স্বপ্নের চাষবাস

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ১৭ ২০১৯, ০৮:৪৫

সাবের চৌধুরী

মাদরাসায় নতুন একজন শিক্ষক এসেছেন। খুব হাশি-খুশি। নিয়মিত দরস করান। চমৎকার তার পড়ানোর ভঙ্গি। দরসে প্রাসঙ্গিক নানা প্রয়োজনীয় বিষয়ও আলোচনা করেন। ছাত্ররা আপ্লুত হয়। সচরাচর উস্তাদগণের গপ-সপের মজলিসগুলো এড়িয়ে চলেন। মাদরাসার পরিচালনাগত ‘এসলাহী’ ভাষণেও তার কোন আগ্রহ দেখা যায় না। যেমন, এহতেমামে এই সমস্যা, তালিমাতে এই-এই ফাঁক, মাদরাসায় এরকম-এরকম কেন হয় না? কোন পরিবেশ নাই! এভাবে তো লেখাপড়া চলতে পারে না!—এই রকমের জ্বালাময়ী ভাষণ তাকে কখনো কেউ দিতে দেখেনি। নিজের মত করে সবার সাথে একটা মিষ্টি সম্পর্কের ভেতর দিয়ে চলেন। দেখলেই বোঝা যায় লোকটা বিনয়ী এবং এমন যে, দেখলেই ভালো লাগে। অতিরিক্ত পণ্ডিতি ভাব নেই আবার অভদ্র বোকাও নন।

ছাত্রদের সাথে তাঁর আচরণের ধরণে শুরুর দিকে ওরা বেশ একটা ধাক্কামত খেয়েছিলো। বেশিরভাগ সময় নিজের কাজ নিজেই করে ফেলতে চান। কাউকে কিছু করতে বললেও নির্দেশ দেন না; কেমন কাতর অনুরোধ করেন। ছাত্ররা তার সামনে এসে কাঁচুমাচু ভঙ্গি করতে চাইলে চোখ মটকে কপট রাগ দেখান, ধমক দেন। আর, সবসময় মুচকি মুচকি হাসেন। এমনকি পিটুনি দেবার সময়ও হাসেন। উনার এইসব বলে শেষ করা যাবে না।

এই শিক্ষক সপ্তাহদুই পরেই একটা কাণ্ড করে বসলেন। এতে ছাত্ররা কেমন ভড়কে গেল। যেমন, জালালাইন জামাতে গিয়ে একদিন জিজ্ঞেস করলেন- আচ্ছা, আপনারা কি থিসিস লেখেন? ছাত্ররা চোখ বড় বড় করে তাকালো। থিসিস! হ্যাঁ, হ্যাঁ, থিসিস। লেখেন না কেন? শুনেন, আমরা আগামী এক মাসে সবাই মিলে একটা থিসিস করবো। বিষয় হলো—কুরআনুল কারীমের সে-সকল আয়াত, যেগুলোর বাহ্যিক অর্থ ধরে কেউ ভুলের শিকার হতে পারে। এই যে, আপনি এই সূরা, আপনি এই সূরা, আপনি এই সূরা। আগামী তিনদিনের ভেতর আয়াতগুলো নির্বাচন করে সবাই আমাকে দেখাবেন।

আরেক দিন কাফিয়া জামাতে গিয়ে বললেন, তোমরা কি জানো খুব অল্প সময়ে সবাই মিলে আমরা চমৎকার একটি বই লিখে ফেলতে পারি? সবার তো চোখ ছানাবড়া। হুঁ, এক কাজ করো, তোমাদের গতবছরের হেদায়াতুন্নাহু কিতাবটিতে যতগুলো কবিতা ও আয়াত আছে, এবং যতগুলো ‘দরবে মিছাল’ আছে, সবগুলো খুঁজে বের করো। এরপর কঠিন শব্দগুলোর তাহকীক নিবে, এরপর তরজমা, এরপর ‘মহল্লে ইস্তেশহাদ’। আর, এই যে, এই নুসখাটিতে কবিদের নাম-ধাম কিছু দেওয়া আছে; এখান থেকে এগুলো নেবে। আচ্ছা, জিনিসগুলো আগে বের করে ফেলো। বাকিটা পরে হবে। আস্তে-ধীরে। সময় আজ রাত ঘুমানোর আগ পর্যন্ত।

বুধবার দিবাগত রাত। আগামীকাল সবকের তেমন চাপ নেই। রাত নয়টা থেকেই শরহে বেকায়া জামাতের ছেলেদের মধ্যে একটা আয়েশী ভাব দেখা দিলো। তিনি হঠাৎ হাসতে হাসতে গিয়ে হাজির। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। ছাত্ররা জানে তিনি এখন অদ্ভূত রকমের কোন একটা প্রশ্ন করে বসবেন। এমন, যে এরকম করে আগে কেউ জিজ্ঞেস করতো না। ছাত্রদের কাছে তাঁর এ বিষয়টা খুবই ভালো লাগে। কেমন চমকে উঠতে হয়।

ছাত্ররা এমন ভাবতে ভাবতেই তিনি প্রশ্ন করে বসলেন, আচ্ছা, বলতো এখন রাত কেন? অদ্ভূত প্রশ্ন করেন ঠিক আছে, তাই বলে এমন বেঢপ প্রশ্ন করবেন কেউ ভাবে নি। সবাই কেমন থতমত খেয়ে হা করে তাকিয়ে রইলো। তিনি রহস্যপূর্ণ করে বললেন, এখন রাত হয়েছে মূলত আমরা সবাই মিলে খুব করে একটা বিষয় আলোচনা করার জন্যে। তোমরা তো কাফিয়া কিতাবটি পড়েছো। সুতরাং খুব ভালো করে জানো নাহুর জগতে ফে’ল বা ক্রিয়ার ব্যাপারটি বিরাট একটি ঘটনা। নাহবেমীর, হেদায়াতুন্নাহু এবং কাফিয়া—এ তিনটি কিতাব সামনে নিয়ে ফে’ল এর পরিচয়, প্রকার, এর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত কী কী বিষয়, এবং প্রসঙ্গক্রমে আর কী কী এসে যুক্ত হয় এর একটা তালিকা তৈরী করে ফেলো। আগামী শনিবার আমার কাছে তালিকাটা জমা দেবে। আর না হয় সবার হাতে পায়ে আমি তালা মেরে দেব, দুষ্টের দল!

এরকম প্রায় সব শ্রেণীতে গিয়েই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে তিনি হানা দেন।

একদিন আসরের পর তিনি তার রুমে বসে আছেন। সামনে হিজাব বা পর্দা সংক্রান্ত দুটো রিসালা। আর নেট ঘেঁটে বের করা আরবি বাঙলা প্রবন্ধের বেশকিছু শীট। মেশকাত জামাত থেকে আবদুর রহিমকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সাথ এসেছে আরো দুইজন। এই যে, এগুলো পড়ে ফেলো। খুব ভালো করে নোট নিবে। বন্ধের ভেতরে নোটটা শেষ করে আনা চাই। কুরআনুল কারীমের হিজাব সংক্রান্ত আয়াতগুলো বের করবে। মেশকাত থেকে হাদীসগুলো নিবে। আরো কিছু হাদীস পাবে এখানে আর এই কিতাবে। এরপর…

মাদরাসা খুলেছে দুই সপ্তাহ হলো। এর ভেতরে আবদুর রহীমকে দিয়ে ফাঁকে ফাঁকে তিনি অনেক কাজ করিয়েছেন। এমনিতে সে ছাত্র ভালো। আবার বলতেও পারে ভালো। ফলে কাজটায় সে খুবই মজা পাচ্ছে।

একদিন ফজরের পর ছেলেরা মাদরাসার দেয়ালে দেয়ালে সাঁটানো অদ্ভূতরকমের একটা ঘোষণা দেখতে পেল।

“একাডেমিক সেমিনার। বিষয় : আল হিজাবু ফিল ইসলাম। আলোচক : মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ফজিলত। সময়, আগামী বৃহঃবার রাত ০৮ থেকে। স্থান : ফজিলতের রুম। নাহবেমীর জামাত থেকে উপরের শ্রেণীর যে কেউ উপস্থিত হতে পারবে।”

সে দিনের অনুষ্ঠান, এর অভিনবত্ব আর আবদুর রহিমের আলোচনা শুনে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। এমন ঘটনাও ঘটতে পারে?

বছর শেষে দেখা গেলো- এরকম সহজ-কঠিন মিলিয়ে ছাত্রদের দ্বারা মোট ৭টি সুন্দর সেমিনার হয়েছে। প্রস্তুত হয়েছে চমৎকার ছোট ছোট ১২টি গবেষণা পুস্তিকা। তিনি নিজেও ইতিহাসসংক্রান্ত চমৎকার পাঁচটি বিষয়ে আলোচনা করে শিট বিতরণ করেছেন।

এতোসব কাজ এমন অলক্ষ্যে হয়ে গেছে, ছাত্ররা টেরই পায় নি কীভাবে কী হলো; অথচ সব কাজ তারাই করেছে। উস্তাদ শুধু বাতলে দিয়েছেন কীভাবে কী করতে হবে। পুস্তিকাগুলো উস্তাদ নিজের হাতেই টাইপ করে বইয়ের আকৃতি দিয়েছেন। আয়োজন করে প্রকাশনা উৎসব করা হলো। এ উপলক্ষ্যে একদিনের জন্য মাদরাসার ক্লাস বন্ধ থাকলো।

অনুষ্ঠানে মুহামিম সাহেব যে আবেগঘন ভাষণ দিলেন, এতে সে শিক্ষক রীতিমত লজ্জায় পড়ে গেলেন। ফটোকপি করে সবগুলোর একাধিক কপি করা হয়েছিলো। দুই কপি করে মাদরাসায় জমা দেওয়া হলো। বাকিগুলো ছাত্ররা কাড়াকাড়ি করে কিনে নিলো। শেষে দেখা গেল তাঁর জন্য কোন কপি নেই। অবশ্য এ নিয়ে তার কোন আফসোসও নেই। তিনি ভাবছেন, এ বছর তো সময়গুলো বলতে গেল বেকারই গেল। যাক, আগামী বছর ভালো কিছু করতে হবে।