সিলেটে করোনা পরিস্থিতিতে মানবসেবক মাওলানা দিলওয়ার

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ১২ ২০২০, ১৮:২৫

কে এম রায়হান::  দু’জনেই একই জনপদের। তাঁরা দু’জনেই সিলেটের দক্ষিণ সুরমার। একজন কবি দিলওয়ার; সাহিত্যকর্ম দিয়ে পরিচিতি গড়েছেন বিশ্ব দরবারে। অন্যজনের পথ ভিন্ন। তবুও মানবসেবার মাধ্যমে ঠাই করে নিয়েছেন দেশ-বিদেশ হাজারও মানুষের মনে।

বলছি দক্ষিণ সুরমার মোল্লারগাঁও খিদিরপুরের দিলওয়ার’র কথা। পুরো নাম মুহম্মদ দিলওয়ার হোসাইন। ভীতি জাগানিয়া নাম করোনা ভাইরাস কিংবা কোভিড-১৯ রোগ। এতে আক্রান্তরা সমাজে যেনো একঘরেই হয়ে যাচ্ছেন। কেউ তাদের কাছে যাচ্ছে না। হাসপাতালে আসা-যাওয়ার জন্য তাদের কপালে জুটছে না অ্যাম্বুলেন্স কিংবা অন্য কোনো পরিবহন সেবাও। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবাও নেই হাতের নাগালে নেই। কাছেও ভিড়ছেন না আত্মীয়-স্বজনরা। কিংবা নিরাপত্তার কারণে ভিড়তে দেয়া হচ্ছেনা। সীমিত পরিসরেই করতে হচ্ছে করোনায় হেরে যাওয়াদের শেষ বিদায়ের আয়োজন। এমন নিষ্ঠুরতা আর ভীতি জাগানিয়া পরিস্থিতিকে জয় করে দিলওয়ার একদল স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মানবসেবায়। দিন থেকে গভীর রাত অবধি সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। রোগীদের জন্য বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। মরদেহগুলোকে পূর্ণ সম্মানে গোসল পড়িয়ে, কাফন পড়িয়ে জানাজা পড়ে কবরে শুইয়ে দিচ্ছেন তারা। কোনোরূপ বিনিময় ছাড়াই। শুধুমাত্র মানবসেবার ব্রত নিয়েই দিলওয়ারদের অদম্য ছুটে চলা।

খিদিরপুরের মৃত আব্দুল করিমের ছেলে কওমি মাদরাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিস অর্জনকারী সিলেটের সুপরিচিত আবাসন ব্যবসায়ী মাওলানা মুহাম্মদ দিলওয়ার হোসাইন। করোনা সংকটের শুরু থেকে নিরবে নিভৃতেই এই চরম দুঃসময়ে মানবসেবা করে যাচ্ছেন।

মাওলানা দিলওয়ার হোসেইন ও তার টিমের সাথে কথা বলে জানা যায়, ব্যক্তিগত উদ্যোগ আর পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধব, ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় দিলওয়ার হোসেইন ও তার সহযোদ্ধারা শুরু করেছিলেন মানবসেবার কাজ। দিনদিন সংকট যতো বাড়ছিল, সেবার চাহিদা ততোই বাড়ছিল। তবুও দমে যাননি এই নির্ভীক সৈনিকেরা।ভয়কে জয় করে তাদের সেবার তালিকা ক্রমশ বৃদ্ধিই পাচ্ছে। সংকট শুরুর দিকে ঘরে ঘরে নিয়ে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন খাদ্যসামগ্রী। যা এখনও চলমান। এখন তারা বিলাচ্ছেন বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা। হটলাইন নাম্বারে কল দিলেই যেকোনো করোনা আক্রান্ত রোগী কিংবা করোনা উপসর্গের রোগীকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসছে স্বেচ্ছাসেবক দল। আবার কোনো কোনো রোগীকে হাসপাতাল থেকে পৌঁছে নিয়ে দিচ্ছে বাড়িতে।বিভাগের বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত অর্ধশতাধিক রোগীকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সেবা দিয়েছেন ইতোমধ্যে। আর বৃহস্পতিবার (১১ জুন) পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ৪ জন রোগীর মরদেহ স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিয়ে পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ শ্রদ্ধায় শুইয়ে দিয়েছেন কবরে।দিলওয়ার হোসাইন একাত্তরের কথা’কে বলেন, ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। পরে শরীক হয়েছেন অনেক শুভাকাঙ্খি ও সুধীজন। শুরুর দিকে আমাদের খুব একটা প্রস্তুতি ছিল না। তবুও আমরা কাজ চালিয়ে গেছি। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, জানাযা ও লাশ দাফনের কাজ শুরু করি। একঝাঁক সাহসী স্বেচ্ছাসেবকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিগত একমাসে আমরা সিলেট নগরী, শহরতলি, সদর উপজেলাসহ অন্যান্য উপজেলার মধ্যে দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, জৈন্তাপুরে রোগীদের সেবা দিয়েছি।বৃহস্পতিবার অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদানে এক মাস পূর্ণ হল। ওইদিনও গোলাপগঞ্জের একজন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির গোসল, জানাজা ও দাফন করলাম আমরা। এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর,মৌলভীবাজার জেলা শহর,শ্রীমঙ্গল উপজেলা ও হবিগঞ্জ শহরে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেছেন। এটি অব্যাহত থাকবে।’মাওলানা দিলওয়ার জানালেন কার্যক্রমকে অব্যাহত ও স্থায়ীরূপ দিতে তারা বুধবার থেকে তাদের কার্যক্রমকে ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালনা করছেন। এখন আর তাদেরকে ভাড়াকরা অ্যাম্বুলেন্সে সেবা দিতে হবে না। নিজেরাই ট্রাস্টের মাধ্যমে ক্রয় করেছেন একটি উন্নতমানের অ্যাম্বুলেন্স। এই ট্রাস্টের সাথে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ সরাসরি যুক্ত আছেন।প্রায় ১২ লাখ টাকা দামে কেনা অ্যাম্বুলেন্সটি শিগগিরই যুক্ত হবে সেবা কার্যক্রমে। এতে থাকবে অক্সিজেন প্রদানের সুবিধাও। দেশের একটি নামদামি হসপিটালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সিলেটের কয়েকজন চিকিৎসকের সহযোগিতায় চালু হচ্ছে টেলিমেডিসিন সার্ভিসও।দিলওয়ার নামের অর্থ বলিষ্ট, হৃদয়বান ও সাহসী। অর্থগুলোর স্বরূপ ধরা দিল বাস্তবে। দিলওয়ার প্রমাণ করলেন তিনি সত্যিকার অর্থেই সাহসী। যেখানে ভয়ে স্বজনরাও দূরে সরে যাচ্ছেন। সেখানে তারা যাচ্ছেন এগিয়ে। দিলোয়ারদের এই এগিয়ে যাওয়া করোনাকালে প্রেরণা যোগাবে নিঃসন্দেহে। এমন পথচলাকে দলমত নির্বিশেষে স্বাগত জানিয়েছেন সিলেটের সর্বস্তরের সুধীসমাজ।
(বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস সুবিধা পেতে হটলাইন নম্বরগুলো হলো- ০১৭২৮-৭৮০২২২, ০১৭১৬-২০১৩০৭ ও ০১৭৭০-১৩০২৩৩।)