শিক্ষব্যবস্থা সমগ্রের, আদর্শ ব্যক্তির

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ০৭ ২০১৯, ০১:২২

আবুল কাসেম আদিল:

সামনের দিনগুলোতে এত বিস্মিত হবেন, বিস্মিত হতে হতে বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলবেন। বড় বড় আকাবিরে দ্বীন, যাঁরা কয়েকদিন আগেও আওয়ামী লীগের খুল্লামখোলা শত্রু ছিলেন, তাঁরাও যখন কওমী জননীর আশীর্বাদধন্য হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন— সেই সময়ে এসে শিবির-সভাপতির দাওরা পরীক্ষা দেওয়া দেখে বিস্মিত হওয়া বিস্ময়ের ব্যাপার বটে।

সময়টাই এরকমই, কোনো কিছুতেই বিস্মিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। এমন অনেক কিছুই ঘটবে — ইতিবাচক-নেতিবাচক সব রকম — যা একসময় কল্পনাও করা যেত না।

কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদেরকে যারা রাতের আঁধারে সশস্ত্র প্রক্রিয়ায় শাপলা চত্বর থেকে উৎখাত করেছে, তাদের মধ্যে কওমীপ্রেম দেখতে পাচ্ছেন। দুঃখজনক হলেও ইতিবাচক। বামঘেষা আওয়ামী লীগ যখন বামমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে, তখন ডানঘেষা বিএনপি বামঘেষা হতে চাইছে। আওয়ামী লীগ যখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টারত, তখন আমরা বিএনপিকে দেখেছি আশীর্বাদের আশায় ভারতের দ্বারস্থ।

শেষদিকে কওমীদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া-সমঝোতা-আপোসরফা হলেও মাঝের সময়টায় জামায়াত ও কওমী এই দুই ঘরানার লোকজনই নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নির্যাতনের সাম্য এই দুই ঘরানাকে পরস্পরের প্রতি মমতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। বড়দের মধ্যে যা-ই ঘটুক, কওমী শিক্ষিত তরুণ আলেম ও শিবিরের অনেকের মধ্যে একটা সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। শিবির-সভাপতির কওমীলগ্নতা আমি ধারণা করি তারই বহিঃপ্রকাশ। আমার এই বিষয়ে রাখঢাক ছিল না, এখনো নেই— আমি ইসলামপন্থীদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য চাই। সব বিষয়ে ঐক্য জরুরি নয়, সম্ভবও নয়; ন্যূনতম মতৈক্যের ভিত্তিতে ঐক্য। ঠিক যেমন কুরআন বলছে, তায়ালাও ইলা কালিমাতিন সাওয়াইন বাইনানা — সেরকম ঐক্যই যথেষ্ট।

কওমী মাদরাসা যেহেতু জনগণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পরিচালিত হয়, এজন্য সব ধরনের মানুষের সঙ্গে কওমীপন্থীদের সদ্ভাব আছে। খেয়াল করলে দেখবেন, যেসব মাদরাসার মুহতামিম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত — হোক ইসলামী আন্দোলন বা জমিয়ত — মাদরাসা পরিচালনার স্বার্থে রাজনৈতিক দূরত্ব ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির লোকদের সহযোগিতা নেন। মাদরাসার মাহফিলে তাঁদের দাওয়াত করেন। উপস্থিত হলে সম্মানজন আসনে বসান। ব্যতিক্রম জামাত। জামায়াতের লোকদের দাওয়াত করেন না। ইসলাম থেকে জামায়াতের দূরত্ব কি আওয়ামী লীগ-বিএনপির তুলনায় বেশি?

কওমী একটি শিক্ষাব্যবস্থা। এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে বিশেষ আদর্শ ধারণ করে। স্বাভাবিকভাবেই এই শিক্ষাব্যবস্থা অনুসারে যারা শিক্ষিত হয়, তারা সাধারণত ওই আদর্শেরই অনুগামী হয়। কিন্তু আদর্শ মূলত ব্যক্তির। ব্যক্তি যদি আদর্শ ত্যাগ করে, তাহলে ওই শিক্ষাব্যবস্থার করার কিছু থাকে না। ব্যক্তিকে বিশেষ আদর্শে ধরে রাখার মতো কোনো তন্ত্রমন্ত্র নেই।

কওমী মাদরাসার কোনো ছাত্র আলিয়া মাদরাসায় পরীক্ষা দিতে চাইলে বারণ করা হতো এই যুক্তিতে— এতে মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে, ছাত্র বিপথগামী হচ্ছে। এই যুক্তি যদি ঠিক হয়, তাহলে কোনো ছাত্র যদি অন্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কওমী মাদরাসায় আসে, তাহলে তো ধরে নিতে হবে মেধা চলে আসছে, ছাত্র সুপথগামী হচ্ছে। চিন্তার কী আছে?

ফযীলতের সনদ ছাড়া তাকমীলের পরীক্ষা দিতে পারা শিবির-সভাপতির সমস্যা নয়, শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা। ফযীলতের সনদ বাধ্যতামূলক করলেও তাকমীলে পরীক্ষা দিতে অসুবিধা হবে না। আগের বছর ফযীলতে পরীক্ষা দিয়ে পরের বছর তাকমীল দিতে অনেকেই পারবে।

যত যা-ই হোক, এটি একটি শিক্ষাব্যবস্থা। এখানে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ পড়বে। শিক্ষাব্যবস্থা তার সিলেবাস অনুযায়ী শিক্ষা দেবে। কিন্তু শিক্ষার্থী আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে সেটাই, যা তার পছন্দ হয় এবং যৌক্তিক মনে হয়।