সাপ হয়ে দংশে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে!

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ১৮ ২০২১, ০০:৫০

সংখ্যালঘু এবং হিন্দুদের মহান রক্ষাকর্তা হয়ে ১৩ বছর ক্ষমতায় আছে। প্রশ্ন উঠান, বিকল্পহীন ক্ষমতায়নের আউটকামে হিন্দুরা, সংখ্যালঘুরা আরো নিরাপদ না হয়ে বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন কেন?

উস্কানি ও এজেন্ডার রাজনৈতিক প্রকল্পকে মাইনাস করে শুধু ধর্মপ্রাণকে সাম্প্রদায়িকতার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দায়ী করার হীনমান্যতা আর কতকাল আমরা বয়ে বেড়াবো? আমরা কবে সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বলবো, সংখ্যালঘু নির্যাতনে এলিট এস্টাব্লিশ্মেণ্টের মব জাস্টিস প্রত্যাখ্যান করে আমারা প্রত্যাকটা সাম্প্রদায়িক ঘটনার দ্রুততম এবং নিরপেক্ষ বিচার চাই, বিচারের কাঠামো চাই, জবাবদিহিতা চাই। আমরা বিচার দেখতে চাই, শুধু বিচার!

সাম্প্রদায়িকতার পেছনের রাজনৈতিক প্রকল্পগুলোকে আমরা আর কবে এড্রেস করবো? নিজেদের রাজনীতির বায়াসের কেন্দ্রগুলোকে আমরা কবে প্রশ্নযুক্ত করবো?

হিন্দু-মুসলিমের আন্তঃসাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সমস্যাকে এলিট সেটেলমেন্ট, আঞ্চলিক রাজনীতির ন্যারেটিভ এবং দেশীয় ‘অভিজাত’রা ব্যক্তি ও সমাজের হীনতা, নোংরামি, সাম্প্রদায়িকতা হিসেবেই শুধু দেখিয়েছে, কিন্তু তাতে ক্ষমতার যোগ কতটা গভীর সেটা যাচাইয়ের চেষ্টা করেনি কখনও।

ব্যক্তির বিদ্বেষ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয় না পেলে কখনই হিংস হামলায় পরিণত হতে পারে না-এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য। প্রায় প্রত্যেকটা আন্তঃসাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা পলিটিক্যালি মোটিভেটেড। রাজনৈতিক অপশক্তিকে নাল করে দিলে, (বিদেশী ভিন্ন) অপরাপর দেশীয় অপশক্তি এমনিতেই নখদন্থীন হয়ে পড়ে। এই সত্যটা বাংলাদেশের এলিটরা, দুর্বৃত্ত বুদ্ধিজীবীরা বলার সাহস রাখে না। যে কোন সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মূলেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কিংবা আন্তঃধর্মীয় ভেদাভেদ ছিল না, বরং ছিল সংখ্যালঘু বা দুর্বলের উপর সংখ্যাগুরুর নামে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি দখল ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বর্বরতর এবং বর্বরতম কূটকৌশল।

বুদ্ধিজীবিরা দেশের সফট পাওয়ার, তারা বিষয়গুলো উঠায় না বলেই বিচারের বিষয়টা প্রচ্ছন্নই থেকে যাচ্ছে। সমস্যাও বাড়ছে।

আজকেও রাজনীতিকে যাযথাথভাবে দায়ী করা হচ্ছে না। এলিট বুদ্ধিজীবীদের দেখুন, একটা লোকও বলেনি আলো নিভিয়ে রাতের মন্দিরে কোরআন শরিফ রাখার রাজনীতিটা কে করেছে? খুঁজে বের করুন! বরং তারা সাম্প্রদায়িকতার আফটার ম্যাথ নিয়ে ব্যস্ত। কেউ জিজ্ঞেস করছে না, আপনার ‘থাকলে ভোট, গেলে সম্পত্তি’ এই সংখ্যালঘু রাজনীতিটা থামাবেন কবে? আপনি দেখেননি, ঐ মাদ্রাসার ছাত্রকে! পূজার দেবীর সামনে হাত পিছনে দিয়ে দাঁড়াতে? আপনি একপাক্ষিকভাবে শুধু জনতাকে দায়বদ্ধ করে, ক্ষমতাকে, রাজনীতিকে আর কতদিন ছাড় দিবেন?

সংঘাতের রাজনৈতিক প্রকল্পকে ব্ল্যাক আউট করে আমাদের সমস্যা কমছে কি? মন্দিরে স্ক্রিপ্টেড স্যাবটাজ, মন্দির হামলা ও তার পরবর্তী খুনাখুনি প্রতিহত না করতে পারার দায় যে সরকারের মন্ত্রী, প্রশাসনের সচিব থেকে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বর্তায়, সেটা পুরোপুরি অনুপস্থিত। এটাই সমস্যার বিপরীতে সচেতনতার মূল পয়েন্ট। আমরা সবাই জানি, প্রধান আসামীকে চার্জশিটে না এনে সহযোগীদের অভিযুক্ত করে কোন বিচার নিষ্পত্তি করে ফেল্লেও সেটাকে বিচার বলা যায় না, বলে প্রহসন। এইসব প্রহসনে সমাজের ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।

সমাজের ব্যাধি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা কিন্তু ব্যাধির রাজনৈতিক কারণ ও উপশম নিয়ে কথা নেই। ব্যাধি নিয়ে আলোচনা করা নিরাপদ। পছন্দের কিংবা বায়াসের যায়গাটুকুকেও প্রশ্ন করা লাগে না, বরং একটা আগে থেকেই নির্ধারিত এলিট মব জাস্টিস করে সুশীল সাজা যায়। রাষ্ট্র ও সরকারের বিভাজনের উস্কানিকে প্রশ্ন করতে গেলে, বিচার চাইতে গেলে বায়াসের কেন্দ্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে? দুর্বৃত্ত রাজনীতির কুশীলবরা ক্ষমতায় থেকে গেলে পরে আজকের সুশীল সাজা আপনি, আজকের নিরপেক্ষ সাজা আপনি রাজনৈতিক অপশক্তির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আলাপ তুলবেন?

হীনমন্য সমাজের সাম্প্রদায়িক আচরণে আজকের মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত নিজে লজ্জিত, কিন্তু সে নিজে যে অসাম্য বৈষম্য ও অবিচারের যে রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা গড়েছে তা নিয়ে তার দায় ও দায়বদ্ধতা নেই, তা নিয়ে তার লজ্জা নেই। বিকল্প নেই বলে আপনি নির্বাচনী ব্যবস্থা, জবাবদিহিতা, বিচার ব্যবস্থাসহ সমুদয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নির্বাসন দিয়ে এক ব্যক্তির ক্ষমতায়নকে প্রশ্নহীন করেছেন। এক চোরকে জেলে পুরে অন্য চোরকে ক্ষমতায় রেখে তাকে ‘দুধে ভাতে’ পেলে পুষে ডাকাত ও মাফিয়া হতে দিয়ে আপনার সমস্যা কমেছে নাকি বেড়েছে? আপনার তো কথা ছিল, নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থার চালু রেখে, যে চুরি করবে তাকেই লাথি মারার একটা সংস্কৃতি, একটা বিধিবদ্ধ সিস্টেমের কথা বলে চলা। যে কোন অঘটনে রাজনীতিকে এবং সরকারকে দায়ী ও দায়বদ্ধ করা গেলেই তবে সরকার ও তার এজেন্সি এগুলা অপকর্মে জড়িত থাকলে খেমতি দিবে, তারা না করলে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করবেই করবে, বিষয়টা তো এমন হবার কথা ছিল!

আপনার দেশে ভোট নেই, বিরোধী দল নেই, আপনার দেশের পূজায় বাঁধা, মন্দিরে হামলা, বিচার নেই, আপনার দেশে ধর্ষণের মহামারি, বাইতুল মোকাররম মসজিদে গুলি, বিরোধী রাজনৈতিক মিছিলে গুলি, পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক গুম, আপনার দেশে ক্ষুধার জ্বালায় মানুষ আত্মহত্যা করে, কোটি কোটি বেকার। অথচ আপনি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেন না, আপনি পরিবর্তন চান না, অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে সচল করতে চান না। আপনি আর কবে প্রশ্ন করতে শিখবেন? আর কত দিন, নিজ নিজ বায়াসের জায়গায় ভিক্টিমকে ‘সরি’ বলে অন্য যায়গাটাকে চেপে যাবার নির্লজ্জতাটা চালিয়ে যাবেন?

মানুষের প্রতিবাদ, রাজনৈতিক অধিকারের লড়াই, বাক-স্বাধীনতা বন্ধ করে দিয়ে ১৩ বছর আপনি গণতন্ত্রহীন ‘অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা চাষ’ করেছেন। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মাথা তুলতে না দিতে আর কত বছর লাগবে? আওয়ামীলীগকে শর্তহীন সমর্থন না দেয়ার কারণে আপনি বন্ধুকে পর করেছেন, মানুষকে পাকিস্তান যেতে বলেছেন। সবাই খারাপ, একজন ভাল, সেই ভাল সমাজে কী ভাল এনেছে? নিজেকে প্রশ্ন করুন? “ফুটন্ত কড়াই” থেকে “জ্বলন্ত উনুন” নিক্ষিপ্ত না হতে চেয়ে রাজনীতি, বিচার ও জবাহিদিতা পুরোপুরি বন্ধ করে আপনি শিক্ষিত, আপনি বুদ্ধিজীবী কি অর্জন করেছেন?

আজকে লেজিটিমেট বিরোধী রাজনীতিকে বন্ধ করে, উগ্রডানকে জোর করে দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি বানানোর‍ কি কোন প্লট হচ্ছে না? কেন আমাকে এই দুর্বৃত্তপনা মেনে নিতে হবে, যারা ক্ষমতা ও ভোটের মাঠে নিয়মিত জামানত হারাত? কেন তাদের এম্পাওয়ার করার এলিমেন্ট নিয়ে এভাবে খেলা হচ্ছে? এসব হিসাব মিলানোর সময় তো এসে গেছে! আপনি জানেন না, ডেমোক্রেটিক প্রসেস বন্ধ করলে একটা দেশকে ও জাতিকে যে যে পেনাল্টিগুলো দিতে হয় আমরা ঠিক সে সেগুলাই দিতে শুরু করেছি?

সরকার ও রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের পাওয়া ও না-পাওয়ার বুঝাপড়ার রাজনৈতিক স্পেইসের অনুপস্থিতিটা কিভাবে দুর হবে? নাগরিক জীবনের ক্ষোভ ও ক্ষতগুলোকে প্রশমিত করার পথ কি হবে? গণতান্ত্রিক নিয়মতান্ত্রিক নাকি সাম্প্রদায়িক? প্রশ্নটা উঠে যাক। সাম্প্রদায়িক বিক্ষোভের মাধ্যমে ক্ষোভ ও ক্ষত প্রশমিত হতে দেয়া সরকারের জন্য বেশ আরামের, বেশ সুখকর। এতে নাগরিক দাবী দাওয়া না মিটলেও ধর্ম রক্ষার একটা মিথ্যা সুখ পাওয়া যায়। এটা ভারত পকিস্তান বাংলাদেশের পপুলিস্ট রাজনীতির মেইন স্ট্রীম প্র্যাকটিস হয়ে গেছে। বিশেষ ‘রাস্তা করে দেয়া ধংসাত্মক ক্ষোভ প্রশমনের পথ’ এবং এই যে সিলেক্টিভ প্রতিবাদের সংস্কৃতি রাজনীতিবিদরা একেবারে এলিট বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিক্ষিত ও সাধারণের মননে গেঁথে দিতে পেরেছে, এটাই তাদের মূলধন, এটাই তাদের মূল রাজনীতি। এই অপ-রাজনীতিটাকে কি আমরা নাল করে দিতে পারি না?