শুক্রবারের বিশেষ আয়োজন: শিল্প-সাহিত্য

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ১৭ ২০২০, ১৪:৩৮

স্মৃতিগদ্য

হুমায়ূন আহমেদের মাকড়সাভীতি এবং ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম

মাজহারুল ইসলাম

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কেমোথেরাপির ক্যানস্টার খোলার জন্য ১২৭৫ ম্যানহাটনে যাচ্ছি আমরা। সেন্ট্রাল পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা বিশাল আকারের ভবন দেখিয়ে তিনি বললেন, মাজহার, এটা হলো আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি। তুমি অবশ্যই দেশে ফিরে যাওয়ার আগে একবার এটা দেখে যাবে। গত বছর আমি যখন বেড়াতে এসেছিলাম, তখন এটা দেখেছি। পৃথিবীর বহু বড় বড় মিউজিয়াম দেখেছি, কিন্তু এই মিউজিয়াম দেখার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অন্যরকম।

আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, স্যার এবার না, পরে কোনো একসময় দেখে নেব। এবার তো বেড়াতে আসি নি।

আমার উত্তরটা মনে হয় তাঁর পছন্দ হলো না। দিনটা ছিল ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১১। আমরা ক্যানস্টার খুলে বাসায় ফিরে এলাম।

ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে স্বর্ণা ও দুই পুত্র আমিয়-অন্বয়কে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় নিউইয়র্কে এলাম। মাঝখানে ক’দিনের জন্যে দেশে গিয়েছিলাম। মুনিয়া মাহমুদ ও নূরুদ্দীন দম্পতির সঙ্গে দেশে যাওয়ার আগে পরিচয় হয়। এবার আসার পর ফোনে কথা হয়েছে। বারবার বলেছেন, মাজহার ভাই, যে-কোনো প্রয়োজনে আমাদের বলবেন। নূরুদ্দীন এখন এক শ’ ভাগ বেকার। সারা দিন ঘরে বসে থাকে। কাজেই কোনোরকম সংকোচ করবেন না। আপনারা এখানে বিপদের মধ্যে আছেন।

একদিন ফোন করে মুনিয়াকে বললাম, বাসার কিছু গ্রোসারি লাগবে। বাচ্চাদের ডায়পার, দুধ কিনতে হবে। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। একটু সময় দিতে পারবেন ? মুনিয়া বললেন, কখন বের হবেন বলেন। আমি নূরুদ্দীনকে নিয়ে চলে আসছি। আমাদের দশ মিনিট সময় লাগবে।

সময়মতো তাঁরা গাড়ি নিয়ে চলে এলেন। স্ত্রী স্বর্ণা ও দুই পুত্র অমিয়- অন্বয়কে নিয়ে আমি বের হলাম। গাড়িতে অল্প সময়ের মধ্যেই স্বর্ণার সঙ্গে মুনিয়ার ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল।

মুনিয়া আমাকে বললেন, মাজহার ভাই, বাচ্চাদের ও ভাবিকে নিয়ে একদিন অবশ্যই ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম দেখে আসবেন। ওখানে গেলে বাচ্চারা অনেক মজা পাবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডায়নোসর আছে। অনেক শিক্ষণীয় বিষয়ও আছে। আমার কাছে অনেকগুলো টিকিট আছে, মিউজিয়ামে কবে যাবেন বললে আমি দিয়ে দেব। টিকিট কাটার প্রয়োজন নেই। ওখানে টিকিটের বেশ দাম। একনাগাড়ে তিনি কথাগুলো বলে গেলেন।

অমিয় সাথে সাথে বলল, বাবা, আমরা কবে যাব ? আমি অমিয়কে বললাম, বাবা দেখা যাক। মুনিয়াকে বললাম, মনে হয় এবার হবে না। এবার তো স্যারকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত। তিনি অসুস্থ। তাঁকে রেখে কোথাও যেতে চাই না। তারপর বললাম, স্যারও একদিন আমাকে বলেছিলেন ওটা দেখে যেতে। হয়তো ভবিষ্যতে কখনো দেখা হবে। অমিয় আবার বলছে, বাবা আমরা যাই না কেন! স্বর্ণা অমিয়কে সুন্দরভাবে বোঝায় কেন এখন যাওয়া যাবে না।

২২ ডিসেম্বর আমরা সবাই গেলাম পিয়ার সেভেনটিনে। হুমায়ূন আহমেদের পছন্দের একটি জায়গা। নূরুদ্দীন আমাদের তাঁর গাড়িতে নামিয়ে দিয়ে এলেন।

লোয়ার ম্যানহাটনে ইস্ট রিভার ও ব্রুকলিন ব্রিজের মাঝ বরাবর ১৭ নম্বর জেটির পাশে সাউথ সী পোর্টে গ্রীক আর্কিটেকচারে তৈরি ‘পিয়ার সেভেনটিন’ অবস্থিত। মূলত এই জায়গাটি নিউইয়র্ক সিটির আদি সমুদ্রবন্দর। এখানে ট্যুরিস্টরা ভিড় জমায় আনন্দ-ফুর্তি, কেনাকাটা ও ভোজনবিলাসের খোঁজে। হুমায়ূন আহমেদ এখানে আসেন মূলত এখানকার বিশাল ফুডকোর্টে অবস্থিত প্লে জোনে তাঁর দুই শিশুপুত্রের আনন্দ উপভোগ করতে।

আজ প্লে জোন মাতিয়ে রেখেছে চারটি শিশু—অমিয়, অন্বয়, নিষাদ ও নিনিত। তাদের হইচই আনন্দের যেন শেষ নেই। হেলিকপ্টার, বাস, গাড়িতে উঠছে আর কোয়াটার ঢোকাচ্ছে। পকেটভর্তি কোয়াটার শেষ হতেই দৌড়ে আসছে একে একে সবাই। অন্বয় হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলছে, বাবা কোয়াটার, বাবা কোয়াটার। ‘কোয়াটার দাও’ পুরোটা বলারও সময় নেই। নিষাদ তাঁর বাবার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তার আরও কোয়াটার চাই। নিনিত কোনোকিছু না বুঝেই হামাগুড়ি দিয়ে একবার এদিকে, আরেকবার ওদিকে যাচ্ছে। আবার কখনো নিষাদ-অমিয়দের সাথে গাড়ি বা প্লেনে উঠে বসছে। অমিয় তার নিজের মানিব্যাগ থেকে জমানো ডলার বের করে কোয়াটার বানাচ্ছে। কাছেই একটা টেবিলে বসে বাচ্চাদের এই আনন্দ উপভোগ করছেন হুমায়ূন আহমেদ।

একপর্যায়ে সবাই ফুডকোর্টে গেলাম যার যার পছন্দের খাবার নিয়ে আসতে। হুমায়ূন আহমেদ খেলেন স্যুপ ও এক স্লাইস পিৎজা।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষে হুমায়ূন আহমেদ সবাইকে কাছে ডাকলেন। বললেন, আমি স্বর্ণা ও বাচ্চাদের জন্য একটা ট্রিপ দিতে চাই। ট্রিপটা হলো আমি সবাইকে নিয়ে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে যাব। মিউজিয়ামে ঢোকার টিকিট, দুপুরের খাবার সব আমার পক্ষ থেকে। বাচ্চারা খুব আনন্দ পাবে।

আমি যারপরনাই বিস্মিত। স্বর্ণা আর আমি চোখাচোখি করছি, কী বলব বুঝতে পারছি না। অমিয় খুবই খুশি। আমি আস্তে আস্তে বললাম, স্যার, পরে কোনো একসময় সবাই মিলে মিউজিয়াম দেখব। আপনি বলেছেন, আমরা অসম্ভব খুশি হয়েছি। অনেক টাকা খরচ হবে। এই মুহূর্তে এটা জরুরি না। তা ছাড়া আপনারা তো দেখেছেন একবার। একই জিনিস দ্বিতীয়বার দেখতে আপনাদের ভালো লাগবে না।

হুমায়ূন আহমেদ অসম্ভব রেগে গেলেন। তাঁর এ ধরনের রাগের সঙ্গে আমরা পরিচিত। এ রাগের মধ্যে আছে অদ্ভুত এক স্নেহ-ভালোবাসার প্রকাশ। বললেন, আমি যা বলেছি তা-ই হবে। এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলবে না। এই মিউজিয়াম দুইবার কেন, দশবারও দেখা যায়। ভাবিকে বললেন, কুসুম, তুমি ইন্টারনেট থেকে টিকিট কাটার ব্যবস্থা করো। শুনেছি ইন্টারনেটে টিকিট অনেক কম দামে পাওয়া যায়।

আমার তখন মুনিয়ার কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, তাঁর কাছে অনেকগুলো টিকিট আছে। স্যার কি এটা মেনে নেবেন ? রাজি হবেন ? তা ছাড়া আমাদের তো লাগবে আটটা টিকিট। এটা-সেটা চিন্তা করে ভয়ে ভয়ে হুমায়ূন আহমেদকে মুনিয়ার অফারের কথা জানালাম। তিনি প্রথমে রাজি হলেন না। তাঁকে বোঝালাম টিকিটগুলো মুনিয়ার কাছে আছে এবং তিনি খুব আন্তরিকভাবেই দিতে চাচ্ছেন। অবশেষে একপর্যায়ে তিনি রাজি হলেন। সাথে সাথে মুনিয়াকে ফোন করে জেনে নিলাম মোট কয়টা টিকিট তার কাছে আছে। তাঁকে বললাম, হুমায়ূন আহমেদও আমাদের সঙ্গে যাবেন। এ কথা শুনে মনে হলো তিনি লাফ দিয়ে উঠলেন। বললেন, মাজহার ভাই, টিকিট আছে দশটা। হুমায়ূন আহমেদ যাবেন শুনে তিনি নিজেও আমাদের সঙ্গে যেতে চাইলেন। ঠিক হলো ১১ জানুয়ারি, বুধবার, সকাল দশটায় আমরা বাসা থেকে বের হয়ে যাব। স্যার বললেন, সকাল সকাল বের হতে হবে, কারণ এত বিশাল মিউজিয়াম যে সারা দিনেও দেখে শেষ করা যায় না।

যথাসময়ে নুরুদ্দীন তাঁর গাড়ি নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে উপস্থিত। সঙ্গে মুনিয়া আছেন। আমরাও তৈরি ছিলাম। সাথে সাথে নেমে এলাম। নুরুদ্দিনের পাশের সিটে আমি, মাঝের সিটে হুমায়ূন আহমেদ, ভাবি, নিষাদ, অন্বয়, নিনিত। আর পেছনের সিটে স্বর্ণা, অমিয় ও মুনিয়া। এক গাড়িতে গাদাগাদি করে বসে আমরা রওনা হলাম ম্যানহাটনের উদ্দেশে।

আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিসরের ও জনপ্রিয় মিউজিয়ামগুলোর একটি। নূরুদ্দীন আমাদের মিউজিয়ামে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবেন। বিকেলে গাড়ি নিয়ে এসে মিউজিয়ামের সামনে থেকে আবার তুলে নেবেন। মিউজিয়ামের গেটে নামিয়ে দেওয়ার সময় বললেন, বেশি করে হট ডগ ও পানি নিয়ে নেন। ভেতরে খাবারের দাম বেশ চড়া।

কনকনে ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে আমি অনেকগুলো হট ডগ কিনে নিলাম। হুমায়ূন আহমেদ মাথায় উইগ লাগিয়ে এসেছেন। কিছুদিন আগে অনেক দাম দিয়ে উইগটা কিনেছেন। শখ করে মাঝে মাঝে পরেন।

সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতেই বিশাল হলরুম। হলরুমের মাঝবরাবর একটা বিশাল ডায়নোসরের কঙ্কাল রাখা। মুনিয়া চলে গেলেন টিকিট কাউন্টারে। তার কাছে আছে এক ধরনের পাস। সেটা কাউন্টারে দেখালে টিকিট, স্টিকার এগুলো দেবে। আমিও কাউন্টারে গেলাম তাকে সহযোগিতা করতে।

ভিক্টোরিয়ান গোথিক ডিজাইনে ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই মিউজিয়ামটি। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন ছাব্বিশতম মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের বাবা থিওডোর রুজভেল্ট সিনিয়র। শান্তিতে নোবেল পাওয়া থিওডর রুজভেল্ট স্মরণে মিউজিয়ামের দুটো ফ্লোর উৎসর্গ করা হয়েছে। কারণ তিনি ন্যাচারাল হিস্ট্রি ও বিজ্ঞানের বড় ভক্ত ছিলেন।

প্রকৃতি বিজ্ঞানী ড. আলবার্ট এস বিকমোরের সুদীর্ঘ প্রচেষ্টায় সেন্ট্রাল পার্কের আর্সেনাল ভবনে প্রথম জাদুঘরটির সংগ্রহ শুরু হয়। ১৮৭৪ সালে জাদুঘরের নিজস্ব ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়। জাদুঘরের বর্তমান চেহারার আর্কিটেক্ট কেভিন রসে, যিনি নব্বইয়ের দশক থেকে এর পরিকল্পনা ও ব্যাপক উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি, বিশাল সংগ্রহ ও আকর্ষণীয় প্রদর্শনীর মাধ্যমে পৃথিবীকে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয় দর্শনার্থীদের, বিশেষ করে শিশু ও তরুণদের। সেই সাথে মিউজিয়ামটি পরিচালনা করে ন্যাচারাল সায়েন্স নিয়ে বেশকিছু গবেষণা কার্যক্রম।

সুবিশাল মিউজিয়াম কমপ্লেক্সটি গড়ে উঠেছে ২৭টি ভবনকে সংযুক্ত করে। ৪৫টি স্থায়ী প্রদর্শনী হল ছাড়াও মিউজিয়ামে রয়েছে একটা প্লানেটারিয়াম ও লাইব্রেরি। ৩ কোটি ২০ লাখ উদ্ভিদ, প্রাণী, ফসিল, খনিজ, পাথর, উল্কা ও নৃতাত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ রয়েছে মিউজিয়ামে, যার সামান্য অংশই প্রদর্শন করা যায় এর দেড় লাখ বর্গমিটার প্রদর্শনী হলে। বছরে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ এই মিউজিয়াম ভিজিট করতে আসে।

হুমায়ূন আহমেদ ও শাওন ভাবি ম্যাপ দেখা নিয়ে ব্যস্ত। কোনটার পর কোনটা দেখা হবে সেটা আগেই ম্যাপ দেখে ঠিক করা হচ্ছে। তা ছাড়া এত বড় মিউজিয়াম যে সবকিছু একদিনে দেখাও সম্ভব না। সবাইকে ডেকে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমরা প্রথমেই যাব বাটারফ্লাই কনজারভেটরি দেখতে। আশা করি, বাচ্চারা অনেক মজা পাবে। তারপর ম্যাপ অনুযায়ী বিভিন্ন হলে যাব। অমিয়-অন্বয় বাবা-মার হাত ধরে থাকবে। একবার হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

নিনিত-নিষাদ স্ট্রলারে বসা। অমিয় বাবা-মার হাত ধরতে রাজি না। সে নিষাদ-নিনিতের স্ট্রলার ঠেলায় ব্যস্ত।

আমরা হুমায়ূন আহমেদকে অনুসরণ করে বাটারফ্লাই কনজারভেটরির দিকে এগোতে থাকলাম। মিউজিয়ামের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রদর্শনী সম্ভবত এটি। অনেক দর্শনার্থীর সমাগম এখানে। প্রদর্শনীটির আয়োজন করা হয় কৃত্রিমভাবে তৈরি বাটারফ্লাই ভিভারিয়ামে। কনজারভেটরির ভেতরে তাপমাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় সবাইকেই গরম কাপড় খুলে ঢুকতে হলো। একদম ন্যাচারাল একটা পার্কের মতো বানানো। ১৩১৫ বর্গফুট আকৃতির ভিভারিয়ামের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি-সেখানে প্রজাপতিরা যেন রেইনফরেস্টে প্রকৃতির কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মিউজিয়ামের বিভিন্ন নির্দেশিকায় তুলে ধরা হয়েছে প্রজাপতি জগতের নানারকম তথ্য।

পৃথিবীতে আড়াই লাখের বেশি প্রজাতির লেপিডোপটেরা (প্রজাপতি ও মথ) রয়েছে, যার মধ্যে প্রজাপতি রয়েছে আঠারো হাজার। জীববিজ্ঞানে প্রজাপতিকে পাঁচটি পরিবারে ভাগ করা হয়। মিউজিয়ামের এই বাৎসরিক এক্সিবিশনে প্রদর্শন করা হয় তিনটি পরিবারের প্রজাপতি। পেয়ারিডি, যা সাধারণত সাদা ও হলুদ রঙের; পাহপিলিঅনিডি বা লেজঅলা প্রজাপতি; এবং নিমফেলিডি যার মধ্যে রয়েছে মরফোস ও বড় পাখাঅলা প্রজাপতি। হুমায়ূন আহমেদ দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে প্রজাপতি দেখছেন। মাঝে মাঝে ভিভারিয়ামের দায়িত্বে থাকা লোকটির কাছ থেকে নানা তথ্য জানার চেষ্টা করছেন।

নানা রঙের হাজার হাজার প্রজাপতি। অসাধারণ এক দৃশ্য, যা না দেখলে বোঝানো সম্ভব নয়। নিনিত কখনো বাবার কোলে, কখনো মা’র কোলে। এখানে স্ট্রলার ঢোকানো নিষেধ। অবাক হয়ে ছোট শিশুটি তাকিয়ে দেখছে প্রজাপতি, কখনো হাত বাড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে। মূল ভিভারিয়ামের নয়নাভিরাম পরিবেশে ঢুকে আমরা যেন কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম প্রজাপতির অপূর্ব জগতে। চারদিকে উড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, কোথাও গাছের পাতায় মিশে আছে সবুজ ক্যামোফ্লেজ প্রজাপতি, কোথাও মথ থেকে প্রজাপতিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। অসাধারণ মুগ্ধতা নিয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা সবাই।

হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তোমরা পরে সুযোগ পেলে ব্যাঙের প্রদর্শনীটা দেখতে পারো। গত বছর আমি দেখেছিলাম। ব্যাঙের এত রঙ ও বৈচিত্র্য তা জানা ছিল না—উজ্জ্বল কমলা, গাঢ় নীল, লালচোখ ধাঁধানো কত বিচিত্র রঙের ব্যাঙ যে রয়েছে এই মিউজিয়ামে না এলে জানাই হতো না।

মিউজিয়ামের ফ্লায়ারে লেখা, আর্দ্র রেইনফরেস্ট থেকে শুরু করে রুক্ষ মরুভূমি পৃথিবীর সব আবহাওয়ায় ছড়িয়ে আছে নানা প্রজাতির ব্যাঙ, তাদের জীবনরক্ষার কৌশল সত্যি আগ্রহোদ্দীপক। আধুনিক ব্যাঙ গবেষণার পথিকৃৎ

আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির ব্যাঙের সংগ্রহ সারা দুনিয়ার মধ্যে সেরা। পৃথিবীর বিভিন্ন দুর্গম জায়গা থেকে ব্যাঙ সংগ্রহের পাশাপাশি নিরন্তর গবেষণা চলে এসব প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে যেসব প্রাণী সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে ব্যাঙ তাদের একটি। ব্যাঙ প্রদর্শনীর সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, বিভিন্ন পরিবেশে ব্যাঙের টিকে থাকার কৌশল বা এডাপটিবিলিটি।

এরপর আমরা গেলাম জাদুঘরের আরেকটি আকর্ষণীয় সংগ্রহ জীববৈচিত্র্যের লাইফ সাইজের ত্রিমাত্রিক মডেল বা হ্যাবিটেট ডায়োরামাস দেখতে। সেখানে আফ্রিকা, এশিয়া ও উত্তর আমেরিকার স্তন্যপায়ীদের আলাদা আলাদা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা আছে।

ওখান থেকে বের হয়ে গেলাম দ্য একেলে হল অব আফ্রিকান ম্যামালসে। ঢুকতেই চোখ পড়ল বিশাল আকারের অনেকগুলো হাতি দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে। মোট আটটি হাতির মূর্তি হলের ঠিক মাঝে একটি বেদির উপর। এর চারপাশে ২৮টি হ্যাবিটেট ডায়োরামাস আফ্রিকার বন্য জীবনের অসাধারণ বৈচিত্র্যকে বাঙ্ময় করে তুলেছে। কাচের বক্সের ভেতর ছবিগুলো এত জীবন্ত যে দেখে মনে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে প্রাণীগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। কালো রাইনোসেরাস, গরিলা, অস্ট্রিচ, জিরাফ যেন জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছে। নিষাদ ও অন্বয় গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। বেশি কাছে যেতেও আবার ভয় পাচ্ছে। বাচ্চাদের আনন্দে হুমায়ূন আহমেদ মুগ্ধ। আফ্রিকান ম্যামালস হল ছাড়াও মিউজিয়ামে রয়েছে নর্থ আমেরিকা, এশিয়া, নিউইয়র্ক স্টেট ও ক্ষুদ্রাকৃতি ম্যামালদের নিয়ে আলাদা আলাদা হল।

‘আর্থার রস হল অব মেটিওরাইটস’ ৪৬০ কোটি বছরের পুরোনো আমাদের সৌরজগতের উৎপত্তির নানা অজানা রহস্য উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। আর অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য এখানে গবেষণা চলে উল্কাপিণ্ড ও মহাকাশ থেকে আসা অন্যান্য প্রস্তরাবশেষ বা নমুনা নিয়ে। সূর্য ও গ্রহসমূহের গঠন ও পরিবর্তন নিয়ে জানার চেষ্টা এই গবেষণার লক্ষ্য। হলটি তিন অংশে ভাগ করা। এক ভাগে দেখানো হচ্ছে সৌরজগতের উৎপত্তি, একদিকে প্রদর্শিত গ্রহগুলো তৈরির প্রক্রিয়া এবং অন্যদিকে দেখানো হচ্ছে উল্কাপিণ্ড সৌরজগৎ ও ভূ-পৃষ্ঠে কী কী পরিবর্তন সাধন করেছে। ১৩০টি উল্কাবশেষ রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ৩৪ টন ওজনের কেপ ইয়র্ক মেটিওরাইট। এ ছাড়াও এখানে দর্শনার্থীরা ভিড় করে মঙ্গলগ্রহ থেকে সংগৃহীত নমুনা এবং ১৯৭০ সালে অ্যাপোলো মিশনে সংগৃহীত চাঁদের পাথর দেখার জন্য। আমরা বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চাঁদের পাথর দেখলাম।

‘মরগান মেমোরিয়াল হল অব জেমস’ মিউজিয়ামের একটি আকর্ষণীয় অংশ। রত্নসামগ্রীর এই প্রদর্শনীতে রয়েছে কাট ও আনকাট অবস্থায় বিভিন্ন মূল্যবান পাথর, অলংকার, প্রবাল ও স্ফটিক পাথর। জাদুঘরের সংগ্রহে রয়েছে লক্ষাধিক খনিজ ও রত্নসামগ্রী। আলাদা আলাদা শোকেসে রয়েছে ডায়মন্ড, ব্লুসাফায়ার, ইমারল্ড, ওপাল, গার্নেট, টোপাজ, ম্যালাকাইট, অ্যাজোরাইট, টাইগার আই ইত্যাদি নানারকম রত্ন। দুর্লভ ও অস্বাভাবিক রত্ন, কৃত্রিম রত্ন ও দামি ধাতব যেমন সোনা, প্লাটিনাম, রুপার জন্য রয়েছে আলাদা ডিসপ্লে। একই সাথে বিভিন্ন দেশের রত্ন ব্যবহারের সংস্কৃতি ও সময়ের আবর্তে অলংকারের পরিবর্তনও তুলে ধরা হয়েছে এই ঝলমলে সংগ্রহশালায়। হলের উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে ৬৩২ ক্যারেটের প্যাটিসিয়া অ্যামারেল্ড ও ৫৬৩ ক্যারেটের নীলকান্তমণি, যাকে বলা হয় স্টার অব ইন্ডিয়া।

হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে বেশি সময় কাটালেন এই হলে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো একটার পর একটা মূল্যবান পাথর দেখলেন তিনি। বিশাল আকারের স্টার অব ইন্ডিয়ার সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং সবাইকে ডেকে ডেকে দেখালেন। এত বড় নীলা আমরা কেউই দেখি নি। মূল্যবান পাথরের প্রতি তাঁর রয়েছে বিশেষ আগ্রহ। নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহে পাথরের সংখ্যা কম নয়। দেশের বাইরে বেড়াতে গেলেই তিনি পাথর সংগ্রহ করেন।

মিউজিয়ামে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন থিমভিত্তিক শো। যেমন-মহাকাশ অভিযান, ডায়নোসর, ছবি তোলার টেকনোলজি, থিওরি অব রিলেটিভিটি, বিবর্তনবাদ ইত্যাদি। মিউজিয়ামের ম্যাপ দেখে অনেক খোঁজাখুঁজির পর মহাকাশ অভিযানের শো দেখার জন্য প্লানেটেরিয়াম হলে উপস্থিত হলাম। চমৎকার আয়োজন। শো শুরু হওয়ামাত্র নিনিত গলা ফাটিয়ে কান্না শুরু করল। ছোট্ট শিশুটি মনে হয় এই মুহূর্তে মহাকাশে যেতে রাজি নয়। হুমায়ূন আহমেদ ও ভাবি নিনিতের কান্না থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। দু’জনই হল থেকে বেরিয়ে এলেন। আমিও বেরিয়ে এলাম। তিনি ভাবিকে বললেন, তুমি নিষাদকে নিয়ে শো’টা দেখো। নিষাদ আনন্দ পাবে। আমি নিনিতকে থামানোর চেষ্টা করছি। ভাবি ভেতরে চলে গেলেন। হুমায়ূন আহমেদ আর আমি নিনিতকে নিয়ে বাইরে। কান্না থামার পর হলের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই আবার কান্না। আমরা বেরিয়ে এলাম। আসলে হলের ভেতরের অন্ধকার ওর কান্নার কারণ।

‘বায়োডাইভার্সিটি হল’ সাজানো নর্থ আমেরিকান পাখিসহ পৃথিবীর নানারকম পাখি দিয়ে। বাচ্চারা খুব আনন্দে পাখি দেখছে। হুমায়ূন আহমেদের পাখির প্রতি অসম্ভব মমতা। নুহাশপল্লীতে একসময় নানা প্রজাতির পাখির সংগ্রহ ছিল। নিজে অসংখ্যবার টঙ্গীতে পাখির হাঁটে গিয়ে পাখি কিনে এনেছেন। বিশেষ কিছু পাখির মাংস কখনো খেতেন না। যেমন, ঘুঘু, কবুতর। তিনি বলতেন, এত সুন্দর জীবন্ত যে পাখি সেটা আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব না।

মিউজিয়ামের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো এখানে রক্ষিত ফসিল বা জীবাশ্মের বিশাল সংগ্রহ। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ডায়নোসরের ফসিল রাখার হল দুটি। হল অব অরনিথিশিয়ান ডায়নোসর-এ আবার দু’ধরনের ডায়নোসর রয়েছে, জেনাসোরস এবং সেরাপডস। এই হলে ডায়নোসরের অস্থি কংকাল ছাড়াও রয়েছে—তাদের কাল্পনিক রূপের মডেল। হল অব সরিশিয়ান ডায়নোসরস-এর মডেলগুলো আরও বেশি ভীতিকর দেখতে। এই হলে কংকাল ও মডেল ছাড়াও রয়েছে ১০ কোটি বছরের পুরনো ডায়নোসরের পায়ের ছাপের ফসিল।

ফসিল হলে নানা প্রাণীর লক্ষ-কোটি বছরের পুরোনো ফসিল দেখতে দেখতে আমরা এসে দাঁড়ালাম একটি বিশেষ জায়গায়। এখানে সংরক্ষিত আছে ১৯ কোটি বছর আগের কচ্ছপের পূর্বপুরুষের ফসিল। হুমায়ূন আহমেদ বেশ খানিকটা সময় নিয়ে এই ফসিলটি দেখলেন। কচ্ছপের আয়ুস্কাল নিয়ে তাঁর বিরাট আক্ষেপ। তিনি প্রায়ই বলেন, লিখেছেনও কোথাও—‘কচ্ছপ বাঁচে তিন শ’ বছর, অথচ মানুষ এক শ’ বছরও বাঁচে না!’ এই আক্ষেপ কি তাঁকে আরেকবার আলোড়িত করল ? আমরা বেরিয়ে আসি এখান থেকে।

এই মিউজিয়ামের গর্বকারী সম্পদ হলো এর ৯৪ ফুট দীর্ঘ ও ২১ হাজার পাউন্ড ওজনের স্ত্রী নীল তিমির মডেল। ফাইবার গ্লাসের তৈরি মডেলটি তৈরি করা হয়েছে ১৯২৫ সালে দক্ষিণ আমেরিকার সমুদ্র অভিযানে দেখা একটি তিমির অনুকরণে। শিকারিদের নিষ্ঠুরতায় নীল তিমি আজ বিলুপ্তির পথে। দারুণ জীবন্ত মডেলটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণীটির ধ্বংসের আশঙ্কার পাশাপাশি মনে করিয়ে দেয় পরিবেশ রক্ষায় আমাদের গুরু দায়িত্বের কথা।

প্রত্যেক ফ্লোরে রয়েছে গিফ্ট শপ। নানা ধরনের মূল্যবান পাথরের রেপ্লিকা। বাচ্চাদের খেলনাসহ বিভিন্ন স্যুভেনির সাজানো। এখান থেকে বাচ্চাদের আর সরানো যায় না। প্রত্যেকটা জিনিসই তারা কিনতে চায়। একপর্যায়ে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, সবাই এখানে কেনাকাটায় ব্যস্ত, চলো আবার একটু মর্গান মেমোরিয়াল হল থেকে ঘুরে আসি। আমরা দু’জন চলে গেলাম সেখানে। বেশ কিছুক্ষণ পর গিফট শপে ফিরে এসে দেখি কেউ নেই। অন্যদের খুঁজতে লাগলাম। এদিকে সন্ধ্যা ছ’টা বেজে গেছে। মিউজিয়ামের গেট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। আমরা দুজন অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, চলো বেরিয়ে যাই। ওরাও নিশ্চয়ই আমাদের না পেয়ে বেরিয়ে গেছে। বাইরে বেরোলেই সবার সঙ্গে দেখা হবে। আমরা বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। এক্সিট সাইন দেখে এগোচ্ছি, তারপরও দেখি ঘুরে ফিরে আবার আগের জায়গায় চলে আসছি। সিকিউরিটির লোকদের জিজ্ঞেস করে অনেক ঘোরাঘুরির পর মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু যেখান দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম বেরিয়ে এলাম অন্য পথ দিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, মাজহার, এটা কী হলো ? ওরা কোথায় ? এদিকে বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। পর্যাপ্ত শীতের কাপড় থাকার পরও কাঁপতে থাকলাম। বেরিয়েছি মিউজিয়ামের পেছনের এক্সিট দিয়ে।

অনেকক্ষণ পর অন্যদের খুঁজে পেলাম। তারা সামনের এক্সিট দিয়ে বেরিয়েছেন। নূরুদ্দীন এখনো গাড়ি নিয়ে আসেন নি। কনকনে ঠান্ডায় সবারই কাহিল অবস্থা। জানা গেল, নূরুদ্দীন প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছেন।

আমি ভাবছিলাম, ভালো একটা অভিজ্ঞতা হলো এই ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এসে। কতকিছুই না দেখলাম, জানলাম। হুমায়ূন আহমেদ যে বলেছিলেন—এই মিউজিয়াম দুইবার কেন, দশবারও দেখা যায়—তাঁর কথাটি তো খুবই সত্যি। তা ছাড়া বাচ্চাদের আনন্দও ছিল সীমাহীন।

আরও একটি কথা মনে হলো আমার। এই যে আমরা আজ প্রজাপতির প্রদর্শনী দেখলাম, গত বছর এখানে স্যার ব্যাঙের প্রদর্শনী দেখেছেন। মিউজিয়ামের ফ্লায়ার থেকে জানলাম, বছরের বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমে ব্যাঙ, প্রজাপতি ও মাকড়সার প্রদর্শনী চলে এখানে। স্যারের ভয়ানক মাকড়সাভীতি। তাঁর লেখালেখিতে সে-কথার উল্লেখ আছে।

কোনো-এক বিচিত্র এবং জটিল কারণে আমাদের ছ’ ভাইবোনেরই ভয়ঙ্কর মাকড়সাভীতি আছে। নিরীহ এই পোকাটিকে দেখামাত্রই আমাদের সবার মনোজগতে একধরনের বিপ্লব ঘটে যায়। আমরা আতঙ্কে ঘৃণায় শিউরে উঠি, বমিভাব হয়, চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। মনোবিজ্ঞানীরা এই ভীতির নিশ্চয়ই একটা ব্যাখ্যা দেবেন। আমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই।…

আমার নিজের কথা বলি। ঢাকা থেকে বরিশাল যাচ্ছি বি এম কলেজের রসায়নশাস্ত্রের এম.এসসি. পরীক্ষার এক্সটারন্যাল হয়ে। প্রথম শ্রেণির একটি কেবিন রিজার্ভ করা। রাত দশটার মতো বাজে। হঠাৎ দেখি কেবিনের ছাদে বিশাল এক মাকড়সা পেটে ডিম নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আমি ছিটকে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। দশ টাকা কবুল করে একজন ঝাড়ুদার নিয়ে এলাম। সে অনেক খুঁজেও মাকড়সা পেল না, কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। কেবিনে আর ঢুকলাম না। যদি মাকড়সা আবার কোনো অন্ধকার কোণ থেকে বের হয়ে আসে! প্রচণ্ড শীতের রাত পার করে দিলাম ডেকে হাঁটাহাঁটি করে। যতবার মাকড়সার কথা মনে পড়ল ততবারই শিউরে উঠতে লাগলাম।

এই ভীতি আমরা ভাইবোনেরা জন্মসূত্রে নিয়ে এসেছি। হয়তোবা আমাদের জিনের ছেচল্লিশটি ক্রমোজমের কোনো-একটিতে কোনো গন্ডগোল আছে যার কারণে এই অস্বাভাবিক ভীতি।

শৈশবে আমাকে ঘুম-পাড়ানোর জন্যে এই মাকড়সাভীতিও কাজে লাগানো হতো।

অধিকাংশ শিশুর মতো আমারও রাতে ঘুম আসত না। মা বিরক্ত হয়ে মেজো চাচাকে বলতেন, ওকে ঘুম পাড়িয়ে আনো।

মেজো চাচা আমাকে কোলে নিয়ে চলে যেতেন বাড়ির দক্ষিণে কাঁঠালগাছের কাছে। সেই কাঁঠালগাছে বিকটাকার মাকড়সা জাল পেতে চুপচাপ বসে থাকত। আমাকে সেইসব মাকড়সার কাছে নিয়ে গিয়ে বলা হতো—ঘুমাও। না ঘুমালে মাকড়সা গায়ে দিয়ে দেব। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তাম। এখন আমার ধারণা, ঘুম না, ভয়ে হয়তোবা অচেতনের মতো হয়ে যেতাম। কেউ তা বুঝতে পারত না। ভাবত ঘুম-পাড়ানোর চমৎকার ওষুধ তাঁদের কাছে আছে।

[হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, অন্যপ্রকাশ, পৃ. ৪৫৭-৪৫৮]

বিধাতা কী বিচিত্র খেলাই না খেলেন। স্যার দু’বার এলেন এখানে। বছরের কোনো না কোনো সময় এখানে মাকড়সার প্রদর্শনী হয়। অথচ একবারও তাঁকে মাকড়সার প্রদর্শনী দেখতে হলো না। এটা কি কাকতালীয় কোনো ব্যাপার ? বিধাতার কোনো খেলা ?

ভাবনায় এতটাই নিমগ্ন ছিলাম যে, স্যারের ডাকে সংবিত ফিরে পেলাম—মাজহার! চলো, নূরুদ্দীন চলে গেছে।

ছোট গল্প

কেউ ফেরে না

তানিয়া ইসলাম

অজিত…… গফুর…… ফের….. ফের….. ফের,

দুপুর বেলা ঘুঘু পাখি নাকি টেনে টেনে এই কথা বলতে থাকে!

দাদা বলেছেন, এর পিছনে একটা গল্প আছে সেটাও বলেছেন।

গল্পটা হলো, অজিত আর গফুর দুই বন্ধু, দু’জনে মিলে বাবা মায়ের উপর রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে! বাবা মা ভেবেছিল ফিরে আসবে, কিন্তু ওরা ফিরে আসেনি।

দিন শেষে রাত, গড়িয়ে গড়িয়ে মাস, বছর, এমন কি যুগ কেটে গেল! অজিত – গফুর ফিরে আসে না। কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধ বাবার চোখ অন্ধ হয়ে গেছে, তবুও ঘুঘুর মতো কাতরে কাতরে ডাকে, অজিত, গফুর , ফের ফের ফের।

সেই অপেক্ষারতো অন্ধ বাবা তো গত হয়েছেন।

এরপর ঘুঘু পাখি এই দায়িত্ব নিয়েছে, সুর করে ডাকে,

অজিত……গফুর…… ফের…… ফের…

দাদাদের এই সব আজগুবি গল্প কেউ বিশ্বাস করে না,

শুভও করে না।

দাদা বাড়ির উদ্দেশ্যে বাসে উঠেছে শুভ, দাদার কথা মনে পড়তেই এই সব গল্প গুলো মনে ভেসে ভেসে

যায়। দু’বছর আগে গিয়েছিলো দাদা বাড়ি, SSC পরিক্ষা শেষে, সেবার সবাই মিলে বাবা মায়ের সাথে।

এবার HSC পরিক্ষা শেষে একা একা চলেছে।

গ্রামে যেতে শুভর ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু বাবার কড়া হুকুম! এছাড়া এরপর ঢাকা যেতে হবে কোচিং করতে, ভর্তি হতে হবে ইউনিভার্সিটিতে তখন আর সহজে আসা হবে না।

দাদা বাড়ি গেলে অবশ্য অন্য রকম মজা হয় মাছ ধরা,

নদীতে গোসল করা, ঘুড়ি উড়ানো, আর প্রতিদিন পিঠা খাওয়া। দাদি, চাচী, ফুপুরা ওদের পেলে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে যায়, ওদের জন্য কি করবে না করবে? একদম হুলুস্থুল কাণ্ড! সারাদিন এটা ওটা তৈরি করে খাওয়াবে, অবাক হয়ে ওদের কথা শুনবে এমন কি গায়ে মুখে হাত দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখবে! দাদি

বলেন,

ইয়া আল্লাহ! কি সুন্দর! আমার দাদা ভাই কারো নজর না লাগে। এরপর রাতে দাদার সাথে ঘুমাতে গিয়ে কতো গল্প শোনা।

একবার কি হয়েছে, গ্রামের সমবয়সীদের সাথে বিলের ধারে চলে গেছে পাখি মারতে। ঘুরতে ঘুরতে দুপুর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। বাড়ি ফিরে দেখে মরা কান্না শুরু হয়ে গেছে। শুভকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সারা গ্রামে হৈচৈ করা ব্যাপার।

গ্রামের মানুষ এখনো এতোটা সহজ!

এই গল্প মনে পড়ায়, শুভর আরেকটা গল্প মনে পরলো,

দাদা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদেন!

জীবন দশায় দুই সন্তান হারিয়েছেন, বড় চাচু কিশোর বয়সে মুক্তি যুদ্ধে শহীদ হন, আর ছোট ফুপি আত্মহত্যা করেছিলেন। যদিও এই দুঃখের গল্প গুলো কখনও বলেন না! শুভ গ্রামের অন্য লোকের মুখে একটু একটু শুনেছে।

এই সব মনে পরে শুভর খুব মন খারাপ লাগে, আর কিছু দিন পর একা একা শহরে থাকবে, মা-বাবা , পরিবারের জন্য নিজেরও খুব খারাপ লাগবে।

মা তো এখনই কথায় কথায় কাঁদতে বসেন, শুভকে দূরে পাঠিয়ে কেমন করে থাকবেন।

এই মুহূর্তে দাদার জন্য মায়া লাগছে শুভর, কেন দাদা ঘুঘু পাখির ডাকে অজিত- গফুর ফের ফের , শুনতে পায়, হঠাৎ করে যেন এটাও বুঝতে পারছে।

বাস থেকে নেমে শুভ হাঁটতে আরম্ভ করলো, আজকে এই রাস্তা টুকু কোন ভ্যান রিকশা নয়, হেঁটে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করছে। মূল রাস্তা থেকে গ্রামের পথে নামতেই মন ভালো হয়ে গেল।

ডান দিকে সবুজ ধান ক্ষেত, বাম দিকে আম কাঁঠালের বড় বড় বাগান, কিছুটা এগিয়ে শুরু হয়েছে গ্রাম একটা দুটো ঘর বাড়ি, বাড়ির সামনে উঠোনে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা খেলা করছে, গৃহবধূরা ডাল গম রোদ্দুরে দিয়েছে শুকাতে।

বাগানে বউ কথা কও পাখি ডাকছে, শুভ সেই নজরুল সঙ্গীত মনে মনে গুন গুন করতে করতে পথ চলছে।

বউ কথা কও,

বউ কথা কও,

কও কথা অভিমানী নি………..

বুকের ভেতর কেমন টিপ টিপ করছে, মনে হচ্ছে এই এখনি, কেউ ওকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে! এই গ্রামে সবাই ওর চাচা, দাদা বা ফুপি – ফুপা।

ভালোলাগার অদ্ভুত অনুভূতিতে শুভর মন ভরে উঠলো।

বাবা বলেন, গ্রামের সাথে নাকি মানুষের শিকড়ের টান, মানুষ তো আর গাছ নয়, মানুষের শিকড় নেই! কিন্তু শুভর মনে হলো এই অদ্ভুত ভালো লাগায় বোধহয় শিকড়ের টান!

হালকা পায়ে হাঁটছে শুভ, হঠাৎ কেমন নিজেকে ওর

বড় মানুষ মনে হচ্ছে। আর একটা কিছু মনে হচ্ছে যা শুভ ঠিক বুঝতে পারছেনা!

হয়তো একা এসেছে বলে এমন মনটা ধুক ধুক করছে। সে কি একটু ভয় পাচ্ছে?

লিচু গাছে দুটো হলুদ পাখি, ঘুরে ঘুরে উড়ছে, লুকোচুরি খেলার মতো, একটা উপরের ডালে বসে ছিল, অন্যটা উড়ে সেখানে যেতেই, প্রথমটা টুপ করে নিচে নেমে এলো, শুভর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।

যেতে যেতে ওদের ডাক শুনে অবাক হলো শুভ কুটুম এলো, কুটুম এলো, এটাই তাহলে কুটুম পাখি!

ওরই আসার খবর জানাচ্ছে, আবার বুকটা ধ্বক্-ধ্বক্

করে উঠলো তার।

কিন্তু আজকে গ্রামের মানুষ গেল কোথায়? দাদা বাড়ির কাছে চলে এসেছে এখনো কেউ ওকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে আসেনি!

এমন তো নয় কেউ শুভকে চিনতে পারছে না? বাবা মায়ের সাথে আসেনি বলে বা শুভ অনেক লম্বা হয়ে গেছে বলে!

দূর থেকে এখন শুভ দাদা বাড়ির,‌ গাছ গুলো দেখতে পাচ্ছে, আর একটু এগিয়ে যেতে দেখতে পেলো, বাড়িতে অনেক মানুষ! কি হয়েছে?

সেদিনের মত কেউ কি হারিয়ে গেলো, অথবা  কোন বাচ্চা কি পুকুরে পড়েছে?

শুভ চেষ্টা করেও জোরে হাঁটতে পারছে না, হঠাৎ কেমন যেন লাগছে! ক্লান্ত লাগছে বেশী।

আর একটু এগিয়ে যেতে চাচু ছুটে এলেন, বাবা শুভ এসেছো বাবা? তোমার আব্বু আম্মু কোথায় কখন আসবে? তোমার দাদা যে আর নেই বাবা! চলে গেছে, না ফেরার দেশে চলে গেল!

শুভর দুচোখ ঝাপসা হয়ে আসছে

দূরে কোথাও ঘুঘু পাখি ডাকছে, অজিত-গফুর ফের ফের ফের…

 

ছ ড়া / ক বি তা

বর্ষা
জাফর সাদেক আরাফাত

বৃষ্টি নামে আষাঢ় মাসে
রৌদ্র পড়ে সবুজ ঘাসে।
বর্ষা কালে মেঘলা টুটে
পুকুর ঘাটে শাপলা ফুটে।
কচুরিপানা জাগল কূলে
জ্বললো প্রদীপ হেলেদুলে।
ডোবাপুকুর যাচ্ছে ভেসে
নিম্ন জমি ডুবছে শেষে।

কাঁদা পথে হাঁটতে যাবে
পিছলে পড়ে আছাড় খাবে।
কদুর লতা টিনের চালে
ঝুঁকল এবার তোমার গালে।
বর্ষা তুমি কাঁঠাল ফলে
আমের পাতায় বৃষ্টি জলে।
দোয়েল উড়ে আকাশ পানে
মেঘলা গগণ মনটা টানে।

 

নিঃশব্দ কোলাহল

খায়রুজ্জামান চৌধূরী টিংকু

বিমূঢ় পূর্ব পুরুষ স্তম্ভিত,  বাকরুদ্ধ সঙ্গিন
মৃত্যু প্রতিক্ষত  মুমূর্ষুর যন্ত্রনার আকাশ রঙিন।
পাখি আর মানুষের আর্তনাদে,
খান খান রজনির নির্জনতা।
সপ্ন আসে পৌষ পাবনের রুদ্ধ মেলায়
নির্মম নিয়তি আসে জীবন্ত হিমানীর ভেলায়।
বানের জলে দীঘিকুয়াশা সকল গেল ভেসে
স্বভাব মতই সকল মানুষ খিল খিলিয়ে হাসে।
প্রতিক্ষিত আকাশ জ্বলবে না  প্রদিপ নিয়ে হাতে
খুলে দাও কেশর স্বর্ণতনুর এই মেঘ বৃষ্টির রাতে।
নীলিমার তারা পাপড়ি  ঝরাবো হৃদয় ছুঁয়ে
মুছে দেব সন্তাপ আলেয়া নীল আলোতে ধুয়ে।
হিদয় রেখেছি ফুলের আসর যেন পথ অজানা
ফেলিয়া চরণ  এই হাতে হাত রাখ বহি দুজনা।

সভ্য হবো

শেখ ইরফান

ভুলছি মোরা নিজের স্মৃতি
কীর্তি নিজের যতো,
তাইতো এখন পদে পদে
আসছে আপদ কতো৷

ভাবছি বসে সভ্য হবো
শেকড় ভুলে গিয়ে,
পূর্বসূরিরর চিন্তা চেতন
জলাঞ্জলি দিয়ে৷

ভাবনা এসব পাগলামো বৈ
অন্য কিছু আর না,
সভ্য হবার সখ আছে ভাই
এই জগতে কার না?

সত্যি যদি সভ্য হবি
সভ্যতাকে ধরবি,
চেতন জাগার বইগুলো তুই
খুব করে ভাই পড়বি।

জোনাকি

ইলিয়াস সারোয়ার শুক্রবারের বিশেষ আয়োজন

জোনাকিদের দেশে এসে
হেসে হেসে
ভেসে ভেসে
দাঁড় বেয়ে যাই,
দাঁড় বেয়ে যাই মাঝির বেশে
সন্ধ্যে শেষে
জঙলা ঘেঁষে
একলা একাই!

নিঝুম রাতের এই নিরালায়
মন উড়ে যায়
বন ঘুরে যায়
জোনাক ডানায়,
জোনাক ডানায় উড়ে উড়ে
ঘুরে ঘুরে
আলোক জ্বালাই
মন ঠিকানায়।