ষড়যন্ত্রের এই সময়ে নিজেদের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সজাগ রাখুন!

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ২১ ২০১৯, ১৭:৪৬

আরজু আহমাদ

ক.
নেত্রকোনায় যে কাটা মাথা পাওয়া গেছে- সেটা সাত বছরের একটা ফুটফুটে বাচ্চার, নাম সজীব। নির্জীব বিচ্ছিন্ন মাথাটা মানুষ পিচের রাস্তায় রেখে ছবি তুলেছে।

আমি আজ ঘটনাক্রমে সে সময় নেত্রকোনায় ছিলাম। অনেকটা দেখেছি, বাকিটা প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে দেখেছি। একটা যুবক ব্যাগ নিয়ে ঘুরাফেরা করছিল।

ব্যাগ থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়তে দেখে লোকেরা যুবকটিকে ধাওয়া দেয়৷ পরে গণপিটুনিতে মারা যায়।

যে যুবকটি মারা গেছে তার নিথর দেহ আমি দেখেছি। একটা মানুষ খুন করে ফেলার সামর্থ্য তার ছিল- এ বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়! কিছু প্রশ্ন বড়ো আকারে এখানে উঠে আসে-

১। সমস্ত অপরাধের মোটিভ থাকে। মোটিভ অব মার্ডারই বা কি? কাটা মাথার হেন কোনও বাণিজ্যিক মূল্য নাই যে এর জন্য খুন করতে হবে! আর কোনও সেতু গড়তেও মাথার দরকার নিশ্চয়ই হয় না।

২। তবে যদি খুন কোনও বিরোধেই হয়ে থাকে তবে কাটামাথা নিয়ে ঘুরাফেরার করারই বা দরকার কি? নেত্রকোনায় এখন উন্মত্ত মগড়া আর কংস। বিশাল স্রোত। ছুঁড়ে ফেললেই শেষ।

৩। খুনের যে অস্ত্র, সে অস্ত্রও পাওয়া যায় নি। ফলে অস্ত্রটা যে লুকোনো গেল। সঙ্গে নিশ্চয়ই মাথাটাও লুকোনো যেত।

৪। যে খুনের অস্ত্র আড়াল করতে পারে। খুন করতে পারে, সে প্রফেশনাল। নিশ্চয় কোনও মানুষের মাথা কাটা সহজ কাজ না। একটা বাচ্চাকে ধরতে হয়েছে। জনমানব শূণ্য স্থানে নিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে খুন করতে হয়েছে। এই কাজ একা করা অসম্ভব। বাকিরা কোথায়?

৫। তাহলে একজন প্রফেশনাল কিলার, যে খুনে সিদ্ধহস্ত সে কাটা লাশ সাধারণ ব্যাগে নিয়ে ঘুরবে যেটা এতটাই ট্রান্সপারেন্ট যে কর্তিত মাথা বুঝতে পারা যায় ব্যাপারটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?

৬। যদি অর্থের জন্য খুন হয় তবে নিঃসন্দেহে এর ম্যাক্সিমাম ব্যবহার করার চেষ্টা থাকবে। সেক্ষেত্রে বাচ্চাটা পাচার করেও টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু তা হয় নি। ফলে এটা কোনও ট্র‍্যাফিকিং কেস না। তবে কি?

৭। তাছাড়া, যদি মাথার দরকার হয় তবে ট্রান্সপ্লান্ট করার যোগ্য অন্যসব হিউমেন অর্গান, বোন মেরু, চোখ, লিভার, কিডনির জন্য নিশ্চয়ই কোনও হাসপাতালে নিয়েও এই কাজ করা যেত। এতে ম্যাক্সিমাম বেনিফিট পাওয়া যেত। সেটা না করে শুধু মাথার কি দরকার?

ভারতে একবার ক্লিনিকের ছদ্মাবরণে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের চক্রে খোদ দেশটির বহু নামকরা ডাক্তাররা জড়িয়ে ছিলেন, মামলাটা ভারতে বহুল আলোচিত ছিল। এখানে কিন্তু সেরকম কিছুর জন্যই খুন হয় নি।

তাছাড়া, যুবকটির এইভাবে কাটামাথা নিয়ে শহরের আশপাশ এলেমেলো ঘুরাফেরা, কাটা মাথার অস্তিত্ব বুঝা যায় এমন ব্যাগ নিয়ে চলাফেরা সন্দেহ জাগায় সে কি আদৌ খুনটা করেছে, নাকি তাকে গিনিপিগ বানানো হয়েছে?

এই যে একটা প্যানিক ছড়ানো হলো। এরপর যে কাউকে ছেলেধরা বলে গণপিটুনি দেওয়া শুরু করলে আমরা কি আগপাছ ভাবব? নাকি প্রত্যেকেই সেই খুনে শামিল হব? সম্ভবত হব। বহু নিরপরাধ মানুষ খুনের শিকার হবে। দেশে একটা মৎসান্যায় শুরু হবে।

ল এন্ড অর্ডার ভেঙে পড়বে। চলাফেরা হয়ে উঠবে ভীতিকর। যে কারো জীবন অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে। আপনাদের মনে থাকবার কথা, নানাবিধ কারণেই সেসময়টা আলোচিত।

২০১০ সাল, যুদ্ধপরাধ বিচার শুরু ও নানাবিধ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা। সে বছরের রমজান মাস ছিল আগস্টে। খুব গুজব ছড়লো ছেলেধরা নিয়ে। মানুষ যাকে তাকে গলাকাটা বলে পিটাতে শুরু করলো। দুইজন নিরপরাধ মারা গেল। চাঁটগাও ও বাকলিয়া এলাকায়।

আরও ৩০ জন মৃতপ্রায় অবস্থায় পৃথক পৃথক ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এইসব ভিক্টিমদের মধ্যে একজন মাদ্রাসা শিক্ষকও ছিলেন। তারাবীহ পড়িয়ে ফেরার পথে যাকে ছেলেধরা বলে গণপিটুনি দেওয়া হয়।

দেশে এমনিই বহুবিধ সঙ্কটের মধ্যে কী কারণে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে, জনভীতি আরও বৃদ্ধি করতে, জান ও মালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে কারা এসব কাজ করছে তা নির্ণয় করা দরকার।

এসবে দায়ী যেই হোক, আইনশৃঙ্খলার হেন অবনতি, নিরপরাধ শিশুর প্রাণনাশ, সাধারণ মানুষকে গণধোলাইয়ের নামে হত্যার মত বিষয় বন্ধ করার দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রযন্ত্রের এ কাজে ব্যর্থতা ঢাকার সুযোগ নাই।

এই যে, ছেলেটা গণপিটুনিতে খুন হল। থানা থেকে মোটের উপর পাঁচ মিনিটের বেশি দূরত্ব নয় এমন একটা জায়গায় এমন ঘটনা ঘটল অথচ পুলিশ পৌঁছুতে পৌঁছুতে যুবকটার মারা যাওয়া পর্যন্ত সময় লাগলো! এটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার।

কি নির্মমভাবে তাকে পিটিয়ে পিটিয়ে মারা হলো। আমি কোনও নির্বিচার হত্যাকে সমর্থন করি না। এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং অবিচারের সুযোগ বাড়ায়।

খ.
আমাদের সঙ্কটটা হচ্ছে- আমরা চিন্তা ও ভাবনা বিহীন এত দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছুই, যা আমাদের আরও গভীর সমস্যায় ফেলে দেয়।

বরগুনায় রিফাত হত্যাকাণ্ডে মিন্নীর পক্ষে আদালতে আইনজীবী দাঁড়ায় নি। এমপিপুত্রের নাকি হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের ফেসবুক পাড়ার হুমকিও কি কম ছিল?

নুসরাত হত্যায় আসামীপক্ষের আইনজীবীদের ছবি পোস্ট করে আমরা জঘন্য কথা বলেছি। ফলে সামাজিক অনিরাপত্তা তৈরি হয়েছে। এবার তাই মিন্নীর জন্য আইনজীবী দাঁড়ায় নি। অথচ একজন অভিযুক্তের ন্যায়বিচারের জন্য এটা দরকার। এটা তার হক্ব। সে হক্ব ব্যাহত হয়েছে। ইসলাম আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার অবাধ রাখতে বলে।

গ.
দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা সরল বিশ্বাসে দূর্নীতি করলে অপরাধ হবে না’। কথাটার জন্য ফেসবুকে তাকে ধুয়ে দিচ্ছি আমরা। অথচ উনি যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। এ দেশের বিদ্যমান আইনের দৃষ্টিতে।

এ দেশের যে পেনাল কোড, যে সমস্ত আইন সেখানে এমনকি সরল বিশ্বাসে কোনও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী খুন করলেও সেটা আইনে দায়মুক্তি পায়। ইন্ডেমেনিটি দেয়।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়মুক্তির জন্য সংবিধানের যে ৪৬ অনুচ্ছেদ। পেনাল কোডের সংশ্লিষ্ট ধারা এবং সংযুক্ত সমস্ত আইনে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কর্মের’ দায়মুক্তি সংক্রান্ত বিধান আছে। ফলে তিনি তো তার সীমাবদ্ধতার কথাই বলেছেন। সুতরাং আমাদের উচিত ছিল আমরা এই অনাচারমূলক, বৈষম্যবাদী বিধানের বিলোপের দাবি নিয়ে হাজির হব।

অথচ আমরা একজন ব্যক্তির সত্য কথা বলার জন্য তাকেই অপরাধী সাব্যস্ত করছি। গাল দিচ্ছি। সমস্যা যেখানে সেটা নিয়ে কথা বলছি না এটাও জুলুম।

ঘ.
সব ধরনের জুলুম ও অবিচার থেকে আমাদের সাবধান হতে হবে। এই যে ষড়যন্ত্রের সময়, এই সময়ে নিজেদের ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় সজাগ রাখুন। সন্তানদের দিকে খেয়াল রাখুন।

আসুন নিজেরা আমরা সাবধান হই। হুজুগের বসে কোনও গণপিটুনির মাধ্যমে খুন ও জুলুমে আমরা শামিল না হই। মনে রাখতে হবে, সমস্ত কাজের জন্যই আমরা জিজ্ঞাসিত হব। ফিতনা ভয়াবহ। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।