হিজরি সনের ইতিহাস

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ১৮ ২০১৮, ১৫:৩৩

আহমদ যাকারিয়া: মানুষ তার জীবনের স্মৃতিময় দিনগুলোকে স্মৃতি হিসেবে পালন করার জন্য বিভিন্নভাবে দিন, মাস ও সময় গণনা করে থাকে। চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমে সন-তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। হিজরি সন প্রবর্তনের পূর্বে আরবরা তাদের বিভিন্ন স্মরণীয় ঘটনার উপর নির্ভর করে দিন গণনা করতো।

যেমন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের প্রায় ৪০ দিন পূর্বে সংঘটিত আবরাহা বাদশাহ কর্তৃক কা’বা ঘর ধ্বংস করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা দিন গণনা করত। এই গণনার জন্য হিজরি সন অন্যতম ইসলামী পদ্ধতি।

হযরত উমর রাঃ এর যুগে একটি নির্দিষ্ট তারিখ হিসেব করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে হযরত আলী রাঃ সহ বিভিন্ন সাহাবীদের পরামর্শে একটি নির্দিষ্ট সন গণনার পরামর্শ চলে। এতে কেউ রাসূল সাঃ এর জন্ম থেকে সাল গণনা করার কথা বলেন, কেউ বা তার উপর ওহী আসার দিন থেকে, কেউ আবার তার মৃত্যুর দিন থেকে সাল গণনা করার অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু হযরত উমর রাঃ রাসূল সঃ এর হিজরতের ঘটনা থেকে সাল গণনার প্রস্তাব উত্থাপন করেন, এতে সকল সাহাবী ঐকমত্যপোষণ করেন। কেননা, হিজরত সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করেছিল।

‘আল-উকদুদ দিরায়া’ নামক গ্রন্থে রয়েছে- ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর লাঃ শাসনামলে উমর রাঃ এর নিকট একটি চুক্তিপত্র উপস্থিত করা হলো। সেখানে শা’বান মাসের কথা উল্লেখ ছিল। তখন উমর রাঃ বললেন, এটা কি গত শা’বান না আগামী শা’বান মাস? অতঃপর তিনি তারিখ গণনার নির্দেশ প্রদান করলেন এবং রাসূল সাঃ এর মদীনায় হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরী সন গণনার সূচনা করেন। আর মহররম মাসকে প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়। রাসূল সাঃ হিজরত করেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই। সেই দিনকে মহররম মাসের শুক্রবার হিসেবে ধরে হিজরি সাল গণনা শুরু হয়। উক্ত হিজরি হিসেবের প্রথম প্রয়োগ ঘটে হযরত উমর রাঃ শাসনামলের ৩০ জমাদিউল উখরা- ১৭ হিজরি অর্থাৎ ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় আজও হিজরি সন চলে আসছে। হিজরি সন গণনার আগে আরবরা আরবী মাসসমূহকে ব্যবহার করতো। অন্যান্য সব সনের মতো হিজরি সনেরও ১২টি মাস। কেননা, আল্লাহর কাছেও ১২ মাসে এক বছর। মহানবী সাঃ যখন হিজরত করেন তখন ছিল রবিউল আউয়াল মাস। প্রশ্ন দেখা দেয় যে, তাহলে বছর শুরু ঐ মাসে না হয়ে মহররম মাসে হলো কিভাবে? মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনার মাস বারোটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। কাজেই এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।” (সূরা তাওবাহ; আয়াত-৩৬)

এ আয়াতে চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনটি মাস হলো জিলক্বদ, জিলহজ্ব ও মহররম এবং অপরটি হলো রজব। (তাফসীরে ইবনে কাসির)

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মাসের যে ধারাবাহিকতা ইসলামী শরীয়তে প্রচলিত রয়েছে, তা মানব রচিত নয়; বরং মহান রাব্বুল আলামীন যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিনই মাসের তারতীব ও বিশেষ মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুম-আহকাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ আয়াত দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে শরীয়তের আহকামের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসই নির্ভরযোগ্য। চন্দ্র মাসের হিসাব মতেই রোজা, হজ ও যাকাত প্রভৃতি আদায় করতে হয়। তবে কোরআন মজীদ চন্দ্রকে যেমন, তেমনি সূর্যকেও সাল তারিখ ঠিক করার মানদন্ডরূপে অভিহিত করেছে। সুতরাং চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমেই সাল-তারিখ নির্দিষ্ট করা জায়েজ। তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর নিকট অধিকতর পছন্দনীয়। তাই শরীয়তের বিধি-বিধানকে চন্দ্রের সাথে সংশ্লিষ্ট রেখেছেন। এজন্য চন্দ্র বছরের হিসাব সংরক্ষণ করা ফরযে কিফায়া। সকল উম্মত এ হিসাব ভুলে গেলে সবাই গোনাহগার হিসেবে গণ্য হবে। চাঁদের হিসাব ঠিক রেখে অন্যান্য সূত্রে হিসাব ব্যবহার করা জায়েয আছে। এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইমাম বাগাভী রহঃ তার অমর গ্রন্থ তাফসীরে বাগাভীতে উল্লেখ করেছেন- বারো মাস হলো, মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস ছানী, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানী, রজব, শা’বান, রমজান, শাওয়াল, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব। আর হারাম বা সম্মানিত চারটি মাস হলো- মহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব।

 

হিজরি সনের গুরুত্ব।

 

মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী- “লোকেরা আপনাকে নবচন্দ্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন, তা হলো মানুষের এবং হজের জন্য সময় নির্ধারণকারী”। (সূরা-বাকারা; আয়াত-১৮৯) এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা’য়ালা বান্দাদের হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে পঞ্জিকা স্বরূপ চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন। এজন্য চন্দ্র মাস তথা হিজরী সনের গুরুত্ব অপরিসীম।

মহান আল্লাহ চন্দ্র মাস সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেন- “আমি রাত ও দিনকে করেছি দুটি নিদর্শন, রাত্রির নিদর্শনকে অপসারিত করেছি এবং দিনের নিদর্শনকে আলোকোজ্জ্বল করেছি; যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে সক্ষম হও এবং রাতে তোমরা বর্ষ-সংখ্যাও হিসাব করতে পার এবং আমি সবকিছু বিশদভাবে বর্ণনা করছি”। এ আয়াত থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, আল্লাহ তা’য়ালা অনুগ্রহ স্বরূপ তাঁর বান্দাদের সাল গণনা ও অন্যান্য হিসাব-নিকাশের জন্য দিন-রাতকে সৃষ্টি করেছেন।

হিজরি সাল গণনা করা হয় রাসূল সাঃ এর হিজরতের সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তাই হিজরি সন ব্যবহার ও গণনার ফলে রাসূল সাঃ ও আবু বকর রাঃ সেই হিজরতের ঘটনা মুসলিম হৃদয়ে বার বার দোলা দেয়।

হিজরি সন অনুসরণ করার মধ্যে আমাদের যেসব ফায়দা নিহিত রয়েছে তার মধ্যে উল্খেযোগ্য কয়েকটি হলো-

ইবাদত-বন্দেগী আদায়—

ইসলামের অধিকাংশ ইবাদত-বন্দেগী যেমন: রোজা, হজ, কোরবানি, শবে-কদর, শবে বরাত, আশুরা ইত্যাদি ইবাদত হিজরি সনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফলে হিজরী সনের ব্যবহারের মাধ্যমে সঠিক সময়ে ইবাদত বন্দেগী পালন করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন লাভ করা সম্ভব হয়। এজন্য হিজরী সন তথা চন্দ্র মাস গণনাকে ফরযে কেফায়া হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যদি উম্মতের একজনও এর ব্যবহার না করে তাহলে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ গোনাহগার হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

খোলাফায়ে রাশেদার অনুকরণ—

হিজরি সন হলো হযরত উমর রাঃ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত একটি সুন্নাত। আর রাসূল সাঃ তাঁর এবং তাঁর খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরার জন্য আদেশ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন- “তোমাদের উচিত আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা”। ( মুশকিলুল আসার লিত তহাবী, হাদীস-৯৯৮)

মুসলিম ঐতিহ্যের অনুকরণ—

হিজরী সন গণনা করা ইসলামী সংস্কৃতির অনুসরণ। এজন্য চন্দ্র মাস হিসেবে হিজরী সন গণনা করা মুসলমানদের জন্য কর্তব্য।

ইহুদী ও নাসারাদের বিরোধিতা—

হিজরী সন ইসলামী ঐতিহ্যের বাস্তব নমুনা। যা অন্যান্য জাতির ঐতিহ্যের বিরোধিতা করতে শেখায়, শেখায় নিজ ঐতিহ্যকে অনুসরণ, অনুকরণ করতে। কেননা রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন- “সেই লোক আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে অন্যান্য জাতির সাথে সাদৃশ্যতা বজায় রাখে। তোমরা ইহুদী অথবা নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য রাখবে না”।(জামে তিরমিযি, হাদীস-২৮৯৫)

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ‘চন্দ্র মাস গণনা তথা হিজরি সন গণনা করা আল্লাহর বিধান ও মুসলিম ঐতিহ্য অনুসরণ। কাজেই একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ইংরেজি সনের পাশাপাশি হিজরি সনের অনুসরণ করা অপরিহার্য।

আহমদ যাকারিয়া, প্রাবন্ধিক।