শবে মেরাজ: দিবস নয়, শিক্ষাই মূখ্য

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ১২ ২০২১, ০০:০৩

মুফতি আব্দুল্লাহ নাজীব: মেরাজ ইসলামের গৌরবময় ইতিহাস৷ রাসূলে কারীমের অনন্য সম্মাননা৷ মুসলিম উম্মাহ এই মেরাজের মাধ্যমে সর্বোত্তম ইবাদত; সালাত লাভ করেছে৷ মেরাজের গুরুত্ব ও শিক্ষা অপরিসীম৷

ইসলামের স্বর্ণযুগে স্বরণীয় অজস্র ঘটনা সংঘটিত হয়েছে৷ ইসলাম প্রতিটি ঘটনার শিক্ষাকেই বড় করে দেখেছে, দিবস বা সন-তারীখকে নয়৷ নিছক দিবস পালনকে পছন্দও করেনি৷ তাই ঘটনাগুলোর শিক্ষাকে সংরক্ষণ করা হয়েছে৷ সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ পক্ষান্তরে দিবস বা তারীখকে তেমন গুরত্ব দেয়া হয়নি৷ অনেক ক্ষেত্রে সংরক্ষণও করা হয়নি৷ যতটুকু সংরক্ষণ করা হয়েছে তা ইতিহাসের খাতিরে দিবস পালন বা উৎযাপনের জন্য নয়৷ কারণ ঘটনালব্ধ শিক্ষা জীবনময় হয়৷ জীবনের পরতে পরতে পথ দেখায়, আলো দেয়৷ নির্দিষ্ট দিবসের ফ্রেমে নিবদ্ধ থাকে না৷ পক্ষান্তরে দিবসে পালনের ক্ষেত্রে দিবসটাই মুখ্য হয়ে দাড়ায়৷ দিবসের ফ্রেমে সব কিছু আবদ্ধ হয়ে যায়৷

এছাড়া ইসলাম মর্ম ও হকীকতহীন কাজ পছন্দ করে না৷ যা ঘটার তা এক দিনেই ঘটে গেছে৷ ঐ দিন ফিরে এলেও সেই ঘটনা ফিরে আসবে না, নতুন করে ঘটবেও না৷ তাই বছরের সেই দিবস নিছক এতটি মুহুর্ত মাত্র৷ এর পিছনে নতুন করে ঘটার কিছু নেই৷

পশ্চিমারা আমাদেরকে বাধহীন বিনোদন শিখিয়েছে৷ জীবন কতরূপে আর কত উপায়ে উপভোগ করা যায় তার শিক্ষাও তারা আমাদেরকে দিয়েছে৷ আমরা সেকুলার বনে গেছি৷ সব কিছুতে ধর্ম নয় জীবন ও জগতই মুখ্য হয়ে দাড়িয়েছে৷ মূল উদ্দেশ্য নয় বরং উপভোগই মূল হয়ে আছে৷ তাই কোনো কিছু পালন আর সম্পাদনে উদ্দেশ্যের চে উপভোগই বড় করে দেখি৷ কিন্তু ইসলাম বাস্তবতা আর উদ্দেশ্যকেই প্রধান্য দেয়৷ হাকীকতকে বড় করে দেখে৷ তাই ইসলামে নিছক দিবস পালনের নিয়ম নেই৷

হাঁ, যে সকল দিবসের পেছনে হাকীকত ও মর্ম আছে৷ এবং তা প্রতি বছরই নতুনরুপে সামনে আসে এমন দিবসে নির্দিষ্ট আমলের নিয়ম রয়েছে৷ উদ্দেশ্যহীন উদযাপন নয়; বরং উদ্দেশ্যপূর্ণ নেক আমলের কথা বলা হয়েছে৷ যেমন, আরাফার দিন, কদরের রজনী …৷

সর্বোপরি দিবস পালন মুখ্য না হওয়ায় মেরাজের রজনীর সন তারীখ নিশ্চিতরূপে সংরক্ষণ করা হয়নি৷ তাই মেরাজ কোন তারীখে সংঘটিত হয়েছে তা বেশ মতানৈক্য দেখা যায়৷ ২৭ রজব ১০ নববি-বর্ষ মতটি প্রসিদ্ধ আছে।

আল্লামা আইনি রহ, ১২ নববি-বর্ষকে অগ্রগণ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন।[উমদাতুল কারি- ৪/৩৯]

হাফেজ আবদুল গনি মাকদিসি রহ, তার “সিরাত নববিয়্যাহ গ্রন্থে ১২ রবিউল আওয়াল সােমবার’ মতটি প্রাধান্য দিয়েছেন। কিন্তু ইবনে আব্বাস রা. এর যে রেওয়ায়েত তিনি দলিল হিসেবে পেশ করেছেন, হাফেজ ইবনে কাসির রহ, তাকে মুনকাতি বা দুর্বল বলেছেন।

হাফেজ ইবনে কাসির রহ. তার আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া [৮/২৭০] গ্রন্থে উপযুক্ত বক্তব্য ছাড়াও নিম্নোক্ত মতগুলাে উল্লেখ করেছেন:

১. ইবনে আসাকির রহ. এর নিকট নবুওয়াতের প্রথম বছরগুলােতে হয়েছে (অর্থাৎ হিজরতের ৫ বছর পূর্বে)।

২. ইবনে ইসহাক রহ. এর নিকট নবুওয়াতের দশম বছরে হয়েছে (মাস জানা নেই)।

৩. সুদ্দি রহ. এর মত হলাে হিজরতের ১৬ মাস পূর্বে (যিলকদ ১২ নববি-বর্ষে) তা সংঘটিত হয়।

৪. যুহরি রহ. এর মত হলাে হিজরতের এক বছর পূর্বে (রবিউল আওয়াল ১৩ নববি-বর্ষে) তা সংঘটিত হয়।

হাফেজ ইবনে হাজার রহ. হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে সংঘটিত হওয়ার মতটি দলিলের আলােকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরপর তিনি মেরাজের সময় সম্পর্কে দশটি মত উল্লেখ করেন। সুদ্দি রহ. থেকে তিনি তার এই বক্তব্য নকল করে -হিজরতের ১৭ মাস পূর্বে সংঘটিত হয়- বলেন যে, এই হিসেবে মেরাজের ঘটনাটি রমজান কিংবা শাওয়ালে সংঘটিত হয়ে থাকবে। অন্যান্য মতের কোনটিই তিনি অগ্রগণ্য মত বলে মন্তব্য করেননি। [ফাতহুল বারি- ৭/২০৩]

সর্বোপরি, উপযুক্ত মতগুলাে থেকে কোনাে একটি অগ্রগণ্য সাব্যস্ত করা অনেক কঠিন। এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, সবকটি মতই দুর্বল রেওয়ায়েতের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন অবস্থায় উত্তম পদ্ধতি হলাে পূর্বের ঘটনাবলির ধারাবাহিকতা লক্ষ করা, ফলে আলােচ্যবিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনাে প্রমাণ ও ইঙ্গিত মিলে যেতে পারে। হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে কিংবা এক বছর পূর্বে কোনােটিই পূর্বের ঘটনাবলির ধারাবাহিকতা ও গতির সঙ্গে খাপ খায় না। তবে হিজরতের ১৭ মাস পূর্বের যে মতটি ইবনে হাজার আসকালানি রহ. সুদ্দি রহ. থেকে বর্ণনা করেছেন, তা যুক্তিসঙ্গত।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে সুস্পষ্ট হলাে ইবনে সাদের বক্তব্য, এটি সুদ্দির মতেরও কাছাকাছি। তিনি বলেন, হিজরতের আঠারাে মাস পূর্বে রমজানের ১৭ তারিখ শনিবার রাত যখন হলাে…। [তাবাকাতে ইবনে সাদ- ১/২১৩] ১৭ রমজান মাদানি পঞ্জিকা অনুযায়ী, মক্কি পঞ্জিকা মােতাবেক ১৭ রজব হয়। আর যদি মক্কি পঞ্জিকার ২৭ রজবের মশহুর বক্তব্য মেনে নেওয়া হয়, তা হলে মাদানি পঞ্জিকা তথা চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী তা ২৭ রমজান ১২ নববি-বর্ষের ঘটনা হবে। তার খ্রিষ্টাব্দ তারিখ হবে ২৬ এপ্রিল ৬২১ সাল। আলি মুহাম্মদ খান এই মতটি গ্রহণ করেছেন। [তাকওয়ীমে আহদে নববি, পৃষ্ঠা ৮০, ১১৬] ( দ্র. তারীখে উম্মতে মুসলিমাহ)

সর্বোপরি মেরাজের তারীখ নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন৷ তাই দিবস আর তারীখের পেছনে না পড়ে মেরাজের শিক্ষাকে জীবনময় করে তুলি৷

উসতায,উলূমুল হাদীস ও দাওয়াহ বিভাগ,

দারুল উলূম হাটহাজারী চট্টগ্রাম।

নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক মুঈনুল ইসলাম