‘স্মৃতির ক্যানভাসে উস্তাদ আল্লামা আবুল কালাম যাকারিয়া’

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ১৪ ২০১৯, ১১:৪৬

জুনাইদ কিয়ামপুরি::  সত্যি হৃদয় ভেঙ্গে কান্না আসছে। নীরবে অশ্রু ঝরছে। স্মৃতির পৃষ্ঠা নাড়ছি আর ভাবছি, মনের অজান্তেই জমা হয়ে আছে এক বিশাল বিস্তৃত নীরব ইতিহাস। আমি আমার এ-ক্ষুদ্র জীবনে এমন ক্ষুরধার, প্রখর মেধাদীপ্ত আলিম খুব কম পেয়েছি। কোথায় নেই হুজুর! কোন শাস্ত্রে আমার এ-উস্তাদের দুর্বলতা!
সরফ বলেন, নাহু বলেন, বালাগত বলেন, হাদিস বলেন, ফেক্বাহ বলেন, তাফসির বলেন আদব বলেন, ইলমের সকল শাখায় সকল ক্ষেত্রে হুজুরের দর্পিত বিচরণ ছিল। ছাত্রকালীন দারসী ইস্তেফাদার কথা বলছি না। বিভিন্ন সময় বিভিন প্রেক্ষাপটে হুজুরের মাজলিসে বসে, এটা ওটা জিজ্ঞেস করে যা জেনেছি, তা লিখলে বিশাল এক পুস্তক হয়ে যাবে।

ওয়াল্লাহ! উস্তাদজি যখন কথা বলতেন, কিংবা কোনো কিতাবের হাওয়ালা দিয়ে এশকালের হাল করে দিতেন, মনে হতো, বোধয় এই বিষয়টা একমাত্র হুজুর ছাড়া আর কারো পক্ষেই সমাধান দেয়া সম্ভব হতো না! ইলমি বিষয়ে হুজুর জামেয়ার প্রায় সকল উস্তাদের একমাত্র আশ্র‍য় ছিলেন। এই কয়েক দিন আগে হঠাৎ মন চাইল, হুজুরের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে যে দুর্লভ তথ্য পেয়েছি তা একত্র করে রাখলে হুজুরের মৃত্যুর পর কাজ দিবে। ভেতর থেকে একটা স্প্রীট অনুভব করলাম। উপস্থিত যা মনে আসল লিখে নিলাম। কিছু- কিছু জ্ঞানমুদ্রা পড়ে থাকল স্মৃতিভাণ্ডারে। তখন ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি, ইলমের এই বহতা নদি কয়েক দিন পরেই যে- আমাদের থেকে চিরতরে আড়াল হয়ে যাচ্ছেন!

কী বলব? হুজুর এতোই মুখলিস ছিলেন যে, মাত্র কয়েক লক্ষ টাকা জমা হতেই হুজুর প্রকাশ্যে বলতে লাগলেন আমার উপর হজ্ব ফরজ হয়ে গেছে।
হুজুর হজ্বে গেলেন, আসার পর হুজুরের সার্বিক অবস্থা জানতে গেলে হেসে -হেসে বললেন, “আর কোনো টাকা নাইবা আমার কাছে ‘ সব শেষ অইগেছে।” বললাম হুজুর কিছু টাকা তো সঞ্চয় রাখতে হয়, নাইলে চলা যায় ক্যামনে? বললেন ” আল্লায় চালাইব ইনশাআল্লাহ!”
তাওয়াক্কুল ছিল, সবর ছিল, ইলম ছিল, হিলম ছিল, মুরওত ছিল, শরাফত ছিল, আমানত ছিল, দিয়ানত ছিল, ছিল কল্যাণকামী মনোবৃত্তি। ভাবতেই পারিনি, এতো তাড়াতাড়ি লিখতে হবে তাঁর ইতিবৃত্তি!

হে খোদা! হে মাওলা!
তাঁর সমাধি সজীব রাখো অফুরান রহমত বর্ষণে। জান্নাতের মহা- উদ্যানে রাখো তাঁকে অতি সংযতনে।প্রিয় উস্তাদ মুফতি মাওলানা আবুল কালাম জাকারিয়া রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন জামেয়ার শ্রেষ্ঠ সন্তান। ছিলেন আমাদের অহংকার। “বাহরুল উলূম ওয়াল ফুনুন ”
“জামেয়ুল মাকুল ওয়াল মানকুল ” এই শব্দগুলোর আকছার ব্যবহার পাওয়া যায় আসলাফের ক্ষেত্রে। এই উপমহাদেশের অনেক বরেণ্য আলিমদের এই অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে। বর্তমান যুগে কার শানে এই শব্দগুলোর যথার্থ প্রয়োগ হবে, বিস্তর চিন্তা করতে হতো। কারণ, শব্দকে যথার্থ স্থানে প্রয়োগ না করলে শব্দের প্রতি অবিচার করা হয়। কিন্তু উস্তাদে মুহতারাম মুফতি আবুল কালাম জাকারিয়া সাহেব কোনো মাহফিলে উপস্থিত থাকলে এই শব্দগুলো ব্যবহার কর‍তে কোনো চিন্তা করতে হতো না। বুক ফুলিয়ে তাঁর নামের প্রথমে – বাহরুল উলূম ওয়াল ফুনুন ” কিংবা “জামেয়ুল মাকুল ওয়াল মানকুল ” অভিধাটি ব্যবহার করা যেতো।

হজরতের তিরোধানে ইলমি দুনিয়ায় কী শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা আমার মতো ‘শূন্য পাতিল ‘ কিছু বুঝবে না। এই উর্ধ্বের আকাশটা যাদের মাথায় এসে ঠেকে গেছে, তারাই বুঝতে পারবেন মুফতি আবুল কালাম জাকারিয়া কোন রত্নমাণিক্যের নাম। প্রিয় উস্তাদের সঙ্গে অনেক অনেক জায়গায় সফরে গিয়েছি। কতো বিখ্যাত প্রখ্যাত আলিমদের মজলিসে উপস্থিত হয়েছি, তাঁদের পারস্পরিক ইলমি কথাবার্তা শুনেছি, আমি দেখেছি আমার উস্তাদ যেখানে গেছেন সেখানেই তিনি ইলমের বরপুত্র হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন।
তাঁর উস্তাদরা পর্যন্ত তাঁর কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করতেন। আমাদের জামেয়ার বিশাল কুতুবখানার সম্ভবত এমন কোনো কিতাব নেই; যা তাঁর অধ্যয়নে আসেনি। যদি থাকে, তবে এর সংখ্যা খুবি কম। বরং পুরনো আকছার কিতাবের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় তাঁর ছোট- ছোট মন্তব্য, টিকাভাষ্য পাওয়া যায়।

এই শেষ কয়েক বছর উস্তাদ রহ. এর প্রোগ্রাম বিদ্যুৎ গতিতে বাড়তে থাকে। প্রতিদিন ৪/৫ টা প্রোগ্রামের সিডিউল তাঁর পঞ্জিকায় লিপিবদ্ধ থাকত। প্রোগ্রাম না থাকলেও মানুষের ভীড় লেগেই থাকত। একদিন কথাচ্ছলে বলেন, ” ওবা এগুলো হচ্ছে মুতালার বরকত”।
এতো ব্যস্ততার মধ্যেও উস্তাদ রহ. পারতপক্ষে দারস মিস করতেন না। নিয়মিত ক্লাশ করতেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সকালে এবং দুপুরে মোট দুইবার হাদিসের দরস দিয়েছেন। দারস দিয়েছেন দারুল ইফতার ছাত্রদেরকেও। এমন কি তাদের তৈরীকৃত ফতোয়াগুলো গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে প্রয়োজনীয় সংশোধনী দিয়েছেন।

বাদ আসর ডাকা হয়েছিল আসাতেযায়ে কেরামের বৈঠক। বছর শেষ হিসেবে প্রতি বছরই এভাবে বৈঠক হয়। কিন্তু কে জানত তিনি যে আর এই মাজলিসে উপস্থিত হবেন না, তিনি চলে যাবেন জান্নাতি সেই মাজলিসে,যেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন আরিফ বিল্লাহ ইমাম আকবর আলী রহ.,খতিব মাওলানা উবায়দুল হক রহ, মুফতি রহমতুল্লাহ রহ. মুফতি আব্দুল হান্নান রহ. মাওলানা সিরাজুদ্দীন (বড়দেশি) রহ. সহ আমাদের প্রয়াত আসাতেযায়ে কেরাম।
আলিয়া মাঠে আজকের জানাযা ছিল মনে রাখার মতো! যে দিকে চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ! নীরবে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছিল মানুষ! আকাশে বাতাসে বেজে উঠেছিল বেদনার বিউগল। বিচ্ছেদের করুণ সানাই। একজন মানুষ এতো এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠলেন! দল মত নির্বেশেষে সবার মধ্যেই হাহাকার! কবি সত্যই বলেছেন,
” রাজার সমাদর শুধু নিজ দেশে
বিদ্ব্যানের সমাদর দেশ-মহাদেশে।”
আল্লাহ তায়ালা উস্তাদ রহ কে সুখে রাখুন! শান্তিতে রাখুন। জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান বানিয়ে নিন।