সামাজিক অবক্ষয়- সাইফ রাহমান

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ২৭ ২০১৮, ১৭:৩০

সিএনজির পেছনের সীট ফুল। পুরুষরা বসে আছে। হঠাৎ করে একজন মহিলা আসলেন। তাকে একটু দূর যেতে হবে। সিএনজি যেদিকে যাবে সেদিকেই। ঢাকা শহরের বাহিরের সব জায়গাতেই সিএনজি’তে পাঁচসীট থাকে। ড্রাইভাররা এটা করে থাকেন। মূলত সিএনজি তিনসীটের। শুধুমাত্র পেছনের সীটগুলো। তিনসীট এজন্যই বললাম, সেখানে তিনজন মানুষই বসতে পারেন।
.
পাঁচসীট। পেছনের তিনটা। আর সামনে দু’টো। মধ্যখানে ড্রাইভার। ডানেবামে দু’জন। এই দু’জন মানুষ খুব কষ্ট করে সামনে বসে থাকেন। মূলত সীট না পেলে জরুরী কাজ হলে, অথবা জরুরী কোথাও যেতে হলে সেখানে লোকজন বসেন। নতুবা পেছনের সীটগুলোতেই দখল থাকে যাতায়াতকারীদের।
.
পেছনের সীট ফুল। সামনের দু’টো খালি। মহিলা কোথায় বসবেন। কেউ নড়াচড়া করেনা। ড্রাইভার সাহেব এদিকসেদিক চোখ ঘুরালেন। পিছনের দিকে তাকালেন। কিন্তু কাউকেই দেখলেন না যে, একটা সীট মহিলাকে দিয়ে কোন একজন সামনে এসে বসবেন। এমতাবস্থায় ড্রাইভার সাহেব বলেই ফেললেন। ভাই! আপনারা একজন সামনে আসুন। মহিলা মানুষ, সামনে কেমনে বসবেন? কেউই আসলো না। সাড়াশব্দও নেই।
.
গাড়ির টাইম চলে যাচ্ছে। সিরিয়ালের গাড়ি বলে কথা। এদিকে মহিলারও তাড়া। তাকে যেতেই হবে। মুখ খুললেন মহিলা। বলে ওঠলেন, কেউ যখন সামনে এসে বসবেনা, তাহলে আমাকে সামনে বসেই যেতে হবে। কোন অসুবিধা নেই। আমি বসতে পারবো। ড্রাইভার সাহেব! স্টার্ট দিন।
.
মহিলা সিএনজি’র সামনের সীটে বসলেন। ড্রাইভারের বামদিকে। হাত দিলেন সিএনজির ছাদের রডে। সেখানে শক্ত করে ধরে রইলেন। সামনে বসে পুরুষরা যেভাবে উপরের রডে ধরে বসে, ঠিক সেভাবেই মহিলাও করলেন। নেই কোন পুরুষ-মহিলার তফাৎ। শুধু আকৃতিটাই মহিলার। কাজ পুরোদস্তুর পুরুষের। একজন শক্তিমান পুরুষও সিএনজির সামনে বসে যায়না, ঠেকা পড়লেই তবে সামনে বসে। কিন্তু সেই জায়গায় একজন মহিলা।
.
পেছনে তিনজন। সামনে ড্রাইভারের বামে একজন মহিলা। মোট চারজন। বাকী রইলো সামনের একটা সীট। পাঁচজন হতে একজন বাকী। সেই একজন সামনে ড্রাইভারের ডানে বসলেন। উনিও বেশ কষ্টকর অবস্থায়। সামনের বামের সীট থেকে ডানের সীটটা তুলনামূলক একটু ছোট থাকে। ড্রাইভার বসে থাকেন বিধায়। তবুও তিনি কষ্ট করে উপরের রডে হাত দিয়ে রইলেন। পুরুষ হিসেবে বেশ একটা কষ্ট অনুভূত হবার কথা না। তবুও সামনে তো সামনেই। এরমধ্যে ডানের ছোট সীট।
.
গাড়ি চললো। তার আপন গতিতে। ভোরবেলা। কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা। এরমধ্যে শীতকাল। প্রচণ্ড টান্ডা। আবার সিএনজি। বিষয়টা একটু চিন্তা করলেই শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। কিভাবে এই টান্ডার মধ্যে সিএনজিতে করে যাওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে সামনে একজন মহিলা!
.
সিএনজির পেছনের তিনজন পুরুষের পুরুষত্ব আছে কী না, সেটা মনে মনে ভাবছেন সামনে বসা ডান সাইডের মামুন। মামুন শান্ত মেজাজের মানুষ। তারপরও এসব দেখে সে ভেবে কুল পাচ্ছেনা। শরীরের শীরা-উপশিরা গরম হয়ে যাচ্ছে তার। কিন্তু বিবেকের তাগিদেই সে কিছু বলতে পারছেনা। কারণ সবার মত সেও ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে। একজন স্বেচ্ছায় সীট না দিলে জোর করে তো আর নেয়া যায়না, এমনটা ভেবে ভেবে চুপ করে বসে রইলো। তবে মনে মনে ঠিকই ধিক্কার দিয়ে যাচ্ছিলো। এমূহুর্তে এছাড়া আর কিছুই করার নেই তার।
.
কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে সেতু পার হচ্ছে ড্রাইভার। কুয়াশায় অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। সকাল ছ’টা হয়ে গেল, অথচ এখনো কুয়াশাই কমেনি। বরং আরো বাড়তে আছে। এরমধ্যে কাণ্ড ঘটে গেলো। বড় ধরণের। সেতুর মধ্যখানে হঠাৎ করে মহিলা সিএনজি থেকে সিটকে পড়ে গেলেন। গাড়ি ধীরে ধীরে চলছিলো। তারপরও। রডের মধ্যে হাত ছিলো। কিন্তু কেমনে যে পড়লেন! কিছুই বুঝা গেলো না। নাকেমুখে রক্ত। ফিনকি দিয়ে যেন বের হচ্ছে।
.
সম্ভবত তিনি ঘুমিয়ে গেছিলেন। বিধায় ঘুম লাগতেই রডের মধ্যে ধরা হাত ফসকে গিয়ে সিএনজির বাহিরে। একেবারে রাস্তায়। তারপর দ্রুতকরে হসপিটালে। মানুষ দিন দিন হসপিটালে যাচ্ছে। কেউ মারামারি করে সম্পদের জন্য, হিংসার অনলে পুড়ে নেতা হবার আশায় অর্থাৎ রাজনীতির জন্য। আবার কেউ এক্সিডেন্ট করে! প্রচলিতধারার কোন এক্সিডেন্টে নয়, সামাজিক রীতিনীতির উলটো চলে। অসুস্থ হয়ে নয়, মানসিক বিকৃতি ঘটিয়ে। এভাবেই সমাজের অবক্ষয় ঘটেছে আজকাল। মধ্যযুগীয় অবস্থায় চলে যাচ্ছি। এ থেকে উত্তরণের পথ খোঁজতে হবে। খুব দ্রুতকরে।