লীগের কথা কহিতেছি

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ১১ ২০১৯, ১৮:০১

আনাস হামযা: আজিকে আমি ‘লীগে’র কথা কহিব। আপনারা সকলেই জ্ঞাত রহিয়াছেন, কিছুদিন পূর্বে ‘লীগে’র অধীনে, ভুল করিলাম, নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন হইয়াছে। বিরোধী দল ব্যতীত – যাহাদের প্রধান কর্মই হইল বিরোধীতা করা, সবাই এই কথাই বলিতেছে। বিরোধীদল তো বিরোধীতা করিবেই, ইহাতে আশ্চর্যান্বিত হইবার কিছু নাই। আমরাও আশ্চর্য হই নাই। কিন্তু ইদানীং তাহাদের অপপ্রচারের মাত্রা এতই বাড়িয়া গিয়াছে যে, সাধারণ মানুষ তো বটেই, লীগের নেতাকর্মীরা পর্যন্ত বিভ্রান্ত হইয়া যাইতেছে যে, আমরা কি ভুল কিছু করিলাম! সুতরাং তাহাদের এ অন্যায় অপপ্রচারে বাধ্য হইয়া কলম হাতে লইলাম – যাহাতে আমাদিগের নির্বাচন পূর্ববর্তী সকল কর্মকান্ড সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করিতে পারি।
আমাদিগের সম্পর্কে তাহারা বলিয়া থাকে, আমরা নাকি টাকা দিয়া ভোট কিনিয়া, নিশিরাত্রিতে ব্যালট ভরিয়া, এবং ভয় দেখাইয়া ভোটদানে বিরত রাখিয়া নির্বাচন জিতিয়াছি। জিতিয়াছি বৈ কি! কিন্তু এই লেখায় আমি প্রমাণ করিয়া দিব, আমরা যাহা করিয়াছি দেশ ও দশের স্বার্থেই করিয়াছি।
আসলে রাজনীতি তো আমরা দেশের স্বার্থেই করিয়া থাকি, কিন্তু জনগণ সমঝদার নহে। সারাটা জীবন উহাদের পেছনে ব্যয় করিয়া দাও, সেইসব কখনো ধর্তব্য হইবে না। উহারা তোমার সমস্ত জীবনের একটিমাত্র মন্দকর্ম দেখিয়াই ‘হায় হায়’ করিয়া উঠিবে এবং সজোরে টানিয়া নর্দমায় নিয়া ফেলিবে। এরশাদ কাকুর উদাহরণ উপস্থিত করিতে পারি। দেশের নামে কত কিসিমের পথ-ঘাট ও পোল-কালভার্ট তিনি করিয়া দিলেন, দিনশেষে জনগণ তাহাকে কলার খোসার ন্যায় ছুঁড়িয়া ফেলিল। এখনো তিনি আপনারই তৈরী পথে-ঘাটে কলার খোসার ন্যায় পড়িয়া রহিয়াছেন।

তবে আমাদিগের নির্বাচনপূর্ব কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ করিবার পূর্বে আমি এই দেশের জনগণ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জ্ঞানদান করিতে চাই, যাহাতে বিজ্ঞ পাঠক বুঝিতে পারেন – কেন আমাদিগের এই কর্মকান্ড?

জনগণ বাস্তবে সব পঙ্গপালের ন্যায়। কারণে অকারণে না বুঝিয়া মাতামাতি করে। মনে করুন, শাড়ি পরিয়া বিধবা সাজিয়া জিয়ার ‘ওয়াইফ’ কোন এলাকায় গিয়া জনসভা করিলেন, টাকা-পয়সা খরচ করিয়া অর্থাৎ লোকজন ভাড়া করিয়া মাঠ ভরিলেন, পত্রপত্রিকায় খবর ছাপিল – ‘বিশাল জনসভায়’ ইত্যাদি ইত্যাদি, আর ব্যস, জনগণের একটি প্রজাতি জিয়ার ‘ওয়াইফে’র দলে গিয়া ভিড়িবে। আমরা যে এতদিন পালিয়া পুষিয়া বড় করিলাম, তাহার প্রতি ভ্রুক্ষেপই করিবে না! বঙ্গসাহিত্যে ইহাদেরকে বলা হয়, ‘গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাইয়াছে’, সরল কথায়, ভেড়ার পালে গিয়া ভিড়িয়াছে। উহারা তো ঠান্ডা মাথায় ভাবিয়া ভোটও প্রদান করিতে পারিবে না। ভাবিল, দুই বার তো ‘লীগ’ থাকিয়াছিল, এই বার ‘দল’ থাকুক, এই ভাবিয়া একদল আসিয়া ব্যালট ভরিবে। আপনারাই বলুন, এমন নেমকহারাম জনগোষ্ঠীর দেশে কী উন্নতি সাধিত হইবে?! গণতন্ত্রের নামে এই দেশে যে বস্তু রহিয়াছে, তাহা যে গণতন্ত্রের বৃক্ষ, এমনকি চারাগাছও নহে, বরং আগাছা, তাহা সকলেই অবগত রহিয়াছেন। তদুপরি যেই দেশে এমন পঙ্গপালসদৃশ জনতা বসবাস করে, সেথায় গণতন্ত্র কীভাবে প্রতিষ্ঠা হইবে!
অতএব সরল পথে অগ্রসর হওয়া আমাদিগের পক্ষে ছিল চূড়ান্ত বোকামি। নির্বাচনের পূর্বে ‘লীগে’র গোলটেবিল বৈঠকে আমরা প্রায় চুলচেরা বিশ্লেষণ করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম – এই জনতার নিকট ভোটকেন্দ্র ছাড়িয়া দেওয়ার অর্থ পাগলের হস্তে ক্ষমতা সোপর্দ করা। দেখা যাইবে সকলে মিলিয়া দেশটাকে একেবারে রসের অতলে নিমজ্জিত করিতেছে। এ সংক্রান্ত একটি ‘সুস্বাদু’ ঘটনা পাঠকবৃন্দের সম্মুখ-পাত্রে ‘পরিবেশন’ করিবার লোভ সামলাইতে পারিতেছি না।
পশ্চিমে কোন একটা দেশ ছিল। যাহার প্রজারা বিশেষ বোধসম্পন্ন ছিল না। সরল কথায়, উহাদের বুদ্ধির বাটি গোবরভর্তি ছিল। একদা রাজা স্বপ্নে দেখিলেন – কেহ বলিতেছে, আগামীকালের বৃষ্টিতে যেন কেহ স্নান না করে, অন্যথায় সকলেই পাগল হইয়া পড়িবে। দেশে খরা চলিতেছিল। সকলে চাতক পাখির ন্যায় আকাশপানে চাহিয়া ছিল। রাজা ঘোষণা করিবার পূর্বেই দেখা গেল সকলে স্নানপর্ব সমাপ্ত করিয়াছে। অতঃপর আর কী! প্রজারা রাজপথে বস্ত্রহীন নৃত্য শুরু করিল। জানা যায়, অবশেষে উহারা ‘কাপড় পরা’ রাজাকে পাগল ভাবিয়া রাজ্যছাড়া করিয়াছিল এবং তাহাদের মধ্য হইতে ‘বস্ত্রহীন’ একজনকে রাজা বানাইয়া লইয়াছিল।
আমরাও কি জনতার হস্তে ভোটকেন্দ্র ছাড়িয়া দিয়া পাগল নির্বাচিত করিব? কস্মিনকালেও নহে! লীগ ক্ষমতায় থাকিতে এইরূপ ‘অনাচার’ কীভাবে সহ্য করি? জনতা আত্মহত্যা করিবে – ইহা আমরা কীভাবে বরদাশত করিতে পারি? যাহা হউক, গোলটেবিলে সিদ্ধান্ত হইল, যে কোন মূল্যে জনতাকে এইরূপ আত্মহত্যা হইতে বাঁচাইতে হইবে।
‘উপর’ হইতে নির্বাচনায়োজন করিবার জন্য ‘স্বল্প’ খরচাপাতি আসিয়াছিল। উহা হইতে ‘সামান্য’ পরিমাণ পকেটস্থ করিবার পর আমরা সিদ্ধান্ত লইলাম, এইবার আমরা জনগণকে কিছু দান-খায়রাত করিব। দান-খায়রাত হইল অতি পুণ্যকর্ম। নির্বাচনের পূর্বেই কেন এ পুণ্যকর্ম, এইরূপ অযৌক্তিক প্রশ্ন অনেকে তুলিতে পারে। আমরা তো বরং বিশ্বাস করি, দান-খায়রাতের পক্ষে নির্বাচনপূর্ব সময়ই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। কেননা এই সময় ইহার ফলাফল হাতেনাতে মিলিয়া যায়। পরন্তু জিয়ার ‘ওয়াইফ’ যদি টাকা ঢালিয়া মাঠ ভরিতে পারেন, আমরা টাকা ঢালিয়া ব্যালটবাক্স ভরিলে দোষটা কোথায়, তাহাই তো বোধগম্য হইতেছে না!

যাহা হউক, পূর্ণ দশটি দিন আমরা পরিকল্পনামাফিক প্রচারণা চালাইলাম, দান-সদকা করিলাম, কতিপয় মোটরবাইক ভাড়া করিয়া বাইকমিছিলও করিলাম, সে বড় আনন্দময় সময় যাপিত হইল। এই প্রথম দেশ ও দশের জন্য কিছু করিলাম বলিয়া মনে হইল।
দিনশেষে রাত্রি আসিতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই বহু প্রতীক্ষিত শুভ রজনীটি আমাদিগের জীবনেও আসিয়া উপস্থিত হইল। সেই রাত্রে আমরা ‘রণসজ্জায়’ সজ্জিত হইলাম। যেন মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা হামলার প্রস্তুতি লইতেছি। হাঁ, ইহাকে আমি গেরিলা হামলাই বলিব। প্রতিপক্ষ প্রস্তুত হইবার পূর্বেই আমরা ব্যালটবাক্সে ঝাঁপাইয়া পড়িতেছি – যেমন মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপাইয়া পড়িতেন অপ্রস্তুত হানাদারের উপর, অতঃপর শহরকে হানাদারমুক্ত করিতেন। এতবৎসর পরে আমরাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করিতেছি। একে একে আমরা সাতটি ব্যালটবাক্স দখল করিয়া লইলাম,যত্র প্রতিপক্ষের আর প্রবেশাধিকার থাকিল না। নির্বাচন কমিশন হইতে নিযুক্ত এক পুতুল-সৈনিক আমাদিগের কর্মযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করিতেছিল, আমরা উহাকে বলিলাম, তুমি লড়াই করিতে আসিও না, তাহাতে তোমার প্রাণাশঙ্কা অর্থাৎ চাকরিক্ষয় ঘটিতে পারে, তুমি বরং নিশ্চল দাঁড়াইয়া দেখিতে থাক – কীভাবে গেরিলা যুদ্ধ করিতে হয়। দবির মিয়া আরেকটি বাক্স দখল করিতে চাহিতেছিল, আমি বাঁধা দিলাম, মোট ভোটার অপেক্ষা ভোট বেশি পড়িলে সমস্যা হইবে।

পরদিবসে ভোটযুদ্ধের ফলাফল নির্ধারিত হইল। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিরই জয় হইল। আমাদিগের অক্লান্ত শ্রম ও পরিশ্রমের বদৌলতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গত হইল।

রিপন মিয়া – যাহার বৃদ্ধাঙ্গুলিতে ভোটের কালিচিহ্ন তো রহিয়াছে, কিন্তু সে ভোট প্রদান করিতে পারে নাই, তাহাকে দেখিয়া আমরা সমস্বরে কহিলাম, জয় বাংলা!!