সুদমুক্ত সমাজ গড়ি

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ০৭ ২০১৮, ১৯:০৫

হাবীব আনওয়ার: এশার নামাজ পড়ে সারা দিনের ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই রাজ্যের ঘুম এসে ঝেকে ধরলো। পরিবেশ ঠাণ্ডা থাকায় ঘুমটা ভালোই হচ্ছিল। হঠাৎ মানুষের বাকবিতন্ডার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
জানালার কাছে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, পাশের বাড়ির চাচা সুদের টাকা পরিশোধ না করায় মহাজন বাড়িতে এসে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। বেচারা অনেক অনুনয়-বিনয় করে একটি সপ্তাহ সময় বাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু নির্দয় মহাজনের হৃদয়ের বরফ কোন ভাবেই গলছে না।

সকালে আম্মার কাছে জানলাম, অনেককে টাকার জন্য গ্রামের ক্লাবে সারা রাত আটকে রাখা হয়! এমন অনেক হৃদয় বিদারক ঘটনা হরহামেশাই আমাদের চারপাশে ঘটছে।

সুদ এমন একটি নিকৃষ্ট ব্যাধি যা আমাদের সুন্দর সচ্ছল সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে! বর্তমান সময়ে এই ব্যাধি ছোট-বড়, ধনী-গরিব সর্বশ্রেণীর মানুষকে গ্রাস করেছে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষ এর থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। সমাজের বড় একটি অংশের অবস্থা এমন যে সুদকে কোন গুনাহ মনে করে না! ফলে সুদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে! অথচ আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পবিত্র কুরআনে সুদকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন।
ইরশাদ হচ্ছে, “যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দণ্ডায়মান হবে, যেভাবে দণ্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছে, ক্রয়-বিক্রয় ও তো সুদ নেয়ারই মত! অথচ আল্লাহ তা’আলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে। (সূরা বাকারা ২৭৫)

অন্যত্রে ইরশাদ হচ্ছে,
আল্লাহ তা’আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে। (বাকারা ২৭৬)
হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যে সমস্ত বকেয়া আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাক। (বাকারা ২৭৮)

এছাড়াও আরো অনেক জায়গায় সুদের নিষিদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

হুজুর ছা. হাদীসে পাকে সুদ খাওয়াকে গর্হিত কাজ ও গৃহীতার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
আবদুর রহমান ইবনু ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুদখোর, সুদদাতা, সুদের সাক্ষী ও এর দলীল লেখক সবাইকে অভিশম্পাত করেছেন।
(ইবনে মাজাহ ২২৭৭)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হানযালা রা. থেকে বর্ণিত, হুজুর ছা. বলেন, জেনে-শুনে কোন ব্যক্তির এক টাকা পরিমাণ সুদ খাওয়া ছত্রিশবার ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার চেয়েও বেশি গুনাহ। (দারে কুতনী)

সামুরাহ ইবনু জুনদুব রা. বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আজ রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, দু’ব্যক্তি আমার নিকট আগমন করে আমাকে এক পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা চলতে চলতে এক রক্তের নদীর কাছে পৌঁছলাম। নদীর মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং আরেক ব্যক্তি নদীর তীরে, তার সামনে পাথর পড়ে রয়েছে। নদীর মাঝখানে লোকটি যখন বের হয়ে আসতে চায় তখন তীরের লোকটি তার মুখে পাথর খণ্ড নিক্ষেপ করে তাকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে যতবার সে বেরিয়ে আসতে চায় ততবারই তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করছে আর সে স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ কে? সে বলল, যাকে আপনি (রক্তের) নদীতে দেখেছেন, সে হল সুদখোর। (বুখারী, হাদিস নং ২০৮৫)

‘উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, হাতে হাতে (নগদ নগদ) ছাড়া গমের বদলে গম বিক্রি করা সুদ, নগদ নগদ ছাড়া যবের বদলে যব বিক্রয় সুদ, নগদ নগদ ব্যতীত খেজুরের বিনিময়ে খেজুর বিক্রয় সুদ। (বুখারী, হাদিস নং ২১৭০)

বর্তমান সমাজে অনেকেই মনে করে, সুদ হচ্ছে উন্নয়নের উত্তম পথ। অল্প দিনে অনেক সম্পদ হাতে নেওয়া যায়। অথচ, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সুদের কারণে প্রাথমিকভাবে অনেক অর্থ সম্পদ দেখা গেলেও পরে রাস্তার ফকির হয়ে গেছে। সুদের কারণে অনেক মারামারি-হানাহানি হয়েছে/হচ্ছে।
সুদখোররা শক্ত মনের ও নির্দয় হয়ে থাকে। দারিদ্র্যের রক্ত চুষে খেতে খুব সাচ্ছন্দবোধ করে। সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় অনেকের ঘরের চালা, গোয়ালের গরু, ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায়। অনেকে আবার ঋণের ভয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। সুদখোরদের বাহ্যিকভাবে যদিও হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়, বস্তুত তাদের মত অসুখে আর কেউ নেই।
মোট কথা, সুদ আমাদেরকে যেমন গুনাহের মাঝে জড়িয়ে ফেলছে।তেমনি আমাদের অর্থনৈতিক ভিতকেও নড়বড় করে দিচ্ছে। তাই আমাদের উচিত সুদ থেকে নিজেকে দূরে রাখা। সমাজ ও দেশকে সুদমুক্ত রাখা।

লেখক: শিক্ষার্থী, মেখল মাদরাসা হাটহাজারী,চট্টগ্রাম।