হালুয়াঘাট-ঢাকার প্রধান সড়কে এখনও চলে মালবাহী ঘোড়ার গাড়ি

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ১৯ ২০১৯, ২২:৩৯

ইলিয়াস সারোয়ার:
ঢাকা-হালুয়াঘাট প্রধান সড়ক। পিচঢালা এ সড়কে প্রতিদিন চলে ছোট-বড় হাজার হাজার গাড়ি। ট্রাক, বাস, পিকআপ, মাহিন্দ্র, সিএনজিসহ সব ধরণের গাড়ির ভারে সবসময় ব্যস্ত এ সড়ক। এমন ব্যস্ত সড়কে চলার পথে হঠাৎ যদি দেখেন- সড়কটির একপাশ ধরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছে আট-দশটি ঘোড়ার গাড়ি, কেমন অনুভূতি হবে তখন? মনে নিশ্চয়ই অন্যরকম অনুভূতি জেগে উঠবে, তাই না?

হ্যাঁ, এমনই অনুভূতি হয়েছিল আমারও। সেদিন হালুয়াঘাট থেকে মাহিন্দ্র যোগে যাচ্ছিলাম ধারা বাজারের দিকে। মাঝপথেই নজর কাড়লো মালবোঝাই ঘোড়ার গাড়ির বিশাল লাইন। ইতিপূর্বেও এ পথে ঘোড়ার গাড়ি চলতে দেখেছি। তবে এত বিশাল লাইন ছিল না। ছিল একটি কিংবা দুটি ঘোড়ার গাড়ি। তবে তখনও মনে মনে এর ছবি তোলা আর ফিচার লেখার আগ্রহ ছিল বেশ। কিন্তু আজ! আজ পুরো ৭টি ঘোড়ার গাড়ি এগিয়ে চলেছে এক লাইনে! কী সুন্দর দৃশ্য!

গন্তব্যের আরও কিছু পথ বাকি। তবু নেমে গেলাম। এগিয়ে গিয়ে ঘোড়া চালককে পরিচয় দিয়ে আমার উদ্দেশ্যের কথা জানালাম। তিনি থামলেন। পেছনের দুটি গাড়িকেও থামতে বললেন। অন্য গাড়িগুলো একটু পিছিয়ে পড়েছিল। দেরি না করে এই তিনটিরই ছবি নিলাম। এরপর পেছনেরগুলো আসার অপেক্ষা। এরই মধ্যে জানতে চাইলাম-
: আপনার নাম?
: জবেদ আলী।
: আপনার এই ঘোড়াটির দাম কত?
: ২৫ হাজার টাকা।
: এখানে কত মন ধান তুলেছেন?
: এগারো মন।
: মন প্রতি ভাড়া কত পান?
: ৫০/৬০ টাকা।

আমরা কথা বলছিলাম। কিন্তু পেছনের গাড়ির মালিক এক বুড়ো চাচা। তার আর তর সইছিল না। তারা রওনা করে দিলেন বাজারের দিকে। হাঁটতে হাঁটতেই জিজ্ঞেস করলাম-
: চাচা! আপনার গাড়িতে তো দেখছি ধান অনেক বেশি! কয় মন তুলেছেন?
: ১৬ মন।
: ভাড়া কত ফুরিয়েছেন?
: মনে ৬০ টাকা।
: তার মানে ৯৬০ টাকা ভাড়া পাচ্ছেন একবারে। ভালোই। তা ঘোড়ার পেছনে দৈনিক খরচ কত?
: ১শ টাকার মতো।
: কী খাওয়ান?
: কুড়া, ভূষি।
: ঘোড়াসহ গাড়ি কত দিয়ে কিনেছিলেন?
: ৪০ হাজার।
: মাশাআল্লাহ। মুরুব্বী! আপনার নাম?
: জয়নাল অাবেদীন।

এরপর চালক আল-আমীনের সঙ্গেও কথা বললাম-
: আপনার ঘোড়ার দাম কত?
: সাড়ে ১৫ হাজার টাকা।
: গাড়ি কি আলাদা বানাতে হয়েছে?
: হ্যাঁ।
: খরচ কত পড়েছে?
: সাড়ে ৫ হাজার টাকা।
: কত মন ধান তুলেছেন?
: নয় মন।
: ভাড়া?
: ৬০ টাকা করে।
: ধানগুলো সব এক মালিকের?
: প্রত্যেক গাড়ির ধান ভিন্ন ভিন্ন মালিকের।

অল্পক্ষণের মধ্যেই পেছনে পড়া গাড়িগুলো এসে পৌঁছেছে। সেগুলোকেও দাঁড় করালাম আমরা। আমরা মানে আমি আর আমার বয়সী সেই ঘোড়া চালক জবেদ আলী। যাক, ওদেরকে বেশি অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না। আগে আগে গিয়ে ধান বিক্রি করতে হবে ওদের। দ্রুত রাস্তার অপর প্রান্তে গিয়ে কয়েকটি ছবি নিলাম। এরপর ওদের সঙ্গেই হেঁটে হেঁটে ধারা বাজারের দিকে রওনা। জমে উঠল আলাপও।

ঘোড়ার গাড়িগুলো সব কৈচাপুর গ্রামের। কাঁচা মেঠো পথ। একটু বৃষ্টি হলেই হয়ে যায় দুর্গম। কাঁদা মাটিতে আটকে যায় পা। আটকে যায় চাকা। ইঞ্জিন চালিত কোন যানবাহনে করে মনে মনে ধান নিয়ে বাজারে বিক্রি করতে যাওয়া তখন একরকম অসম্ভব কল্পনা। তবে এই অসম্ভবই সম্ভব করে তোলে এই দুরন্ত ঘোড়াগুলো।

এদের দামও খুব বেশি না। ১৫ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার পর্যন্ত। ঘোড়ার জাত ভেদে দামের কম বেশি হয়। পুরুষ ও স্ত্রী উভয় লিঙ্গের ঘোড়া দিয়েই কাজ চলে প্রায় সমান তালে। দৈনিক ১শ টাকার মত খাবার খেলেও উপার্জন করতে পারে ৮ থেকে ৯ শত টাকা। আর এলাকায় ঘাস থাকলে তো কথাই নেই। খরচ একেবারেই কমে যাবে।

দৈনিক একবারই এরা ভাড়া মারতে পারে। গাড়িতে মাল চড়িয়ে দুর্গম কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে সাত-আট কিলোমিটার দূরের এই বাজারে আসে এরা। মাল বোঝাই করার পর এরা অন্তত কয়েকজন একসঙ্গে আসে। কাদায় আটকে গেলে যেন একে অপরে সহযোগিতা করতে পারে। ঘোড়াগুলোর খাটনিও হয় ভীষণ রকমের। যে করেই হোক হাড়খাটুনি খাটিয়েই ছাড়ে চাবুক হাতে বসে থাকা এই চালকেরা। এত পরিশ্রম করে এত দূর পথ আসার পরে ঘোড়াগুলোকে বিশ্রাম দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।

ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট উপজেলাধীন কৈচাপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের কাঁচা রাস্তার কল্যাণে ঢাকা-হালুয়াঘাটের প্রধান সড়কে আজও দেখা মিলছে ঘোড়ার গাড়ির৷ তবে সেদিন বেশি দূরে নয়, পিচঢালা সড়ক আর ইঞ্জিন চালিত গাড়ির ভিড়ে হালুয়াঘাটের ঐতিহ্য এই ঘোড়ার গাড়িগুলোও হারিয়ে যাবে একদিন।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, একুশে জার্নাল