শায়েখ আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী হাফিজাহুল্লাহু বিদায়ক্ষণের বিরহলীলা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ১২ ২০১৯, ১১:২০

 

মহান আল্লাহ তা’য়ালার প্রতি অজস্র শুকরিয়া, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম হাদীস বিশারদ, মসনদে হাদিসের মুকুটবিহীন সম্রাট, লক্ষ-কোটি মুমিনের প্রাণস্পন্দন, তাওহীদি জনতার নয়নমণি, হাজারো স্বপ্নতরুণের আলোকদিশারী, আলস্যের চাদরাবৃত ছাত্রসমাজের প্রেরণাজাগরূক, আলেমসমাজে বিলুপ্তপ্রায় চেতনায় নবোদ্যম সৃজিতা আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী হাফিজাহুল্লাহু’র খেদমত, সাহচর্য ও সান্নিধ্যে একটি বছর অতিবাহিত করলাম। ক্ষণজন্মা এ মহামনীষীর সংস্পর্শপ্রাপ্তি নিজেকে আজ ধন্য মানবের দলভুক্ত করেছে। তাঁর সাহচর্যের শীতল বারিতে দেহ-মন সজীবতার আবহে ভরে উঠেছে। তাঁর সাগরসম জ্ঞানভাণ্ডার থেকে কিঞ্চিত আলোর দিশা মিলেছে।

গত ৬ ই মে রবিবার৷ সম্ভাব্য পহেলা তারাবী ৷ মাগরিবের আগেই তারাবীর মসজিদে চলে আসতে হবে। তাই বিদায় নেওয়ার জন্য শায়েখের কামরায় প্রবেশ করলাম ৷ শায়েখ তখন দুপুরের আহার সেরে চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ৷ সালাম দিয়ে শায়েখের চেয়ারের ডানপাশে দাঁড়ালাম। সালাম শুনে শায়েখ মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন। বললেন ‘ও মিয়া! তুমি আজ চলে যাবা নাকি? আদবের সাথে ‘জ্বী হ্যাঁ’ উত্তর দিলাম ৷ শায়েখ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রাখলেন ৷ কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে ইন’আম ভাইকে ডেকে বললেন, ‘জুনাইদকে একটা নতুন পাঞ্জাবীর কাপড় দাও’৷ ইন’আম ভাই নতুন একটা সুতি কাপড় বের করে শায়েখের হাতে দিলেন। শায়েখ নিজ হাতে কাপড়টা আমাকে দিয়ে বললেন ‘নাও, এটা তোমার জন্য ঈদের হাদিয়া। ঈদে এটা দিয়ে জামা বানাবা’৷ জাযাকুমুল্লাহু আহছানাল জাযা’বলে শায়েখের বরকতময় হাত থেকে স্নেহ আর ভালবাসার হাদিয়াটি গ্রহণ করলাম৷

কাপড়টি টেবিলে রেখে বিদায়ী সালাম-কালাম এবং মুসাফাহার জন্য শায়েখের সামনে গেলাম। ছোট বাচ্চাকে কোলে নেয়ার জন্য যেভাবে হস্তদ্বয় প্রশস্ত করা হয়, তদ্রূপ মুআনাকার জন্য শায়েখ স্বীয় হস্তদ্বয় প্রশস্ত করে দিলেন ৷ আমি দাঁড়ানো থেকে একটু নিচু হয়ে শায়েখকে জড়িয়ে ধরলাম৷ আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম ৷ শায়েখকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম ৷ শায়েখ আমার পিটে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এবং বিভিন্ন দুআ করছিলেন ৷ শায়েখ যতই আমার পিটে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, আমার কান্না ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল ৷ চোখের পানির কয়েক ফোটা শায়েখের স্কন্ধে এবং পিটেও পড়েছে ৷ দীর্ঘক্ষণ শায়েখের বুকে বুক লাগিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্না করলাম। শায়েখও আমাকে পিতৃস্নেহে নিজ সন্তানের মতো বুকে জড়িয়ে রাখলেন; সান্ত্বনা দিলেন এবং বিভিন্ন দুআ করলেন ৷ ছাত্র-শিক্ষক নয়; এ যেন পিতা-পুত্রের বিদায়ক্ষণের বিরহলীলা ৷ সত্যিইকারের আদর্শ উস্তাদ এমনি হন ৷ যিনি ছাত্র এবং নিজ সন্তানের মাঝে কোন পার্থক্য রাখেন না।

পাশে থেকে দাঁড়িয়ে ইন’আম ভাই সব দেখছিলেন ৷ আমার অবস্থা একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর শায়েখকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম ৷ এবং মুসাফাহা করে কাঁদতে কাঁদতে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম ৷ আমার রুমে আসার পর জালালুদ্দীন (সিরাজগঞ্জ) ভাইয়ের মাধ্যমে আবার খবর পাঠালেন শায়েখের রুমে যাওয়ার জন্য। চোখ মুছতে মুছতে দৌঁড়ে গেলাম ৷ শায়েখের পায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিয়মিত লেখালেখির জন্য গুরুত্বারোপ করলেন, দিকনির্দেশনা দিলেন এবং বিশেষভাবে আমার লেখার হাত পাকাপোক্ত হওয়ার জন্য মনখুলে দুআ করে বিদায় দিলেন।
রব্বে কা’বার কসম! কলম ধরার মত কোন যোগ্যতাই আমার নেই৷ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলাও পড়িনি ৷ হিফজ পড়ার আগে স্কুলে মাত্র তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলাম। বিশেষ কারো তত্বাবধানে থেকে সময় নিয়ে বাংলা চর্চারও সুযোগ পাইনি ৷ দুয়েক কলম যা লিখি, সব আমার প্রাণপ্রিয় শায়েখ আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী হাফিজাহুল্লাহু’র দোয়ার বদৌলতে ৷ শায়েখের দুআর বদৌলতেই আমার কলম থেকে কালি ঝরে৷

দীর্ঘ একবছর শায়েখের সান্নিধ্যে থেকে যেই পরিমাণ মায়া-মমতা, স্নেহ আর ভালবাসা পেয়েছি, ভাষাশৈলীতে প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই ৷ শায়েখ আমাকে স্নেহভরে ‘জুনাইদ’ বলে ডাকতেন। অন্যরকম মধুর একটা ডাক ৷ আমি নিজেও নিজের নামটা সেভাবে উচ্চারণ করতে পারি না ৷ শায়েখের মুখে আমার নামটা শুনলে অন্তরে যেন একধরণের প্রশান্তি অনুভব হত।

অধমের প্রতি শায়েখের অকৃত্রিম ভালবাসা আর পিতৃস্নেহের ঋণ কখনোই পরিশোধযোগ্য নয়। বিদায়ক্ষণের বিরহলীলা এখনো আমাকে অশ্রুতে ভাসাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা শায়েখকে সুস্থতার সাথে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করুন। আমাদের মাথার উপর তাঁর ছায়াকে প্রলম্বিত করুন। তাঁর নুরানি ফয়েজ, ইলমি প্রাজ্ঞতা ও ধর্মীয় দক্ষতায় আমাদের চক্ষু শীতল ও অন্তরকে প্রশান্ত করুন। আমীন!

লেখক, জুনাইদ আহমাদ