সাহিত্যে রাজনীতির ছোঁয়া 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ৩১ ২০১৯, ০১:০৪

সৈয়দ শামছুল হুদা

সাহিত্যচর্চা বলতে শুধু কিছু শব্দের খেলাকেই মনে করি না। কালো হরফের মাঝে লুকিয়ে আছে আরো অনেক কিছু। যাদের লেখার মাঝে কোন প্রতিবাদ নেই, কোন স্বপ্ন নেই, কোন আশা জাগানিয়া কাহিনী নেই তাদের সাহিত্য নিরস সাহিত্য। উদ্দেশ্যহীন যারা লেখালেখি করে, যারা আদর্শহীন শব্দ চর্চা করে, তারা কতটুকু জনসমর্থন পায় তা পরিমাপ করা খুব কঠিন কিছু নয়।

বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ লেখক যারা, তারা কেহ-ই শুধু সাহিত্যিক ছিলেন না। তারা কোন ধর্মমতকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য, কোন আদর্শকে বিকশিত করার জন্য, কোন চিন্তা-চেতনাকে বিজয়ী করার জন্য কোন না কোন ভাবেই লড়াই করেই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্ত্র আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররা শুধুই সাহিত্যিক ছিলেন না। তারা হিন্দু জাগরণে লেখালেখি করে বাংলার হিন্দু সমাজকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। ঢাকার মুসলমানদের উন্নতি দমিয়ে রাখতে, বঙ্গভঙ্গের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি করতে “আমার সোনার বাংলা” গান রচনা করেছেন। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সভা করেছেন। সভায় সভাপতিত্ব করেছেন। অপরদিকে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় বৃটিশের বন্দনা করেছেন। শিবাজী নামে চরম হিন্দুত্ববাদী গাণও লিখেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র “বাঙ্গালী আর মুসলমানদের ফুটবল ম্যাচের” গল্প লিখেছেন। এসব কারণেই আজও তারা হিন্দু সমাজে স্মরণীয়-বরণীয়। তারা যদি শুধুই সাহিত্য চর্চা করে যেতেন তাহলে তাদেরকে আজকের হিন্দু সমাজও স্মরণ রাখতো না। মুসলিম সমাজতো দূরের কথা।

এমনিভাবে মুসলিম সমাজের উন্নতির আশায় যারা কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস লিখে গেছেন, যারা শত অভাবের ভিতর দিয়েও পত্রিকা প্রকাশ করে বাংলার মুসলমানদের জন্য লড়াই -সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন বাংলার মানুষ আজো তাদেরকে স্মরণ করে। কবি নজরুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আকরম খাঁ, কবি ফররুখ আহমদ, মহিউদ্দীন খান, আল মাহমুদ প্রমুখ শুধু লেখালেখিই করেননি। একটি ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে, একটি দিশাহীন জাতিকে দিশা দেখাতে লড়াই-স্ংগ্রাম করে গেছেন শব্দের মাধ্যমে। লিখনীর মাধ্যমে। যারাই দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্খা নিয়ে লেখালেখি করেছেন, মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে শব্দের মাধ্যমে সাহস যুগিয়েছেন জাতি তাদেরকেই বেশি স্মরণ করে। কিছু মানুষ আছে, শুধু শব্দ নিয়ে সাহত্যি চর্চা করেন। তাদেরকে মানুষ কোন কালেই স্মরণ রাখে না।

সাহিত্য চর্চার অন্যতম বিষয় হলো রাজনীতি। রাজনৈতিক সাহিত্য অনেক বেশি শক্তিশালী। কবি নজরুলের এক একটা কবিতা যেন বুলেটের মতো। পাকিস্তানের আল্লামা ইকবাল কবিতার মাধ্যমে যে বিপ্লব তিনি করে গেছেন তা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও করতে পারেননি। আজ যতটা ইকবালকে স্মরণ করা হয় এতটা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকেও করা হয় না। একজন কবি, লেখক, গবেষক, চিন্তক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক তাদের লেখায় যখন রাজনৈতিক চেতনা লালন করেন, কোন দেশ ও জাতিকে উপস্থাপনে সাহসী ভুমিকা পালন করেন, তখন দেখা যায় গোটা জাতি তার পাশে দাঁড়ায়। তাদের দেখে অনুপ্রেরণা পায়। করণীয় ঠিক করতে তাদের ভুল হয় না।

বর্তমান সময়ে যখন মুহিব খানরা কোন গান গায়, আর বলে উঠে-

“বিধ্বস্ত চৌচির,

ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর,

তিলে তিলে জ্বলে পুড়ে হলো ছাই,

প্রতিবেশি বাংলায়- কোথাও আজো কি হায়,

রুঁখে দাঁড়াবার মতো কেউ নাই, কেউ নাই… ”

তখন সেটা শুধু সাহিত্য চর্চা হয় না, হয়ে যায় অন্য কিছু। যখন মুহিব খান বলে-

ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি,

সোনার চাইতে খাটি,

নগদ রক্ত দিয়ে কেনা…

তখন সেটা শুধু গানই হয় না, হয়ে উঠে স্বাধীনতার চেতনাও। এমনিভাবে উবায়দুর রহমান নদভী যখন কোন আলোচনা করেন, তখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো মানুষ শুনে। কেন শুনে? শুধু শব্দ শোনার জন্য? উনার কথাগুলো খুব গোছানো সে জন্য? না, কখনই না। তিনি তাঁর বক্তব্যে এমন কিছু তুলে নিয়ে আসেন, যার সাথে জড়িয়ে আছে সকলের স্বার্থ, রাষ্ট্রের স্বার্থ, উম্মাহর স্বার্থ। আজকের যাইনুল আবেদীন সাহেব যখন কথা বলেন সেটা হয়ে উঠে কওম ও কওমিয়্যাত, দেওবন্দ ও দেওবন্দিয়ত এর উত্তম নমুনা। জনাব শরীফ মুহাম্মদ যখন কথা বলেন, সেটা শুধু সুন্দর উপস্থাপনার জন্যই প্রাণ পায় তা না, বরং সেখানে আরো কিছু বার্তা থাকে। যখন ছোট ছোট বাক্যে আল কুদস নিয়ে লিখেন জনাব ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী, তখন সেটা হয়ে উঠে অন্য কিছু।

আমাদের কেউ কেউ মনে করে, সাহিত্য চর্চা মানে হলো নিরেট শব্দ নিয়ে খেলা। এখানে ধর্মকে টেনে আনা উচিত নয়। সাহিত্য চর্চা শুধু বিনোদনের জন্য। আমাদের অনেকগুলো দৈনিক- সাহিত্য পাতা প্রকাশ করে। তাদের লেখা পড়ে না পাই আত্মার খোরাক, না পাই মনের খোরাক, না পাই দেশ রক্ষার কোন চেতনা। মনে হয় শুধু লেখার জন্যই লেখা। এসব লেখায় কোন বার্তা নেই। এরা সুকৌশলে তাদের লিখনীর মধ্যে ধর্মকে এড়িয়ে চলে। আর সে জন্যই যখন ওরা বড় বড় ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে, সেখানে ঈদ নিয়েই কোন আলোচনা থাকে না। যে মুসলমানদের ঈদ, সে মুসলমানদের জীবনযাত্রা নিয়ে কোন গল্প, ইতিহাস থাকে না। অথচ দেখেন ওপার বাংলার পুঁজা সংখ্যাগুলো!! তারা তাদের প্রতিটি পৃষ্ঠায়, প্রতিটি কলামে, প্রতিটি গল্পে কোন না কোনভাবে ধর্মকে উপস্থাপন করবেই।

মুসলমানদের মধ্যে এক ধরণের হীনমণ্যতা তৈরী হয়েছে। তারা ধর্মের ব্যাপারে তথাকথিত নিরপেক্ষতা আদর্শ লালন করে। তাদের লেখায় কোনভাবেই যেন ধর্ম না আসে, তার জন্য কত চেষ্টাই না তারা করে। আফসোস হয় তাদের জন্য। সাহিত্যে যদি নিজের বোধ ও বিশ্বাসের প্রতিফলন না ঘটে, তাহলে সেটা কিসের সাহিত্য? ওয়াহদানিয়্যাতের বিশ্বাস দিয়ে আমার যে জীবন, এই জীবনের সাথে সাংঘর্ষিক কোন বিষয় চর্চা করা দিয়ে আমার কী লাভ? আমার বিশ্বাস, আমার আদর্শ, আমার চেতনা যে লেখায় ফুটে উঠে, জীবন্ত হয়ে উঠে, যে লেখা আমার বোধ ও বিশ্বাসকে শানিত করে, যে লেখা আমার উম্মাহকেন্দ্রিক চিন্তাকে বিকশিত করে, সেটাই আমার কাছে সাহিত্য।

ফেসবুকের কল্যাণে মাঝে মাঝে ভালো কিছু লেখা পাই, বক্তব্য পাই। তার মধ্যে ফিলিস্তিনের এক কিশোরী কন্যার একটি বক্তব্য আমাকে বারবার দেখতে বাধ্য করে। মেয়েটির বক্তব্যে এমন আগুনঝরা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার মধ্যে সাহিত্যও আছে, ধর্মও আছে, রাজনীতিও আছে। সে দৃঢ় চেতনার সাথে উচ্চারণ করে, “আমি অবশ্যই দু রাকাত শুকরিয়াতান সেজদা আদায় করবো, আর সেটা আল আকসায়” তখন তার বিশ্বাসের পারদটা কত গভীর তা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে চেষ্টা করি। কয়েকদিন আগে সিরিয়ার এক কিশোরের বক্তব্য দেখলাম, পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে এমন সুন্দরভাবে খুব সংক্ষিপ্ত একটি বক্তব্য দিচ্ছে যেখানে আরবী ভাষার প্রাঞ্জলতা উপচে পড়ছে, পাশাপাশি খুনি বাশ্বার আল আসাদের বিরুদ্ধে তার প্রচন্ড ক্ষোভও ঝড়ে পড়ছে। এর আগে জর্ডানের এক মসজিদে এক বালকের বক্তব্য দেখেছি, যেখানে মসজিদের খতীবের বক্তব্য থামিয়ে দিয়ে আল আকসার পক্ষে তার সাহসী ও তেজোদীপ্ত বক্তব্য দিয়ে উপস্থিত মুসুল্লিদের হৃদয় কেড়ে নিয়েছে। এমনিভাবে কাশ্মীরের দুটি শিশুর গান, “দুনিয়ার জান্নাত কাশ্মীরে ঝড় তুফান কেন মা’ শীর্ষক একটি গান গেয়ে সেখানে সাহিত্যের মাধ্যমে প্রতিবাদের অতুলনীয় শিক্ষা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।

মিনমিনা স্বভাবের সাহিত্য চর্চা আমার পছন্দ না। আমার পছন্দ রাজনৈতিক সাহিত্য। যেখানে উম্মাহর স্বার্থের কথা আছে, উম্মাহর মুক্তির গান গাওয়া আছে। যে বক্তব্যে উম্মাহর দরদ প্রকাশ পায় না, সেটা আমার যেমন পছন্দ না, তেমনি যে লেখায় উম্মাহর মুক্তির জয়গান নেই, সেই লেখাও আমার কাছে লেখা মনে হয় না।