সিলেটের রেললাইন দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ লাইন…

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ০৯ ২০২০, ২১:১২

আহমদমালিক:  পৃথিবীতে সবচেয়ে নিরাপদ ভ্রমণপথ হচ্ছে রেলপথ। আর নিরাপদ বাহন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে ট্রেন। সড়ক পথে ঘনঘন দুর্ঘটনার কারণে ট্রেনে যাত্রায় অপেক্ষাকৃত স্বস্থিও বোধ করেন যাত্রীরা। তবে সিলেট-আখাউড়া রেলপথের জন্য এসব প্রযোজ্য নয়। ট্রেনের এই রুটটি হয়ে ওঠেছে যাত্রীদের জন্য চরম আতঙ্কের নাম। এই রেল লাইনে ঘটছে ঘন ঘন দুর্ঘটনা।

সর্বশেষ গত রোববার দুপুরেম মাধবপুরের শাহজিবাজার রেল স্টেশনের পাশে তেলবাহি ট্রেনের ৫টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এসময় বগিতে আগুনও লেগে যায়।

সিলেট-আখাউড়া রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৭৯ কিলোমিটার। জরাজীর্ন হয়ে পড়া এই সেকশনে রয়েছে ১৩টি মহাঝুঁকিপূর্ণ সেতু। রেলওয়ের ভাষায় যা ‘ডেডস্টপ’। এছাড়া ট্রেন লাইনও ত্রুটিপূর্ণ। এসবের সঙ্গে রয়েছে ট্রেনের পুরনো ইঞ্জিন আর বগি। এইসব মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠেছে সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ট্রেন ভ্রমণ।

করোনা সংক্রমণের কারণে চলতি বছরের ২৪ মার্চ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৫ মাস সিলেট-আখাউড়া রুটে রেল চলাচল বন্ধ ছিলো। ১৬ আগস্ট থেকে সীমিত আকারে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এই রুটে অন্তত ৬ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

ঘনঘন দুর্ঘটনার কারণে এই সেকশনে ট্রেনের সময়সূচিও ঠিক থাকছে না। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনে আগে ট্রেন চলত ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন সেই গতি অর্ধেকে অর্থাৎ ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

ছয় বছর আগে রেলওয়ের চাকুরীতে যোগ দিয়েছিলেন আহসান হাবীব। বছর দেড়েক আগে তিনি রেলওয়ের সিলেট স্টেশনে সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। তিনি বলেন, একবছরে এই লাইনে যত দুর্ঘটনা হয়েছে আমার ছয়বছরের চাকুরীজীবনেও এতো দুর্ঘটনা দেখিনি।

আহসান হাবীব জানান, পাহাড়ি ও আঁকাবাকা সড়ক হওয়ায় আখাউড়া-সিলেট সেকশনের রশিদপুর থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে জরাজীর্ন লাইন, মেয়াদোত্তীর্ন সেতু ও পুরনো কোচের কারণে এই সেকশনে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের তথ্যমতে, আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনি এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা এবং সিলেট-চট্টগ্রাম যাতায়াত করেন।

ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু: সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের মোগলাবাজার থেকে মাইজগাঁও পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জায়গায় স্লিপারের নাট-বল্টু খুলে গেছে। আবার কোথাও কোথাও নাট-বল্টু ঢিলে থাকায় রেল লাইন নড়বড়ে হয়ে আছে। রেলের দুই স্লিপারের মাঝখানে নেই পর্যাপ্ত পাথর।

এ সেকশনের সেতুগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, নির্মাণের ৫০-৫৫ বছর পরই সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অথচ এ রুটের ৯০ শতাংশ সেতুর বয়সই ৭০ বছর পেরিয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এরকম ১৩টি স্পটকে ‘ডেড স্টপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এই রেলপথের একটি স্টেশনের সহকারী স্টেশন ম্যানেজার সজিব কুমার মালাকার বলেন, ডেডস্টপ হিসেবে চিহ্নিত করা সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, পরে ৫ কিলোমিটার গতিতে চলা শুরু করবে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি এবং মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে ৫টি সেতু ‘ডেড স্টপ’ হিসেবে চিহ্নিত বলে জানান তিনি।

রেলওয়ের প্রকৌশল শাখা জানায়, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের অতিঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে- শমসেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২০০ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু, মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯নং সেতু এবং মনতলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু। এ সেতুগুলো সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় এখনই এগুলো সংস্কারের সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এরআগে ১১ নভেম্বর সিলেট ও মৌলভীবাজারের মধ্যবর্তী ভাটেরা নামক স্থানে মালবাহী ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগ।

তারও আগে গত ৭ নভেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের সাতগাঁও জংশনে তেলবাহী ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। লাইনচ্যুত বগি ফুটো হয়ে গড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহে এলাকাবাসীর হুড়োহুড়ির চিত্র দেশজুড়েই আলোচনার জন্ম দেয়। এ দুর্ঘটনায় সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ প্রায় ২৩ ঘন্টা বন্ধ ছিলো।

গত ৩০ অক্টোবর সিলেট রেল স্টেশনে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনায় বেশ কয়েক ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। সেদিন ডক ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের সামনের দিকে ধাক্কা দেয় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।

১৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও এলাকায় তেলবাহী ওয়াগনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাথে সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ২৩ আগস্ট যাত্রীবাহি ট্রেন লাইনচ্যুত হয় কুলাউড়া এলাকায়। একই স্টেশনে গত ২৪ জানুয়ারি ট্রেনের বগিতে আগুন ধরে যায়। এভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়তই।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই রুটে সবচেয়ে বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে গত বছরের ২৩ জুন। এদিন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের ৫টি বগি ব্রিজ ভেঙ্গে ছড়ায় পড়ে যায়। এতে ৫ জন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হন। । ২১ ঘণ্টা পর রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়।

গত এক বছরে সিলেট-আখাউড়া রুটে কি পরিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে তার তথ্য দিতে পারেননি সিলেটের স্টেশন মাস্টার জাহাঙ্গির আলম। তিনি বলেন, এই রুটে ঘনঘন দুর্ঘটনা ঘটে। তবে একবছরে কি পরিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।