসী হাতি নামক এমন বিশাল আকৃতির জন্তুর সাথে পরিচিত ছিল না৷ এমন অদ্ভুত প্রাণী কখনো তারা দেখেওনি৷ এক নজর হাতি দেখার জন্য মদিনার লোকজন উৎসুক হয়ে ভেঙ্গে পরলো৷ ইমাম মালিক ( রহ.) দরস থেকে ছাত্ররা হাতি দেখতে ছুটে গেল ৷ বাকী রইল ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া৷ তিনি একাই ইমাম মালিক ( রহ.) এর নিকট বসে রইলেন ৷ তখন ইমাম মালেক ( রহ.) জিজ্ঞাসা তাকে করলেন ইয়াহইয়া! তুমি হাতি দেখতে যাবে না ৷ তখন প্রতি উত্তরে ইয়াহইয়া আন্দালুসী ( রহ.) বললেন, আমি আন্দালুস থেকে মাদিনাতে হাতি দেখতে আসেনি ৷ আমি ইমাম মালেককে দেখতে এসেছি৷ ইমাম মালিক ( রহ.) এর অসংখ্য ছাত্রদের মাঝে পরবর্তিতে তার রেওয়াআতকৃত মুয়াত্তা মালিক সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে৷

ওই সময় হঠাৎ এই ঘটনাটি স্মরণ হলো আর মনে মনে ভাবলাম ইমাম ইয়াহইয়া আন্দালুসী যদি ইলমের মুহাব্বতে হাতির দর্শন ছেড়ে ইমাম মালিক (রহ.) এর নিকট বসে থাকতে পারেন তাহলে আমি কেন ইলমের মুহাব্বতে একজন ব্যক্তির চেহারা দেখা বাদ দিয়ে ইলমে দ্বীন শিক্ষায় মগ্ন থাকতে পারবো না? তখন সাবেক প্রেসিডেন্টকে দেখার বিন্দু পরিমাণ আগ্রহ আর জাগল না৷ আমার কাছে আমার পড়াশোনাই সাবেক এই প্রেসিডেন্টের দর্শন থেকে অনেক বড় কিছুই মনে হলো৷

এসব কথা চিন্তা করতে করতে আবার পড়া শুরু করলাম ৷ তবে তখন মনে মনে একটি দোয়া করে আবার পড়ার দিকে নিবিষ্ট হলাম ৷ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার নিজ শান অনুযায়ী আমার এই ছোট্ট কাজের উত্তম প্রতিদান দান কামনা করি৷

পরীক্ষা শেষে রমজানে যখন ফলাফল প্রকাশ হলো। তখন জানতে পারলাম আল্লাহ তাআলা আমাকে তানযীমুল মাদারিসে মিজান জামাতের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সকল ছাত্রদের মাঝে পরিক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করার তাওফিক দিয়েছেন৷

তখন সেই ঘটনাটি মনে পড়লো আর ভাবলাম হয়তো এটা ছিল আমার রবের পক্ষ হতে একটা উপস্থিত পুরস্কার৷ তার কাছে আরো বড় কিছুর আশা রাখি৷ তিনিই সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদানকারী৷

 

মাদীনাতু নাসর, কায়রো থেকে…