সন্তান লালন পালনে ইসলামের নির্দেশনা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ০২ ২০২০, ২২:২০

মুফতি আহমদ যাকারিয়া
মানবকাননের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ও সুরভিত পুষ্প হচ্ছে শিশু। সংসারজীবনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ—সব কিছু আবর্তিত হয় শিশুকে কেন্দ্র করে। শিশুর হাসি যেমন মায়ের যাবতীয় দুঃখ দূর করে দেয়, তেমনি অনুপ্রাণিত করে বাবাকে সংসারযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। প্রতিটি শিশুই ছোট্ট চারাগাছের মতো, ফুলের কলির মতো। তার মধ্যে রয়েছে বিশাল বৃক্ষ হয়ে বিকশিত হওয়ার যোগ্যতা। সুন্দর ফুল হয়ে ফুটে ওঠার সক্ষমতা। ঘ্রাণে ঘ্রাণে পৃথিবীকে সুবাসিত করার সুপ্ত প্রতিভা।
শেখালেই শিশুরা শেখে : শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা দেখে দেখে শেখে। শুনে শুনে শেখে। প্রয়োজন শুধু বড়দের সচেতনতা। শিশু তার বাবার কাছ থেকে শেখে। মায়ের কাছ থেকে শেখে। শিক্ষকের কাছ থেকে শেখে। তার চারপাশের মানুষের কাছ থেকে সে শিখতে থাকে। ফলে সবাইকে শিশুর সামনে সচেতনভাবে চলাফেরা করতে হবে। শিশুকে বলা হয় ‘কাদামাটি’। আপনি যেভাবে তাকে গড়তে চাইবেন, সেভাবে সে গড়ে উঠবে। যা শেখাবেন তা-ই শিখবে।
আল্লাহতায়ালা মানবশিশুকে নিষ্পাপ এবং ভবিষ্যৎ সফলতার যাবতীয় উপকরণ সন্নিহিত করে দুনিয়ায় পাঠান। সৃষ্টিগত কোনো যোগ্যতা শিশু তার মায়ের পেট থেকে নিয়ে আসে না। বরং পৃথিবী নামক এ বিশাল গর্ভে দৃষ্টি মেলার পর তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা, মা-বাবা, সমাজ-সংসার ও শিক্ষালয় থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা-দীক্ষা তার ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ নির্ণয় করে দেয়। নিষ্পাপ শিশুকে ইসলাম যেমন স্নেহ-মমতা দিয়ে গড়ার আদেশ করেছে, তদ্রূপ ভবিষ্যতে সুন্দর নাগরিক ও পরকালীন উপযুক্ত পাথেয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাকে শৃঙ্খলা ও আন্তরিক শাসনের মধ্যে আটকে রাখারও নির্দেশ করেছে।
আজকাল যুবকদের মধ্যে ধর্মহীনতার বড় কারণ এই যে, পিতা-মাতা ধর্মজ্ঞানে জ্ঞানী ও ধার্মিক হলেও সন্তানদের ধার্মিক হওয়ার বিষয়ে হয়তো সেভাবে চিন্তা করে না। সাধারণভাবে আমাদের দৃষ্টি সন্তানদের পার্থিব ও স্বল্পকালীন আরাম-আয়েশের প্রতিই নিবদ্ধ থাকে এবং আমরা এর ব্যবস্থাপনায়ই ব্যতিব্যস্ত থাকি। অক্ষয় ধন-সম্পদের দিকে মনোযোগ দেই-ই না। আমাদের উচিত আখেরাতের চিন্তায় ব্যাপৃত হয়ে নিজের ও সন্তানদের জন্য ঈমান ও নেক আমলকে সর্ববৃহৎ পুঁজি মনে করে তা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া।
সন্তান চারিত্রিক হওয়া নির্ভর করে পরিবারের সচেতনতার উপর:
পারিবারিক জীবনে সন্তান লালন-পালনে বাবা-মায়ের দায়িত্ব অপরিসীম। মাতা-পিতার কারণেই শিশু ইহজগতের মুখ দেখতে পেরেছে। সন্তান জন্মের পরই মা সর্বপ্রথম তাঁর শিশুটিকে মাতৃদুগ্ধপানে আগলে রাখেন। মমতাময়ী মায়ের কারণেই সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য হয় ও তাঁর উষ্ণক্রোড়ে থেকে বাল্য অবস্থায় অসহায় শিশুটি নিরাপদে বেড়ে ওঠে।
সন্তান গর্ভধারণ, প্রসব বেদনার কষ্ট এবং দুধপান করানো প্রভৃতি সন্তানের মা একাই বহন করে থাকেন। অতঃপর বাবা লালন-পালনের বেলায় মায়ের সঙ্গে অংশীদার হয়ে থাকেন। এর বাহ্যিক বিনিময়স্বরূপ আল্লাহ পাক সন্তানের প্রতি তার মাতা-পিতার সঙ্গে সদয় ও সদ্ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক তথা ফরজে আইন করে ঘোষণা দিয়েছেন।
মায়ের সন্তান গর্ভধারণ, প্রসব ও বুকের দুধদানের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে পবিত্র কুরআনে সন্তানকে পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার জন্য আদেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আমি মানুষকে পিতা-মাতার প্রতি সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে গর্ভেধারণ করে কষ্টের সঙ্গে এবং প্রসব করে কষ্টের সঙ্গে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার দুধ ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস।’ (আহকাফ – ১৫)
ছেলে-মেয়েরা মানুষ হওয়াই বাবা-মায়ের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিদান। তাই পিতা-মাতার দায়িত্ব হচ্ছে তাদের লালন-পালন করা, তাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি অবশ্যই ধর্মীয় শিক্ষাদান ও ইসলামের আলোকে নৈতিক চরিত্র গঠনে অপরিহার্যভাবে গুরুত্বারোপ। পারিবারিক পরিবেশে শিশুরা বড় হতে থাকবে এবং ধর্মীয় মূল্যবোধও তাদের হৃদয়ে জাগ্রত হবে।
এ কারণেই নবী সা. বলেছেন, ‘যখন তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হয় তখন তাদের নামাজের প্রশিক্ষণ দাও।’
হাদিসে বলা হয়েছে, ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কিছুই পিতা-মাতা সন্তানদের দান করতে পারে না।’ (তিরমিজি)
মুসলিম সমাজে পরিবার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালন করে এবং আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করে। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার হলো একটি শিশুর জীবন গড়ার প্রাথমিক পাঠশালা ও প্রধান পাঠাগার। এ পাঠশালার ওপর শিশুর জীবনের ভিত রচিত হয়। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসবাসের মধ্য দিয়েই শিশুরা মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার গুণাগুণের পরিচয় লাভ করতে শুরু করে। এ জন্য পরিবারের প্রধান দু’জন সদস্য বাবা-মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। সন্তান পিতা-মাতার অতিশয় প্রিয়জন। তারা বাবা-মায়ের প্রতি অনুগত ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। শিশুরা খুবই অনুকরণপ্রিয়; তারা যা শোনে, যা দেখে, তা-ই বলে এবং তা-ই করে। তাদের সামনে অশোভনীয় কিছু বলা বা করা মোটেই সমীচীন নয়। তাদের স্নেহ, আদর ও সুন্দর আচরণ শেখানো জরুরি। এতে তারা আদব-কায়দা ও ভালো কথা বলতে শিখবে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সা. বলেন; ‘যে ছোটকে স্নেহ-মমতা করে না এবং বড়কে শ্রদ্ধা করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (বুখারি)
সন্তান চারিত্রিক হতে হলে বাবা-মা সচেতন হতে হবে:
প্রতিটি মানুষই বিবাহিত জীবনে প্রবেশের পর সন্তান কামনা করেন। অধিকাংশ দম্পতিই হন সন্তানের গর্বিত পিতা-মাতা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, শুধু সন্তান জন্ম দিয়ে পিতা-মাতা হওয়াই যথেষ্ট নয়। সাথে সাথে সবাইকে হতে হবে দায়িত্বশীল পিতা-মাতা। অন্যথায় দুনিয়াতে যেমন রয়েছে ভোগান্তি, আখিরাতেও রয়েছে তেমনি অশান্তি এবং অপেক্ষমান নিচ্ছিদ্র জবাবদিহিতা। কারণ, সন্তান হলো পিতা-মাতার কাছে প্রদত্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ. الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ, وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهْوَ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ, وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْؤُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا وَالْخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ».
 ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল; তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের; সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। মহিলা দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহের (তার সম্পদ ও সন্তানের); সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। ভৃত্যও একজন দায়িত্বশীল, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার মুনিবের সম্পদ সম্পর্কে। (এক কথায়) তোমরা সবাই দায়িত্বশীল, আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে।’
(বুখারী:৭১৩৮; তিরমিযী : ১৭০৫)
অনেক পিতা-মাতাই কিন্তু সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ববান নই। আরও বাস্তব কথা হলো, আমরা নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল-ই নই। কেউ হয়তো প্রিয় এই সন্তানদের স্রষ্টা আল্লাহর হুকুম মতো জীবন পরিচালনাই করি না আর যারা করি, তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে অবগত-ই নই।
তাই দেখা যায়, সমাজের মধ্যে শুধু সন্তানের দৈহিক চাহিদার তত্ত্বাবধান করা হয়। তার আত্মিক চাহিদার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ-ই করা হয় না। অথচ এর গুরুত্ব প্রথমোক্তটির চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। দৈহিক চাহিদাকে পরিতৃপ্তি দিতে পারে কেবল আত্মা। পক্ষান্তরে দৈহিক চাহিদার অপূর্ণতা সত্ত্বেও আত্মা পারে সুখী হতে।
ইসলাম তাই শিশুর উভয় চাহিদার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে। পিতা-মাতাকে উভয় দিক তত্ত্বাবধান করতে  নির্দেশনা প্রদান করেছে। সন্তানকে আত্মিকভাবে ঋব্ধ ও ঔশ্বর্যমণ্ডিত করার ইঙ্গিত পাই আমরা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে।
কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
 ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا وَقُودُهَا ٱلنَّاسُ وَٱلۡحِجَارَةُ﴾ [التحريم:]
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও, যার জ্বালানি হবে মানুষ ও পাথর।’ (তাহরীম : ০৬)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘অর্থাৎ, তাদেরকে আদব শিক্ষা দাও এবং ইলম শেখাও।’
(তাফসীর ইবন কাসীর, উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
এদিকে বৈষয়িক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় তথা নৈতিক শিক্ষাদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
 «مُرُوا أَوْلاَدَكُمْ بِالصَّلاَةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرِ سِنِينَ وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِى الْمَضَاجِعِ».
‘তোমাদের সন্তানদের সাত বছর হলে তাদেরকে নামাজের নির্দেশ দাও, তাদের বয়স দশ বছর হলে এ জন্য তাদেরকে প্রহার করো এবং তাদের পরস্পরের বিছানা পৃথক করে দাও।’
(আবূ দাউদ: ৪৯৫; মুসনাদ আহমদ: ৬৬৮৯)
ইমাম গাজালী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
 اعلم أن الطريق في رياضة الصبيان من أهم الأمور وأوكدها، والصبي أمانة عند والديه، وقلبه الطاهر جوهرة نفيسة خالية عن كل نقش وصورة، وهو قابل لكل مانقش ومائل إلى كل مايمال إليه، فإن عوِد الخير وعلمه نشأ عليه وسعد في الدنيا والآخرة، وشاركه في ثوابه أبوه وكل معلمٍ له ومؤدب، وإن عوِد الشر وأهمل إهمال البهائم شقى وهلك وكان الوزر في رقبة القيِم عليه والوالي له،..
‘জেনে রাখ, শিশু প্রতিপালন পদ্ধতি একটি অতি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। আর সন্তান তার পিতা-মাতার কাছে আমানত স্বরূপ। তার পবিত্র অন্তর অমূল্য মাণিক্য, যেকোন নকশা বা ছবি থেকে যা মুক্ত। ফলে তা যেকোন নকশা গ্রহণে প্রস্তুত এবং তাকে যার প্রতিই ধাবিত করা হবে সে দিকেই সে ধাবিত হয়। তাই তাকে ভালোয় অভ্যস্ত করা হলে, সু-শিক্ষায় প্রতিপালন করলে, সেভাবেই সে গড়ে উঠবে। ইহকালে ও পরকালে সে সুখী হবে। তার নেকীতে তার পিতা-মাতা এবং তার প্রত্যেক শিক্ষক ও শিষ্টাচারদানকারীই অংশীদার হবেন। পক্ষান্তরে তাকে খারাপে অভ্যস্ত করা হলে, তাকে পশুর ন্যায় অবহেলা করা হলে, সে হবে হতভাগ্য ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর এর দায় বর্তাবে তার কর্তা ও অভিভাবকের ওপর।’
(ইহয়াউ উলুমিদ্দীন:৩/৬২)
সন্তানকে রক্ষা করার উপায় হলো, তার পিতা-মাতা তাকে শিষ্টাচার সম্পন্ন, সভ্য ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী বানাবে এবং তাকে অসৎ সঙ্গ থেকে বিরত রাখবে। তার মাঝে বুদ্ধির উন্মেষ লক্ষ্য করা মাত্র উত্তমরূপে তাকে পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করতে শুরু করবে। বুদ্ধির এ উন্মেষের সূচনা লাজুকতার প্রাথমিক প্রকাশের মাধ্যমে। কারণ, যখন সে লজ্জা পায়, সলাজ হয় এবং কোনো কিছু বর্জন করে, তা কেবল তার উপর জ্ঞানের আলো পড়ার কারণেই করে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি তার জন্য একটি উপহার এবং সুসংবাদতুল্য, যা স্বভাবের সুস্থতা ও হৃদয়ের স্বচ্ছতা প্রমাণ করে। এটি পরিণত বয়সে তার বুদ্ধির পূর্ণতারও ইঙ্গিত প্রদান করে।
সুতরাং শিশুর লাজুকতাকে উপেক্ষা করা সমীচীন নয়। বরং তাকে
সু-শিক্ষিত ও মার্জিতভাবে গড়ে তুলতে এ লাজুকতা ও বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানো উচিত। প্রতিপালনের প্রাথমিক অবস্থায় যদি শিশুর প্রতি অযত্ন ও অনাদর দেখানো হয়, তবে প্রায় ক্ষেত্রেই সে অসৎ স্বভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। মিথ্যুক, হিংসুক, নিন্দুক ও তস্কর হিসেবে এবং অনর্থক কথা, অট্টহাসি, কূটচাল ও অশ্লীল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে বড় হয়। শিশুকে এসব বদ অভ্যাস থেকে বাঁচানো সম্ভব আদব ও শিষ্টাচার শেখানোর মাধ্যমে। তাকে পাঠাতে হবে দীনী শিক্ষালয়ে। সেখানে সে কুরআন-হাদীস শিখবে। মনীষীদের শিক্ষণীয় ঘটনাবলী ও জীবনালেখ্য সম্পর্কে জানবে। এতে করে তার কচি মনে মনীষীদের প্রতি  শ্রদ্ধা জন্ম নেবে।
ভাগ্যবানদের আল্লাহ উপহার দেন কন্যা সন্তান:
কন্যা সন্তান মাতা-পিতার জন্য একটি শ্রেষ্ট নেয়ামত। কন্যা সন্তানকে অশুভ মনে করা কাফিরদের স্বভাব। কন্যা সন্তানকে অপছন্দ করা খাঁটি মুমিনের পরিচায়ক নয়। কন্যা সন্তান অশুভ নয়, অকল্যানকর নয়। বরং কন্যা সন্তান জন্ম নেয়া সৌভাগ্যের নিদর্শন।
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘যার গৃহে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহন করলো, অতঃপর সে তাকে (কন্যাকে) কষ্টও দেয়নি, তার উপর অসন্তুষ্টও হয়নি এবং পুত্র সন্তানকে প্রাধান্য দেয়নি, তাহলে ওই কন্যার কারণে আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।’
(মুসনাদে আহমদ, ১:২২৩)
এই বর্ণনা দ্বারা প্রমানিত হয় যে, কন্যা সন্তান মহান আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। সুতারাং কন্যা সন্তানকে বেশি করে ভালোবাসুন। আদর-সোহাগ করুন আর মায়া-মমতা দিয়ে লালন-পালন করুন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি আরো বলেন;
مَنْ كَانَ لَهُ ثَلاَثُ بَنَاتٍ أَوْ ثَلاَثُ أَخَوَاتٍ أَوْ ابْنَتَانِ أَوْ أُخْتَانِ فَأَحْسَنَ صُحْبَتَهُنّ وَاتّقَى اللّهَ فِيهِنّ فَلَهُ الجَنّةُ.
‘যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনজন বোন আছে অথবা দু’জন কন্যা সন্তান বা বোন আছে। সে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছে এবং তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করেছে। তার জন্য রয়েছে জান্নাত।’
(জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৬)
এ ফজিলতের কথা পুত্র সন্তানের বেলায় বলা হয়নি। বরং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। এজন্য আমাদের উচিত কন্যা সন্তানের লালন-পালন সন্তুষ্টচিত্তে করা।
সন্তান লালন পালনের ফজিলত:
ছেলে ও মেয়েতে বৈষম্য না করা উচিত। উভয়েই কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত স্বরূপ। সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে—তার জন্মে আনন্দ প্রকাশ করা মা-বাবার জন্য ঈমানের পরিচায়ক। আল্লাহ ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্মকে কোরআনে সুসংবাদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইয়াহইয়া আ. সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে,
‘হে জাকারিয়া! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম ইয়াহইয়া। এই নাম আগে কারো রাখা হয়নি।’
(মারিয়াম: ৭)
ছেলে জন্মের খবর যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ, মেয়ে জন্মের সংবাদও আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। যারা এই সুসংবাদে সন্তুষ্ট হতে পারে না, মনে মনে ব্যথিত হয়, আল্লাহ তাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তাদের কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, মনঃকষ্টে তাদের চেহারা কালো হয়ে যায়। তাদের যে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে; তার কারণে তারা নিজ সম্প্রদায়ের লোক থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে। তারা ভাবে, এই সন্তান রাখবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! তাদের সিদ্ধান্ত কতই না নিকৃষ্ট। (নাহল: ৫৮-৫৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ কন্যাসন্তানের মা-বাবাকে এই সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, ‘অনেক পুরুষ নারীর সমকক্ষ নয়।’ (মারিয়াম: ৩৬)
অর্থাৎ তোমাদের যে কন্যাসন্তান দান করা হয়েছে, তা অনেক পুরুষের তুলনায় উত্তম হতে পারে। অনেক পুরুষ অনেক নারীর তুলনায় অধমও হয়। রাসুলুল্লাহ সা. ছেলে-মেয়ে-নির্বিশেষে সবার প্রতি ন্যায়ানুগ আচরণ করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহকে ভয় করো, সন্তানদের ভেতর সুবিচার প্রতিষ্ঠা করো।’ (বুখারি: ২৫৮৭)
কন্যা সন্তান জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়: 
হজরত আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহা  বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ ابْتُلِيَ بِشَيْءٍ مِنَ البَنَاتِ فَصَبَرَ عَلَيْهِنّ كُنّ لَهُ حِجَابًا مِنَ النّارِ
‘যে ব্যক্তিকে কন্যা সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সঙ্গে তা সম্পাদন করেছে, সেই কন্যা সন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আড়াল হবে।
(জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হওয়া:
জান্নাতে প্রবেশ করার মাধ্যমও হলো কন্যা সন্তানের লালন-পালন করা। আবার জাহান্নাম থেকেও মুক্তি মিলবে কন্যা সন্তানের উত্তমরূপে প্রতিপালন করার দ্বারা। এর চেয়ে বড় আরেকটি ফজিলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আনাস রাযিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ عَالَ جَارِيَتَيْنِ دَخَلْتُ أَنَا وَهُوَ الجَنّةَ كَهَاتَيْنِ، وَأَشَارَ بِإصْبعَيْهِ
‘যে ব্যক্তি দু’জন কন্যা সন্তানকে লালন-পালন ও দেখাশুনা করলো (বিয়ের সময় হলে ভালো পাত্রের কাছে বিবাহ দিল) সে এবং আমি জান্নাতে এরূপ একসঙ্গে প্রবেশ করব যেরূপ এ দু’টি আঙুল। তিনি নিজের দুই আঙুল মিলিয়ে দেখালেন।
(জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৪)
কন্যা সন্তান প্রতিপালনের তিনটি ফজিলত: 
এক. আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন।
দুই. জান্নাত দান করবেন।
তিন. আল্লাহ তাকে জান্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য দান করবেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ তিনটি ফজিলত বর্ণনা করেছেন কন্যা সন্তান লালন-পালনকারীদের জন্য।
কন্যা সন্তানের জন্মে অধিক আনন্দ প্রকাশ করা:
কন্যা সন্তান জন্ম নিলে আনন্দ প্রকাশ করা; তাইতো কন্যা জন্মের সংবাদকে ‘সুসংবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে ইসলামে। আর সুসংবাদ শুনে মানুষ আনন্দই প্রকাশ করে।
এজন্য অনেক উলামায়ে কেরাম লেখেন, যেহেতু কন্যা সন্তান জন্মানোর কারণে নিজেকে ছোট মনে করা, একে অপমান ও অসম্মানের কারণ মনে করা কাফিদের কর্মপন্থা, তাই মুসলমানগণের উচিত, তারা কন্যা সন্তানের জন্মের কারণে অধিক খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করবে। যাতে কাফিরদের এ নিচু রীতির প্রতিবাদ হয় এবং এ রীতি যেন বিলুপ্ত হয়ে যায়।
কন্যা সন্তানের হকসমূহ: 
জাহেলী যুগে এ হকসমূহ থেকে কন্যা সন্তানকে বঞ্চিত করা হত। আজকালও তাদের হকসমূহ আদায়ের ব্যাপারে অবহেলা করা হয় অনেক জায়গায়। এজন্য তাদের হকগুলো বুঝে নেয়া জরুরি। যেন এ ব্যাপারে আমাদের অবহেলা না হয়। ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা। কারো পুত্র সন্তানের প্রতি ভালোবাসা বেশি আবার কারো কন্যা সন্তানের প্রতি এমন যেন না হয়।
অধিকাংশ লোকের পুত্র সন্তানের তুলনায় কন্যা সন্তানের প্রতি ভালোবাসা কম থাকে। ভালোবাসা ও মোহাব্বাতের সম্পর্ক হলো অন্তরের সঙ্গে। এতে মানুষের ইচ্ছার দখল নেই। এজন্য এ ক্ষেত্রে সমতা রক্ষার বিষয়ে মানুষ বাধ্যও নয়। তবে ভালোবাসা প্রকাশ মানুষের ইচ্ছার অধীন। এ ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা আবশ্যক।
সন্তান লালন পালনের পদ্ধতি:
শিশুকে অহেতুক বিষয় শেখানো উচিত নয় :
অনেক মা-ই শিশুর মূল্যবান সময়কে অহেতুক কাজের মধ্যেই পার করে দেন। যখন তাকে কালিমা শেখানো দরকার, তখন শিক্ষা দেওয়া হয় হাট্টি মা টিম টিম…।’
আর এসব নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যেন শিশুর প্রতি এগুলোই তাদের কর্তব্য। ফলে সেই শিশু ঈমানি শিক্ষা আর পায় না। আল্লাহর প্রতি তার আস্থা সৃষ্টি হয় না। এমনকি নবীর পরিচয়ও সে জানতে পারে না। আফসোস!
ছোটদের প্রতি কোমল হতে হবে:
বড়দের কাছ থেকে আমরা ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করি। তাহলে ছোটদের প্রতি কেন আমরা তা করি না? আমরা যদি আমাদের ছোটদের সঙ্গে ভালো ও কোমল ব্যবহার করি, তাহলে  বড়রাও আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। নবীজির শিক্ষা হলো, কোমলতা অবলম্বন করো। কঠোরতা পরিহার করো। (মুসলিম: ১৭৩২)
বাস্তবেও কোমলতায় যে ফায়দা হয়, কঠোরতার দ্বারা তা হয় না। সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে ছোটরা সব কথাই শোনে। আর ধমক দিয়ে কিছু বললে তারা আরো উল্টো বেঁকে বসে।
রাগান্বিত অবস্থায় প্রহার না করা:
থানভি রহ. বলেন, ‘রাগান্বিত অবস্থায় কখনো শিশুকে প্রহার না করা। শাস্তির প্রয়োজন হলে রাগ প্রশমিত হওয়ার পর চিন্তা-ভাবনা করে শাস্তি দেওয়া। মুফতি শফি রহ. বলতেন, অন্যান্য গুনাহ তো তাওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের উপর জুলুম করা হলে এর ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কেননা এটা বান্দার হক। আর বান্দার হক শুধু তাওবার দ্বারা মাফ হয় না। আগে যার হক নষ্ট করা হয়েছে, তার কাছে মাফ চাইতে হয়। শিশুর কাছ থেকে মাফ পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ নাবালেগের ক্ষমা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি শিশু যদি মুখে বলেও যে আমি মাফ করলাম, তবু তা গ্রহণযোগ্য নয়।
শিশুর ত্রুটি ছোট থেকেই সংশোধন করতে হবে:
শিশুদের ছোট ছোট ত্রুটি, অহংবোধ, অন্যকে কষ্ট দেওয়ার প্রবণতা শৈশবেই সংশোধন করা উচিত। কাউকে গালি দিলে কিংবা কোনো আঘাত করলে সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে মাফ চাইয়ে নেওয়াতে হবে। যাতে সে অন্যায়টা বুঝতে পারে এবং তার ভেতরে মাফ চাওয়ার গুণ তৈরি হয়।
মাকে হতে হবে দায়িত্ববান:
শিশুর মনমানসিকতা, ধ্যান-ধারণা, বোধ-বিশ্বাস, রুচিবোধ, শিক্ষা-দীক্ষা, স্বভাব-সভ্যতা, ভদ্রতা তথা ভালো গুণগুলো একজন মা-ই সহজে তাঁর সন্তানের মধ্যে প্রবেশ করাতে পারেন। ইতিহাসের পাতায় আমরা যত মহান ব্যক্তিকে দেখতে পাই, তাঁদের সফলতার পেছনে দেখা যায়, মায়ের অবদান বেশি। মা হলেন সন্তানের জন্য পাঠশালার প্রথম শিক্ষক। তাই মা’কে হতে হবে সন্তানের প্রতিটি ক্ষেত্রে সজাগ ও দায়িত্ববান।
আল্লামা ইকবাল বলতেন যে, বিলাত থেকে ফেরত আসার পরও যখন আল্লাহকে ভুলিনি, তখন আশা করা যায় আর ভুলব না। যখন লোকেরা বলত, ইকবাল! বিলাতের ওই চাকচিক্য দেখেও তুমি কী করে আল্লাহকে স্মরণ রাখতে পারলে? উত্তরে বলতেন, সেই ছোটকালে আমার মা আমার চোখে যে মুহাম্মদি সুরমা-ইসলামী শিক্ষা লাগিয়ে দিয়েছেন, তার বরকতে এত কিছু সত্ত্বেও আমি আল্লাহকে ভুলিনি।
মা-বাবার কাজের প্রভাব:
মা-বাবার সব কাজের প্রভাব পড়ে সন্তানের উপর। সন্তান যদি বাবাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে আদায় করতে দেখে, তাহলে সন্তানও মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করবে। তেমনিভাবে সন্তান যদি মাকে জায়নামাজে দেখে, তাহলে অবুঝ বয়সেও সে মায়ের সঙ্গে নামাজ পড়বে, সেজদা দেবে। মূলত সন্তান শিশুকাল থেকে মা-বাবাকে যেমন দেখবে, নিজের জীবনকে তেমনভাবেই সাজাবে।
গর্ভবতী মায়ের কর্মের প্রভাব:
গর্ভকালীন মায়ের সব কর্মের প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। মায়ের একটু সচেতনতা দ্বারা সন্তান সুস্থ, সুদর্শন, বুদ্ধিমান, নেককার ও দ্বীনদার হতে পারে। আবার সামান্য একটু অসচেতনতা দ্বারা সন্তান অসুস্থ, ত্রুটিপূর্ণ, দুর্বল, নির্বোধ ও বে-দ্বীন হতে পারে। তাই এ অবস্থায় মা’কে বেশি বেশি নেক আমল করতে হবে। গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত নামাজের পাশাপাশি নফল নামাজও পড়তে হবে। রাত্রি জাগরণ বর্জন করতে হবে। সব সময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করতে হবে। সুযোগ পেলেই কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, হাফেজা ও কোরআন তিলাওয়াতকারী মায়ের সন্তান অতিমাত্রায় মেধাবী হয়। একজন নিষ্ঠাবান ‘মা’ দ্বারা একটি নিষ্ঠাবান জাতিরও জন্ম হয়।
কান্না থামানোর জন্য মিথ্যা না বলা:
শিশুর কান্না থামানোর জন্য বা তার কাছ থেকে কোনো কাজ আদায় করার জন্য মিথ্যা বলা জায়েজ নয়। আবদুল্লাহ ইবনে আমের রা. এর বর্ণনা, একবার আমার আম্মা কিছু একটা দেবেন বলে আমাকে কাছে ডাকলেন। নবীজি সা. তখন আমাদের বাড়িতে বসা ছিলেন। তিনি আমার আম্মাকে বললেন, তুমি কি সত্যিই তাকে কিছু দেবে? আম্মা বললেন, হ্যাঁ! তাকে খেজুর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল। নবীজি বললেন, যদি তুমি তাকে কিছু না দিতে তবে তোমার এ কথাটি মিথ্যা বলে গণ্য হতো।
(আবু দাউদ: ৪৯৯১)
শিশুর মনে আল্লাহর ভয় তৈরী করা:
শিশুর কচি অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে দিতে হবে। মা-বাবা যদি শিশুকে শাসনের ভয় দেখিয়ে বা অন্যরা খারাপ বলবে এই ভয় দেখিয়ে মন্দ অভ্যাস থেকে নিবৃত্ত করতে চান, তবে এটা হবে সাময়িক। মা-বাবার অগোচরে, যেখানে শাসন কিংবা লোকলজ্জার ভয় থাকবে না, সেখানে শিশু দ্বিতীয়বার এ ধরনের কাজে উৎসাহী হতে পারে। কিন্তু যদি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে, এটা পাপ। এমন করলে আল্লাহ নারাজ হবেন। আল্লাহ সব সময় সবাইকে দেখছেন। কোনো কিছুই তার দৃষ্টির আড়ালে নয়। এবং তার অন্তরেও আল্লাহর ভয় বসে যায়, তাহলে শিশুর সব বদ-অভ্যাস স্থায়ীভাবে ঠিক হয়ে যাবে।
মা-বাবার প্রথম কর্তব্য:
শিশু যখন কথা বলতে শুরু করে, তখন তাকে সর্বপ্রথম ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদ’; এরপর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ ও ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া। কোরআন শিক্ষা দেওয়া। দ্বীনের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি শিক্ষা দেওয়া। মাঝে মধ্যে তাকে নবী-সাহাবা ও মনীষীদের উপদেশমূলক ঘটনা শোনানো।  অমার্জিত পোশাক থেকে বিমুখতা সৃষ্টি করা। পাঠশালায় যাওয়ার ব্যাপারে কখনো শিথিলতা প্রদর্শন না করা। সন্তানের সামনে উচ্চস্বরে কথা না বলা। যথাসম্ভব তাকে চোখে চোখে রাখা, যাতে কোনো খারাপ সঙ্গ গ্রহণ না করে বসে। তাকে ব্যস্ত রাখার জন্য হাতে ফোন বা ট্যাবের মতো যন্ত্র ধরিয়ে দেওয়া তার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই এই প্রবণতা থেকে দূরে থাকা।
ছোট থেকেই বিনয় শেখাতে হবে:
সঙ্গী-সাথিদের সম্মান করা। কথাবার্তায় কোমলতা। ত্যাগেই সম্মান; গ্রহণে নয়। মানুষের জিনিস নেওয়া নিন্দনীয়। অন্যদের দিকে পিঠ দিয়ে না বসা। কারো পায়ের উপর নিজের পা না রাখা। বড়দের প্রশ্নের শুধু জবাব দেওয়া; যতটুকু জিজ্ঞেস করা হয় শুধু ততটুকু বলা। বড়দের কথা মনোযোগসহ শোনা। বড় কেউ এলে তার সম্মানে উঠে জায়গা খালি করে দেওয়া। কুসঙ্গ থেকে দূরে থাকা। মা-বাবা, শিক্ষক, গুরুজন এবং আত্মীয়-অনাত্মীয়, চেনা-অচেনা সব মুরব্বিকে মান্য করা।
শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা:
শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য নবী সা. বলেছেন, ‘তোমার সন্তানকে অন্যের উপর নির্ভরশীল করে রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল রেখে যাওয়া অনেক ভালো।’ (বুখারি: ৬৭৩৩)
তাই বৈধ পন্থায় তার জন্য কিছু সম্পদ রেখে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তাকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। সে শিক্ষিত হলে সারা জীবনই সচ্ছল থাকবে, পরনির্ভরশীল হতে হবে না।
সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া: সন্তানকে সুন্দর আচার-ব্যবহার শিক্ষা দেওয়ার প্রধান দায়িত্ব মা-বাবার উপর। কিন্তু আজকাল অধিকাংশ বাবা-মা অফিস-আদালতের কাজকর্মে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, সন্তানকে সময়ই দিতে পারেন না। সকালে সন্তানকে ঘুমে রেখে অফিসে যান। আবার বাসায় এসে ঘুমে পান। ছুটির দিন না হলে সাধারণত দেখা-সাক্ষাৎই হয় না। সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব বাসার কাজের বুয়াদের উপর ছেড়ে দেন। ফলে সে সারা দিন যার কাছে থাকছে, তার আচার-আচরণ শিখছে। শিক্ষিত বহুগুণের অধিকারী মা-বাবার অনেক কিছুই শেখা হয় না। সুতরাং মা-বাবার সঙ্গ প্রদানের কোন বিকল্প নেই।
শিশুকে ভালো কাজে উৎসাহ দেওয়া:
শিশুর কোনো সুন্দর আচরণ বা প্রশংসনীয় কাজ চোখে পড়লে, তার প্রশংসা করতে হবে। তাকে খুশি করার মতো কিছু পুরস্কার দিতে হবে।মানুষের সামনে করতে হবে তার প্রশংসা। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যখন সে কিছু করবে প্রথমবারের মতো, তখন তা উপেক্ষা করতে হবে। গোপন রাখতে হবে; অন্যের সামনে প্রকাশ করা যাবে না। বিশেষত বাচ্চাটিই যখন চাইবে সেটিকে গোপন রাখতে। অন্যের কাছ থেকে আড়াল করতে। যদি দ্বিতীয়বার এ কাজের পুনরাবৃত্তি করে, তবে তাকে গোপনেই শাসাতে হবে। বলে দিতে হবে, এমন কাজ তুমি দ্বিতীয়বার করা থেকে বিরত থাকবে। অন্যথায় মানুষের সামনে তোমাকে লজ্জা দেয়া হবে।
তাকে শাসন করার সময় কখনো অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এতে করে তার পক্ষে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার শোনা এবং মন্দ বিশেষণ হজম করা সহনীয় হয়ে উঠবে। তার অন্তরে কথার প্রভাব হ্রাস পাবে। তার হৃদয়ে কথার প্রভাব যেকোন মূল্যে বজায় রাখতে হবে। তাকে কেবল মাঝে মধ্যেই ভর্ৎসনা করা যাবে। মা তাকে বাবার ভয় দেখাবেন। মন্দ কাজ থেকে ধমকাবেন।
বাবা-মা’র কোন কিছু নিয়ে তাকে সঙ্গী-সাথী বা বন্ধু-বান্ধবের সামনে বড়াই করতে নিষেধ করবেন। তাকে বরং বিনয়, সাথীদের সম্মান এবং তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় কোমলতার স্বভাবে গড়ে তুলবেন। তাকে শেখাবেন- ত্যাগেই সম্মান; গ্রহণে নয়। মানুষের জিনিস নেয়া নিন্দনীয়। তা এমনকি নিচুতা ও হীনতার পরিচায়ক। যদি গরিব ঘরের সন্তান হয়, তবে তাকে শেখাতে হবে পরের জিনিস নেয়া এবং পরের সম্পদে লোভ করা অবমাননা ও লাঞ্ছনাকর।
তাকে অভ্যস্ত করাবেন যাতে সে সবার সামনে থুথু না ফেলে। অন্যদের উপস্থিতিতে হাই না তোলে। অন্যদের দিকে পিঠ দিয়ে না বসে। কারো পায়ের ওপর নিজের পা না রাখে। থুতির নিচে হাতের তালু না রাখে এবং কাঁধে হেলান দিয়ে মাথা না রাখে। কারণ, তা অলসতার আলামত। তাকে আদব শিক্ষা দিবেন। বেশি কথা বলা থেকে বারণ করবেন। এটি যে এক ধরনের বেয়াদবী, তাও তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। কথা সত্য হোক বা মিথ্যা, তা নিয়ে তাকে মাথা ছুয়ে কসম করতে নিষেধ করবেন। যাতে শৈশব থেকেই তার এ বদ অভ্যাস গড়ে না ওঠে। শিশুকে নিষেধ করতে হবে, বড়দের সামনে কথার সূচনা না করতে। অভ্যস্ত করতে হবে যে, সে যেন বড়দের প্রশ্নের-ই শুধুমাত্র জবাব দেয়। যতটুকু জিজ্ঞেস করা হয় কেবল ততটুকু-ই বলে। তাঁরা কথা বললে মনোযোগসহ যেন শোনে। বড় কেউ এলে তার সম্মানে উঠে জায়গা খালি করে দেয়। তাদের সামনে যেন না বসে।
তাকে বিরত রাখবেন বাজে কথা ও অশ্লীল বাক্যোচ্চারণ থেকে। অন্যকে গালমন্দ করা ও অভিশাপ দেয়া থেকে।
যার মুখ থেকে সবসময় গালি উচ্চারিত হয়, তার সঙ্গ ত্যাগ করতে বলবেন। কারণ, খারাপ সঙ্গীদের থেকে তার মাঝে যেন বাদ অভ্যাস ঢুকতে না পারে। বাচ্চাদের শিষ্ট-ভদ্র বানানোর প্রধান উপায়ই হলো তাকে কুসঙ্গ থেকে দূরে রাখা।
বলাবাহুল্য, পরিচর্যা যা করার প্রতিটি জিনিসের প্রাথমিক পর্যায়েই তা করতে হয়। শিশুকে মূলত ভালো-মন্দ উভয় চরিত্রের মিশ্রণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তার পিতা-মাতাই তাকে ভালো-মন্দের যে কোনটির দিকে ধাবিত করেন। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা‌’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ ، أَوْ يُمَجِّسَانِه ».
 ‘প্রতিটি শিশু (ইসলাম) ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। তার পিতা-মাতাই তাকে ইহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায় অথবা অগ্নিপূজক বানায়।’
(বুখারী :১২৯২; ইবন হিব্বান :১২৯; বাইহাকী :১১৯১৮)
অতএব আল্লাহর এ আমানত সম্পর্কে আমাদের সজাগ ও আরও বেশি দায়িত্ববান হতে হবে। সন্তানদের বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক খোরাকের প্রতিও নজর রাখতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে তার নির্দেশ মতো সন্তান মানুষ করার তাওফীক দান করুন।
আর সবসময় নামাজ আদায় করে সন্তানের জন্য এই দোয়া করবেন;
﴿رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا﴾
‘হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন’। (ফুরকান : ৭৪)
শেষ কথা:
কোন সমাজকে সংস্কার ও পরিশুদ্ধ করতে হলে, গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপটি নিতে হবে তা হচ্ছে নবীনদেরকে লালন-পালন ও তাদেরকে সার্বিকভাবে খারাপ কাজ ও কর্মকাণ্ড থেকে হেফাযত করা। আর এই লালন-পালন করার দায়িত্ব পরিবারের পুরুষ ও মহিলা সবার উপর। কারণ, পরিবারের প্রত্যেকটি লোক দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে।
সন্তান প্রতিটি বাবা-মায়ের কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তেমনি সন্তানের কাছে তার পিতা-মাতা আশীর্বাদস্বরূপ। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সন্তান যতই বয়োবৃদ্ধ হোক না কেন বাবা-মায়ের কাছে তারা সর্বদা শিশুর মতো। আজন্ম সন্তান পিতা-মাতার কাছে স্নেহ, আদর আর দয়া-মায়াতেই লালিত-পালিত হয়। পিতা-মাতা কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করেন না, বরং শত দুঃখ-কষ্ট পেলেও সন্তানের জন্য দোয়া করে থাকেন। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসা যতই আত্মিক হোক না কেন, জনক-জননী হিসেবে সন্তানের অধিকার ও তাদের প্রতি মাতা-পিতার কর্তব্য পালনে যথেষ্ট দায়দায়িত্ব পালন করতে হয়। বাবা-মা ও অভিভাবকেরা আন্তরিক ভালোবাসা ও স্নেহের পরশে সন্তানদের সুন্দর জীবন গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সন্তান লালন-পালনে বাবা-মায়ের অধিকার সচেতন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যথাযথ সচেষ্ট হওয়ার তাওফিক দিন। আমীন।