শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)- জীবন ও কর্ম

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ০৪ ২০১৯, ১০:৫৪

সৈয়দ মবনু

১৯ রমজান ১৪৩৩ হিজরি মোতাবেক ৮ আগষ্ট ২০১২ খ্রিস্টাব্দ দুপুর বারোটা বিশ মিনিটে ঢাকার আজিমপুরস্থ তাঁর নিজ বাসায় উপমহাদেশের প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস এবং বাংলা বোখারির প্রথম প্রণেতা আল্লামা আজিজুল হক ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি…)।

একজন আলেমের মৃত্যু মানে সমস্ত আলমের মৃত্যু। শায়খুল হাদিস সাধারণ কোন আলেম ছিলেন না। আমি তাঁকে দেখেছি তাঁর লেখা কিতাবসমূহে, দেখেছি তার ঘরে-আমাদের ঘরে, মাদরাসায়, রাজপথে, দেশে-বিদেশে ভ্রমণে। তিনি এক অসাধারণ আলেম ছিলেন। অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন

আমি তাঁর অহম দেখেছি খুব কাছাকাছি বসে, তবে অহংকার তাঁর ছিলো না। একান্ত সময়ে তাঁর সাথে আমার অনেক কথাই হয়েছে, আমি স্পর্শ করে দেখেছি তাঁর অনেক সরলতা, ঈমানদারী, রাসুল প্রেম, মানুষের প্রতি দরদ, ইনসাফ, দায়িত্ববোধ ইত্যাদি।

আমি তাঁকে বুঝতে চেষ্টা করেছি নিজের জীবনের সকল অভিজ্ঞতা দিয়ে। তাঁর মনের অনেক দুঃখও তিনি আমাকে একান্ত সময়ে বলেছেন। আমি নিজে কোন দল না করলেও শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের প্রেম আমাকে সর্বদাই তাঁর দলের কাছাকাছি রেখে দিতো।

অনেকেই মনে করতেন আমি খেলাফত আন্দোলন কিংবা খেলাফত মজলিস করি, কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমি ছিলাম শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের একান্ত ভক্ত। আমি আজ এখানে স্মৃতিচারণ করবো না, শুধু বলবো কেনো তাঁকে ভক্তি করি।

তিনি ছিলেন বঙ্গভূমে হেরার কিরণ

হেরার গুহায় ঝরা ওহীর আলো জবলে আবু কোবাইসে প্রজ্জ্বলিত হয়ে পৃথিবীর দিকদিগন্ত আলোকিত করেছে যুগযুগান্তের কিছু অসাধারণ মানুষের অক্লান্ত চেষ্ঠা সাধনা সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের বিনিময়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ব্যবসায়ীকদের সেতু দিয়ে ভারত উপমহাদেশের ইসলামের দাওয়াত পৌঁছলেও তা নির্দিষ্ট বলয়ে সীমাবদ্ধ ছিলো।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা.) র সময় (২৩ হিজরী মোতাবেক ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ) মুকরানের যুদ্ধে সিন্দুর রাজা রাসেল এবং তার দুর্ধর্ষ হিন্দু সেনাদেরকে পরাজিত করে মুসলমানরা হযরত হাকাম ইবনে আমর তাকলিরী (রা.) র নেতত্বে সিন্ধু নদীর তীর পর্যন্ত পৌঁছে খলিফা কর্তৃক অনুমতি না পাওয়ায় এখানেই থেমে যান। উমাইয়া খলিফা ওয়ালীদ ইবনে আব্দুল মালিকের সময় (৯৩ হি. মোতাবেক ৭১১খ্রিষ্টাব্দ) মুসলমানরা সিন্দু বিজয় করেন।

তারা এই সময় রাজ্য শাসনের পাশাপাশি মানসুরা, মুলতান, দেবল, সিনদার, কুসদার, ও কানদাবিল ইত্যাদি এলাকায় বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ভারত উপমহাদেশের ইসলামি জ্ঞান চর্চার সূচনা সেখান থেকেই । সম্রাট মইজউদ্দিন মোহাম্মদ ঘোরী কতৃক দিল্লীতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কালক্রমে কনোজ, বানারস, লখনৌ, বিহার ইত্যাদি এলাকায় ইসলামের পতাকা উত্তোলিত হয়।

এই সময় (৫৯৮ হি. মোতাবেক ১৩০১ খ্রিষ্টাব্দ) ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলায় ইসলামের পতাকা উড্ডিন করেন। তবে স্বীকার করতে হবে, বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত মুসলিম শাসকদের কর্তৃক পৌঁছেনি। এক্ষেত্রে মূল ভুমিকা পালন করেন বিভিন্ন দেশ থেকে আগত আলেম, উলামা, পীর, মাশায়েখ’রা।

ইসলামের শাসন নীতি ‘খিলাফত আলা মিন হাজিহিন নাবুওয়াহ’ ছেড়ে মুসলিম শাসকেরা যখন দূরে যেতে থাকেন তখনই সাধারন মানুষের সাথে তাদের দুরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। যে বাংগালী মানুষেরা হিন্দু ধর্মের শ্রেনী বৈষম্যে আক্রান্ত হয়ে দলে দলে সাম্যের দ্বীন ইসলাম গ্রহন করলেন, দুঃখজনক হলে সত্য তারা বিলাসী মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে ‘খিলাফত-এ-নাবুয়াত’-এর সাম্যনীতি পায়নি। পায়নি শিক্ষার উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা। তবে মাঝেমধ্যে অবশ্য বৈচিত্র ছিলো।

বাংলার মুসলিম শাসকদের মধ্যে সুলতান আলা উদ্দিন হোসেন শাহ (৯০০-২৪ হি. মোতাবেক ১৪৯৩-১৫১৮ খ্রিস্টাব্দ) সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন স্থানিয় মানুষের মুখের ভাষা বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের পৃষ্টপোষকতায়। তাঁর ক্ষমতা লাভের পর (৯০৫ হি. মোতাবেক ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দ) বাংলা এলাকায় কোরআন হাদিস শিক্ষার প্রভূত উন্নতি ঘটে। তিনি ইসলামী জ্ঞান প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলায় আলেম উলামাদেরকে আমন্ত্রন জানান। তিনি বর্তমান মালদহের গৌড়ের ‘গুররা শহীদ’ নামক স্থানে ১ লা রমাজান ৯০৭ হি. মোতাবেক মার্চ ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর কিছুদিন পর তাঁর পৃষ্টপোষকতায় পান্ডুয়ায় ‘নুর কুতুব-ই-আলম’র স্মৃতিস্বরূপ আরেকটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুই মাদরাসাতে হাদিস পড়ানো হতো বলে জানা যায়। বাংলায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত এখানে-ই।

এই সময় রাজধানী ইকদালায় অসংখ্য মুহাদ্দিস (হাদিসের শিক্ষক) ছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মত প্রকাশ করেন। তাদের মতে, হাদিস চর্চার পৃষ্টপোষকতায় সুলতান হোসেন শাহ তৎকালিন গুজরাটের সুলতানদের সমকক্ষ ছিলেন।

সুলতানের অনুরোধে সেই সময়ের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে য়যদান বখশ (৯১১ হি. মোতাবেক ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দ) তিন খন্ডে বোখারী শরিফ নকল করে রাজ্যকে উপহার দিয়ে ছিলেন। সেই সময়ের রাজধানী সোনরগাঁও-এ বাংলাদেশের তৎকালীন সময় কোরআন-হাদিস চর্চার কেন্দ্র ছিলো। প্রখ্যাত ফকীহ শায়েখ আবু তাওয়ামার (মৃত অনুমানিক ৭০০ হিজরী) প্রভাবে সৈয়দ বংশের শাসকেরা (তাদের শাসনকাল ৯০০-৯৪৫ হি. মোতাবেক ১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রি.) সোনারগাঁও কে দ্বীনি শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেন। শায়েখ তকীউদ্দীন ইবনে আয়নুদ্দিন (৯২৯ হি. মোতাবেক ১৫২২ খ্রি.)-এর মতো খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ও ফকীহর প্রচেষ্ঠায় সোনারগাঁও হাদিস চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো।

ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে হাদিস চর্চার সূচনাকালের সাথে বাংলাদেশে হাদিস চর্চার সূচনা ঐতিহাসিকভাবে তেমন একটা দূরে নয়।

ভারত উপমহাদেশের হাদিস চর্চার ক্রমোন্নতি ও প্রসারকালকে ঐতিহাসিকরা তিনভাগে বিভক্ত করে থাকেন,

১) সাখাভী পূর্বযুগ, যা ৮২০-৮৬ হি. মোতাবেক ১৪১৭-৮১ খ্রি. পর্যন্ত।

২) সাখাভীর যুগ, যা ৮৮৬-৯৫৪ হি. মোতাবেক ১৪৮১-১৫৪৭ খ্রি. পর্যন্ত।

৩) সাখাভীর পরবর্তী যুগ, যা ৯৫৪-৯২ হি. মোতাবেক ১৫৪৭-৮৪ খ্রি. পর্যন্ত।

সাখাভীর পূর্ব যুগে মাত্র সাতজন মুহাদ্দিস উপমহাদেশে আসার তথ্য পাওয়া যায়, যার মধ্যে পরিবেশগত প্রতিকূলতার কারণে তিনজনই ফিরে গিয়ে ছিলেন নিজ নিজ দেশে। এরপর উল্লেখযোগ্য কোন মুহাদ্দিস আসার তথ্য পাওয়া যায় না। ৮৮৫ হি. মোতাবেক ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দে হারামাইন শরিফে শায়েখ সাখাভীর হাদিসের ক্লাস শুরু হলে আবার উপমহাদেশে মুহাদ্দিস আসার ধারা শুরু হয়, যা হিজরী দশম শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো।

এই সময়ের ভেতর-ই বাংলায় হাদিস চর্চার ধারা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু দু:খজন হলেও সত্য ভাষাগত ব্যবধানের কারণে হাদিসের আলো দীর্ঘদিন অল্প সংখ্যক মানুষের সীমা অতিক্রম করে সর্বস্থরের মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলার মানুষের জন্য একটি স্মরণীয় বছর।

এই বছরের একদিকে বাংলার সাধারণ মুসলমানদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বিনিময়ে বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে, অন্যদিকে বাঙালী জাতির কৃতিসন্তান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক সহীহ বোখারী শরিফের বাংলা অনুবাদ এবং ব্যাখার কাজ শুরু করেন। তাঁর ষোল বছরের কঠোর সাধনার বিনিময়ে পৃথিবীর সকল বাংলা ভাষীরা উপহার পেলো সাত খন্ডে বোখারী শরিফের বাংলা অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা।

এটা বাঙালী মুসলমানদের উপর তাঁর বড়-ই এহসান। এই পৃথিবীতে বাঙালী মুসলমানদের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে ততদিন শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের প্রতি এ জাতির শ্রদ্ধা পূর্ণিমার শিশির হয়ে ঝরবে।

শায়খুল হাদিসের জন্ম

১৩২৬ বাংলা মোতাবেক ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ঢাকা জেলার মুন্সিগনজ মহকুমার বিক্রমপুর পরগনাস্থ লৌহজং থানাধীন ভিবিচখা গ্রামে শায়খুল হাদিস আজিজুল হক জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শ্রদ্ধেয় বাবার নাম আলহাজ্ব এরশাদ আলী।

আজিজুল হক নামের ইতিবৃত্ত

জন্মের পর তাঁর বাবা নাম রেখে ছিলেন আয়াতুল হক। সাত বছর বয়সে তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে বি-বাড়িয়ার জামেয়া ইউনুসিয়া মাদরাসায় ভর্তি করতে গেলে সদর সাহেব হুজুর (মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী র.) নাম পরির্তন করে আজিজুল হক রাখেন।

শিক্ষা জীবন পাঁচ বছর বয়সে শায়খুল হাদিস আজিজুল হক তাঁর মাকে হারান। সাত বছর বয়স পর্যন্ত তিনি নানার বাড়ীতে-ই ছিলেন। তাঁর নানার বাড়ী লৌহজং থানার কমলা গ্রামে। এই গ্রামের মসজিদে তিনি সর্ব প্রথম বোগদাদী কয়দা পড়তে শুরু করেন। সাত বছর বয়সে তাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে ভর্তি করেন বি-বাড়ীয়ার জামেয়া ইউনুসিয়ায়। সেখানে তিনি মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (র.)র তত্বাবধানে চার বছর লেখাপড়া করে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে চলে আসেন ঢাকার বড় কাটরা মাদরাসায়। এখানে ১২ বছর লেখাপড়া করে দাওরায়ে হাদিস পাস করেন। এ সময় তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন আল্লামা যফর আহমদ উসমানী, আল্লামা রফিক কাশ্মীরী, মাওলানা হেদায়তুল্লাহ (র.) প্রমুখ। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান ভরতে, ভর্তি হন বোম্বের সুরত জেলার ডাবেল ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সেখানে তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হাকিমুল ইসলাম মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানী এবং মাওলানা বদরে আলম মিরাঠী (র.)। আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী (র.) বোখারী শরিফের ক্লাসে যে আলোচনা করতেন মাওলানা আজিজুল হক তা নোট করে রাখতেন। এই নোট-ই তাঁকে একদিন সফল মনজিলে নোঙর ফেলতে পথ দেখিয়েছে। এক বছর তিনি ডাভেলে ছিলেন। শিব্বির আহমদ উসমানী দারুল উলুম দেওবন্দে যাওয়ার সময় তাঁর প্রিয় ছাত্র মাওলানা আজিজুল হককে সাথে নিয়ে যান। দরুল উলুম দেওবন্দে তিনি মাওলানা ইদরিস কান্দলবীর তত্বাবধানে কোরআনের তাফসির বিষয়ে উচচ শিক্ষার পাশাপাশি ১৮০০ পৃষ্ঠায় বোখারী শরিফের উর্দু ব্যাখা লিখেন, যা পাকিস্তানে ‘ফজলুল বারী শরহে বোখারী’ নামে প্রকাশিত হয়।

শায়খুল হাদিসের হাদিস অধ্যায়নের সনদ শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের হাদিস অধ্যয়নের সনদে আমরা দেখতে পাই যথাক্রমেঃ- ইমাম মুহম্মদ ইবনে ইসমাইল বোখারী, শায়েখ মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ ফেরাবরী, শায়েখ আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ সরখসী, শায়েখ আব্দুর রহমান ইবনে মুজ্জাফর দাউদি, শায়েখ আব্দুল আউয়াল ইবনে ঈসা সিজযী, শায়েখ আস-সিরাজুল হোসাইন ইবনুল মোবারব যবীদী, শায়েখ আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে আবু তালেব, শায়েখ ইবরাহীম ইবনে আহমদ তন্নুখী, শায়েখ শিহাববুদ্দিন আহমদ ইবনে হাজার আসকালানী, শায়েখ যায়নুদ্দীন জাকারিয়া আনসারী, শায়েখ শামছুদ্দীন রমলী, শায়েখ আহমদ ইবনে আব্দুল কুদ্দুস শান্নাবী, শায়েখ আহমদ আল-কোশাশী, শায়েখ ইবরাহীম আল-কুর্দী, শায়েখ আবু তাহের মোহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম, শায়েখ শাহ ওলীউল্লা দেহলভী, শায়েখ আব্দুল আজিজ দেহলভী, শায়েখ মোহাম্মদ ইসহাক দেহলভী, শায়েখ আব্দুল গণী মুজাদ্দেদী। শায়েখ আব্দুল গণী মুজাদ্দেদী থেকে দু’টি ভিন্ন ধারা গিয়ে অভিন্ন হয়েছে মাওলানা আজিজুল হকের কাছে। ১) মাওলানা কাসেম নানুতভী, শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান, শিব্বির আহমদ উসমানী, মাওলানা আজিজুল হক। ২) মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াকূব, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা যফর আহমদ উসমানী, মাওলানা আজিজুল হক। (হে আল্লাহ! আমাদের সালাফের ওপর রহমত বর্ষিত কর)।

শায়খুল হাদিসের কর্ম জীবন

ভারতের ডাভেল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আল্লামা আজিজুল হককে শিক্ষকতার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি তাঁর শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক মাওলানা শামসুল হক ফরিদপূরী (র.) এর নিদের্শে চলে আসেন ঢাকাস্থ বড় কাটরা মাদরাসায়। এখানেই তৎকালীন চল্লিশ টাকা বেতনে তাঁর কর্মজীবন শুরু। প্রথম বছরেই তিনি অন্যান্য কিতাবের সাথে মিশকাত শরিফ পড়ান। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বড় কাটরায় শিক্ষকতা করেন। ১৯৫২ তে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী এবং মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর প্রমুখরা জামেয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলে মাওলানা আজিজুল হক বোখারীর শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি লালবাগে বোখারী শরীফের অধ্যাপনার দায়িত্ব আদায় করে শায়খুল হাদিস (হাদিস বিশেষজ্ঞ) হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ঢাকার মোহাম্মদপুরে প্রতিষ্ঠা করেন জামেয়া মোহাম্মদীয়া আরাবিয়া। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে মোহাম্মদপুর সাত মসজিদের পাশে মাদরাসার নিজস্ব ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া। লালবাগ জামেয়া আরাবিয়ায়, মালিবাগ জামিয়া শরইয়্যায়, মোহাম্মদপুর জামেয়া মোহাম্মদীয়ায় তিনি বোখারী শরীফের শিক্ষকতার পাশাপাশি বেশ কিছুদিন প্রিন্সিপালও ছিলেন।

এসবের পাশাপাশি তিনি ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় তিন বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে বোখারী শরিফের অধ্যাপনা করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের অসংখ্য মাদরাসায় বোখারী শরিফের স্বল্পকালীন শিক্ষকতাসহ নিয়মিত শায়খুল হাসিসের দায়িত্ব পালন করেছেন।

মোহাম্মদপুর জামেয়া রহমানিয়ায়, মিরপুর-১৪ জামেউল উলূমে, দারুস সালামে, লাল মাটিয়া জামেয়া ইসলামীয়ায় শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি লালবাগ কিল্লা মসজিদ, মালিবাগ শাহী মসজিদ এবং আজিমপুর ষ্টেট জামে মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের শরিয়া বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে শায়খুল হাদিস একজন সফল ব্যবসায়ীও।

শায়খুল হাদিসের সংসার জীবন

হযরত যফর আহমদ উসমানী (র.) কুমিল্লায় সফরে গিয়ে মেহমান হয়েছিলেন মাওলানা আমিনুল ইসলাম (লালাবাগ শাহী মসজিদের সাবেক খতিব) বাড়ীতে। মাওলানা আমিনুল ইসলামের বাবা তাঁর মেয়ের জন্য পাত্র চাইলে যফর উসমানী বলেন- আমার ছেলের কাছে তোমার মেয়ে দিয়ে দাও। পরে দেখা গেলো ঐ ছেলে অন্য কেউ নয়, মাওলানা আজিজুল হক। কনে পক্ষের পছন্দ হয়ে গেলে বিয়ে হয়ে যায়। ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটিয়ে তাঁর প্রথম স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন দু’ছেলে এবং চার মেয়ে রেখে। কোলের ছেলেটি মায়ের সাথে সাথেই চলে যায় পৃথিবী ছেড়ে।

চার মেয়ে সহ ছেলে মাহমুদের রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব নিয়ে শায়খুল হাদিসের দাম্পত্য জীবনের নতুন সাথী হন উদয়পুরের মাওলানা আজিজুর রহমান সাহেবের মেয়ে। এই স্ত্রীর গর্ভে শায়খুল হাদিসের চার ছেলে এবং চার মেয়ে।

শায়খুল হাদিসের বাবার প্রচন্ড ইচ্ছে থাকার পরও তিনি কোরআনে হাফিজ হতে পারেননি কিন্তুু মহান আল্লাহ পাক তাঁর ছেলে, মেয়ে নাতী, নাতীন সবাইকে কোরআনের হাফিজ করে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তাঁর পরিবারের ৫৪জন কোরআনের হাফিজ রয়েছেন।

রাজনৈতিক জীবন

ছাত্র জীবনে তিনি যে শিক্ষকদের সংস্পর্শ পেয়েছেন তাদের অধিকাংশ-ই ছিলেন বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের সর্বভারতীয় নেতা। দারুল উলুম দেওবন্দের সূচনাই হয়েছে এই আন্দোলনের এক ক্রান্তিলগ্নে শিক্ষা, নেতৃত্ব এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখার চিন্তা-চেতনায়। শায়খুল হাদিস দীর্ঘদিন সেই দারুল উলূম দেওবন্দের ছাত্র ছিলেন। ছাত্র জীবনেই তাঁর রাজনীতির অধ্যায় শুরু হয়ে যায় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সেতু দিয়ে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি তাঁর শিক্ষক মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানী, মাওলানা যফর আহমদ উসমানী, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী প্রমূখদের সাথে ময়দানে সক্রিয় ছিলেন। যুক্তফ্রন্টের সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে আন্দোলন করেছেন।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কাঙ্খিত ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় তিনি উলামায়ে কেরামদেরকে নিয়ে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এ সময় তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আমীরের দায়িত্বে ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ছয় দফা ঘোষিত হওয়ায় পর বাংলাদেশের মানুষের অধিকার বিষয়ে শেখ সাহেবের সাথে তাঁর দীর্ঘ বৈঠক হয়। শেখ সাহেব সেই সময় শায়খুল হাদিসের চিন্তাধারার বেশ প্রশংসা করেন।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীকে শ্রদ্ধা করতেন, গুরু মানতেন, তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য লালবাগ মাদরাসায় যেতেন, তারা দু’জন একই এলাকার লোক। মাওলানা আজিজুল হক মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরীর শুধু ছাত্রই নয়, রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক শিষ্যও। এই সূত্রেই মাওলানা আজিজুল হকের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা ছিলো।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যখন অন্যান্য অনেক ইসলামপন্থী পাকিস্তানের পক্ষে ময়দানে সক্রিয় ছিলেন তখন শায়খুল হাদিসের ভূমিকা ছিলো সম্পূর্ণ নিস্ক্রিয়। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে হযরত হাফেজ্জী হুজুর খিলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক দিলে শায়খুল হাদিস তাতে সাড়া দেন এবং হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সিনিয়র নায়বে আমীরের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে হাফেজ্জী হুজুরের সফর সঙ্গী হয়ে শায়খুল হাদিস ইরাক, ইরান সফর করেন। দু’ দেশের যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে হাফেজ্জী হুজুরের মিশনের যে দীর্ঘ আলোচনা হয় আয়াতুল্লাহ খোমেনী এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সাথে সেখানে শায়খুল হাদিস মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি ড. কলিম সিদ্দিকীর দাওয়াতে লন্ডনে মুসলিম ইনিষ্টিটিউটের সম্মেলনে যোগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। পরবর্তীতে বৃটেনে তাঁর একাধিকবার সফর হয়েছে।

১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের তিনিই মূল রূপকার এবং প্রতিষ্ঠাতা মুখপাত্র ছিলেন, পরবর্তীতে যার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তাঁরই ছাত্র মাওলানা ফযলুল করিম, শায়খে চরমোনাই।

১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।

১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে চেয়ারম্যান করে বাংলাদেশের সমমনা ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে গঠন করা হয় ইসলামী ঐক্যজোট।

আওয়ামীলীগ সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গঠিত চার দলীয় জোটের এক সময় তিনি শীর্ষ নেতা ছিলেন। নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতা লাভ করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা চারদলের সরকার না হয়ে বিএনপি-জামায়েতের সরকারে রূপ নিলে শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের নেতৃত্বাধীন ইসলামি ঐক্যজোটের একাংশের সাথে বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নির্বাচনের পর থেকেই চলছিলো মতানৈক্য।

ইতোমধ্যে খেলাফত মজলিস এবং ইসলামি ঐক্যজোট দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায় (বিস্তারিত দেখুন সৈয়দ মবনু’র ‘দ্রাবিড় বাংলার রাজনীতি’ গ্রন্থে)। শেষ পর্যন্ত ২৩ ডিসেম্বর ’০৬ খেলাফত মজলিশ শায়খুল হাদিস গ্রুপের সাথে আওয়ামী লীগের পাঁচ দফা সমঝোতা স্বাক্ষরের মাধ্যমে একটা ঐক্য হয়। এই পাঁচ দফা হলো-

  • ১. পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ ও শরিয়ত বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না।
  • ২. কওমী মাদরাসা সনদের সরকারি স্বীকৃতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।
  • ৩. হযরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবি, তাঁর পর আর কোনো নবি আসবেন না। যারা এর প্রতি বিশ্বাস রাখে না তারা নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে না-এই মর্মে আইন পাশ করতে হবে।
  • ৪. সনদপ্রাপ্ত হক্বানী আলেমগণ ফতওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করবেন। সনদ বিহীন কোনো ব্যক্তি ফতওয়া প্রদান করতে পারবে না-এই মর্মে আইন পাশ করতে হবে।
  • ৫. নবি-রাসুল এবং সাহাবায়ে কেরামের কুৎসা রটনা করা দন্ডনীয় অপরাধ। (দৈনিক আমার দেশ, ২৪ ডিসেম্বর ’০৬)

এই সমঝোতা চুক্তি হয় শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের আজিমপুরের বাসায়। চুক্তিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে স্বাক্ষর করেন দলের তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল এবং খেলাফত মজলিসের পক্ষে দলের মহাসচিব মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফি। এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় পক্ষে-বিপক্ষে নানা মন্তব্য।

বামপন্থীরা এই চুক্তির বিরুদ্ধে মাথা বেঁধে মাঠে নামেন। তারা বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে থাকেন মূলত নিজেদের আশ্রয়স্থল হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে। অন্য দিকে একই রকমের উপদেশ এবং ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে কোনো কোনো ডান এবং ইসলামপন্থীদের কাছ থেকেও। তারা এই চুক্তির ফলে খেলাফত মজলিশ ও শায়খুল হাদিসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গাল-মন্দ পর্যন্ত করেছেন। প্রকৃত পক্ষে দীর্ঘদিন ইসলামপন্থীরা ছিলেন বিএনপির ভোটব্যাংক, আর বিএনপি ছিলো জামায়াত-নির্ভর। এই চুক্তির মাধ্যমে বিএনপির ভোটব্যাংক ভেঙে যায়। এই চুক্তির পর থেকে ইসলামপন্থীরা স্বাদে-অস্বাদে আর বিএনপির সাথে থাকতে মানসিকভাবে বাধ্য নয়। এই চুক্তি রাজনীতিতে ধর্মব্যবসায়ী হিসেবে আওয়ামীলীগ-বিএনপিকে সমানে সমান করে দিয়েছে। ধর্মের বাজারটা এখন আর একা বিএনপির দখলে নয়। ফলে বিএনপিপন্থীদের রাগ আসারই কথা।

এই চুক্তি কতটুকু ইসলামের স্বার্থে এবং কতটুকু কার্যকরী তা এই মুহূর্তে আলোচ্য বিষয় নয়। কারণ এ কথা আলোচনায় আসলে প্রশ্ন আসতে পারে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলের সাথে ইসলামপন্থীদের সংযুক্তি কতটুকু ইসলামের স্বার্থে? প্রকৃত অর্থে গোটা বিষয়গুলোই রাজনৈতিক দলীয় কিংবা ব্যক্তিস্বার্থ বিষয়ক। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ তার বাম বন্ধুদের সমালোচনার মুখে এই সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে আসে। অতঃপর শায়খুল হাদিস একলা চলো নীতি অবলম্বন করেন। তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে রাজনৈতিক মাঠ থেকে নিস্ক্রিয় হলে তাঁর দল রাজনৈতিক মাঠে বেশ দূর্বল হয়ে যায়।

কারাগারে শায়খুল হাদিস

জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের করতে গিয়ে তিনি সর্বপ্রথম কারা নির্যাতিত হন। এরপর প্রায় প্রতিটি সরকার-ই তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে শায়খুল হাদিসকে জেল নির্যাতন করেছে।

১৯৯২ এর ৬ ডিসেম্বর ভারতের উগ্র হিন্দুদের কর্তৃক ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া হলে শায়খুল হাদিসের প্রতিবাদী কন্ঠ গর্জে উঠে।

১৯৯৩ এর ২-৪ জানুয়ারী বাবরী মসজিদ পূণঃনির্মাণের দাবীতে তিনি ভারত অভিমূখী লংমার্চের আহ্বান করলে প্রায় ৫ লক্ষাধিক লোক এতে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন। যশোর সীমান্তে তৎকালীন বিএনপি সরকারের পুলিশ-বিডিআর মিছিলের উপর গুলি চালালে সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, প্রতিবাদস্বরূপ দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়।

তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও বাংলাদেশ সফরে আসতে চাইলে শায়খুল হাদিস ঘোষণা করেন ‘বাবরী মসজিদ পূণঃনির্মাণ এবং ফারাক্কা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নরসীমা রাও বাংলাদেশে অবাঞ্চিত।’ সরকার এ ঘোষণার প্রতি দৃষ্টিপাত না করে নরসীমা রাও-কে বাংলাদেশ আসতে দিলে (৯ এপ্রিল ৯৩) শায়খুল হাদিস এই দিন বিমান বন্দর ঘেরাও কর্মসূচী ঘোষণা করেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে সেদিন পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় সারা দেশে বিক্ষোভ। তবু সরকার নড়ছিলো না। ৮মে ৯৩ খ্রিস্টাব্দে গোটা দেশ থেকে শায়খুল হাদিসের ছাত্ররা বোখারী শরিফ হাতে নিয়ে জমায়েত হলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে। সরকারের কাছে তাদের একই দাবী-আমাদের সবাইকে কারাগারের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হোক, আমরা শায়খের কাছে বোখারী শরিফ পড়বো। এই দিনই সরকার বাধ্য হয় শায়খুল হাদিসকে মুক্তি দিতে।

১ লা জানুয়ারী হাইকোর্ট থেকে ফতোয়া বিরোধী রায় দেয়া হলে শায়খুল হাদিসের নেতৃত্বে গোটা বাংলাদেশে আন্দোলন গড়ে উঠে। ২ ফেব্রুয়ারী পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় তিনি ফতোয়া বিরোধী রায় বাতিলের দাবীতে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেন।

৪ ফেব্রুয়ারী তিনি রংপুর থেকে সমাবেশ করে ফেরার পথে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেফতার হন। সরকারী রোষানলে পড়ে প্রায় চার মাস কারা অভ্যন্তরে অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে সেই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো শায়খুল হাদিসের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা।

আধ্যত্মিকতায় শায়খুল হাদিস

শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক একাধারে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফিজ্জী হুজুর এবং মীরসরাইতের মাওলানা মোয়াজ্জম হোসেনের খলিফা।

গ্রন্থ রচনা

১) বোখারী শরিফের বাংলা অনুবাদ ও ব্যাখ্যা (সাত খন্ড)।

২) ১৮০০ পৃষ্ঠার বোখারী শরিফের উর্দূ ব্যাখ্যা ‘ফজলুল বারী শরহে বোখারী’, যা উপমহাদেশের মাদরাসাগুলোতে ছাত্ররা পড়ে থাকেন।

৩) ‘মুসলিম শরিফ ও হাদিসের ছয় কিতাব’ নামে তিন খন্ডে হাদিস সংকলন।

৪) মসনবীয়ে রুমীর বাংলা অনুবাদ।

৫) পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও ইসলাম।

৬) কাদিয়ানী মতবাদের খন্ডন।

৭) মুনাজাতে মাকবুল (বাংলা অনুবাদ)।

৮) সত্যের পথে সংগ্রাম (বয়ান সংকলন।)

এছাড়াও তিনি কোরআনে করিমের ওপর বেশ কিছু ছোট ছোট বই রচনা করেছেন।

শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক স্বকীয় স্বত্ত্বায় গৌরবোজ্জ্বল এক মহান ব্যক্তিত্ব। ছাত্র জীবনে, শিক্ষকতায়, আধ্যাত্মিকতায়, রাজনীতিতে, আন্দোলনে, লেখালেখিতে এবং দাম্পত্য জীবনে তিনি এক সফল পূর্ণাঙ্গ মানুষ।

আন্দোলনের ময়দানে তিনি যেমন নিরলস তেমনী আপোষহীন। অর্থ, পদ-পদবীর লোভ কিংবা কোন প্রকারের হুমকি তাকে কোন দিন আপোষকামিতার দিকে নিয়ে যেতে পারেনি। শায়খুল হাদিসের রাজনীতির লক্ষ্য তাঁর নিজের ভাষায় ‘বড় নেতা হতে নয়, দীন ও মিল্লাতের প্রয়োজনে শক্তি সামর্থ অনুযায়ী আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.) এর সন্তুষ্টি এবং মানুষের মঙ্গলার্থে বিভিন্নভাবে রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেছি।’

প্রচলিত নির্বাচনীয় কিংবা গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে সমাজে কিংবা রাষ্ট্রে ইসলামী নীতি-আদর্শের প্রতিফলন ঘটানো খুবই কঠিন বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর দল বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিলেও তিনি নিজে কোনদিন নির্বাচনে প্রার্থী হননি। তাঁর মতে ‘মানবতার সত্যিকার মুক্তি ও মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা নিশ্চিত করার একমাত্র গ্যারান্টি হচ্ছে খেলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থা।’

শিক্ষক হিসেবে তিনি সর্বদা-ই সচেতন ছিলেন। রাজনীতির মাঠে পূর্ণাঙ্গ সক্রিয় থেকেও তিনি মাদরাসায় ক্লাসের সিলেবাস অপূর্ণাঙ্গ রাখতেন না। আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল, মিটিং, জেল, সফর ইত্যাদির ফলে শিক্ষকতায় যে ঘাটতি হয় তিনি তা পূরণ করে নিতেন নিজের বিশ্রামের সময় ব্যয় করে।বিগত জীবনে তিনি মানব জাতিকে যে উপহারসমূহ দিয়েছেন মহান আল্লাহ যেন তাঁকে এর উত্তম বদলা দেন।

ইজে/জেআর