রিফাত: আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার সিম্বল

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ০৩ ২০২৩, ১৯:৪৩

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর: গতকাল ঢাকার একটি হাসপাতালে এক মাওলানা সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি হয়তো আমার লেখা-টেখা পড়ে চিনতেন আমাকে, এগিয়ে এলেন। হাসিমুখে হাত মেলালাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম আমরা। কথার এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এমনিতে আপনি আর কোথায় কী করেন?

আমি বললাম, লেখালেখি করি, বাকি সময় কৃষিকাজ করি। এছাড়া আর কিছু করি না।

তিনি হেসে উঠলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী করেন?

তিনি ঢাকার সবচে বড় মাদরাসা থেকে দাওরা শেষ করে পাশেই এক মাদরাসা থেকে ইফতা সম্পন্ন করেছেন। এরপর ঢাকায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। এখন দেশের বাড়ি কুমিল্লায় নিজেদের মাদরাসায় পড়ান। এর আগে তিনি নোয়াখালীর একটি মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে ছিলেন, সে কথা বলতে ভুললেন না। এবং আশাবাদ ব্যক্ত করলেন, শিগগির তিনি ঢাকার কোনো এক মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে চলে আসবেন…

তার কথায় আমি বাগড়া দিয়ে বললাম, ঢাকায় আসবেন কেন? ঢাকায় কি হুজুরের কমতি আছে? নাকি ঢাকায় ইলমের কমতি আছে যে আপনাকে ঢাকায় এসে ইলম বিতরণ করতে হবে? আপনি যে এলাকা থেকে এসেছেন সেখানে বরং আপনার প্রয়োজন ও হক বেশি। আপনি ঢাকায় উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন আপনার এলাকায় গিয়ে ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণ করবেন বলে। ঢাকায় এসে মাদরাসার শিক্ষক হওয়ার মধ্যে আপনার ব্যক্তিগত লাভ ছাড়া দ্বীনের তো কোনো লাভ নেই।

আমার কথায় মাওলানা সাহেব নাখোশির হাসি হাসলেন।

আজকে সুনামগঞ্জের নিভৃত এক গ্রামের মক্তব-শিক্ষার্থী রিফাতকে নিয়ে সোস্যাল মিডিয়া সরগরম। দেশের গণমাধ্যমও তাকে নিয়ে সংবাদ প্রচার করছে। রিফাত যেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার নূরানী মক্তবের সিম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকের প্রশ্নের উত্তরে তার সহজ সরল উত্তর আর কনফিডেন্স সব মানুষকে আমোদিত ও বিমোহিত করেছে।

আমি স্যালুট জানাই রিফাতের শিক্ষক মাওলানা আবদুল কুদ্দুসকে। যিনি ঢাকা বা জেলা সদরের বড় মাদরাসার শিক্ষক-মুহাদ্দিস না হয়ে গ্রামের এক সামান্য মক্তব-শিক্ষক হয়েছেন। সবচে বড় বিষয় হলো, তিনি তার শিক্ষকতাকে ভালোবেসে গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং তিনি এই শিক্ষাদান কর্মকে ইনজয় করছেন। তিনি ছোট ছোট রিফাতদের মাঝে খুঁজে পেয়েছেন তার ইলম বিতরণের নববী ধারা।

তাই রিফাত যখন সরল মনে বলে, হুজুর, আপনের লিগাও আমি দোয়া করি…। তখন আমাদের চোখ জলে ভরে যায়। কয়জন শিক্ষক এমন পাওয়া যাবে যার জন্য তার শিক্ষার্থীরা প্রাণ খুলে দোয়া করে? (ভিডিও লিংক )

আমি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় বেশ কয়েকবার সফর করেছি। এসব সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল উত্তরবঙ্গে ইসলামি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও প্রসারের ব্যাপারে কিছুটা ধারণা নেয়া। আপনারা জানেন কিনা জানি না, উত্তরবঙ্গের পাঁচ-সাতটি জেলা এমন রয়েছে যেখানে দাওরায়ে হাদিস মানের কোনো কওমি মাদরাসা নেই। দাওরায়ে হাদিস বাদ, কোনো কোনো পুরো জেলায় মাধ্যমিক মানেরও কোনো কওমি মাদরাসা নেই। এর ফলাফল কী দাঁড়িয়েছে জানেন? ওইসব জেলায় খ্রিষ্টান মিশনারিদের তৎপরতা এবং তাদের নানামুখী প্ররোচনায় মানুষের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের হার সবচেয়ে বেশি।

এই দেশে কওমি মাদরাসা ইসলামের দূর্গ। আর যেখানে ইসলামের দূর্গ না থাকবে সেখানে অধর্ম বিস্তার লাভ করবেই।

সবচে দুঃখের বিষয় হলো, এসব জেলা থেকে যেসব শিক্ষার্থী ঢাকা-চট্টগ্রাম বা আশপাশের জেলাগুলোর বড় মাদরাসায় পড়তে যান, তারা সাধারণত পড়াশোনা শেষ করে মাওলানা-মুফতি হয়ে আর এলাকায় ফিরে যান না। ঢাকা-চট্টগ্রাম বা অন্য কোনো জেলার ‘বড়’ মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে ‘মুহাদ্দিস’ পদ অলংকৃত করেন। এই প্রবণতার ফলে তার এলাকার মানুষ ভিন্ন মতাবলম্বী, শিরকপূজারী, এমনকি ধর্মহীন হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিকে তার কোনো দায়িত্ববোধ বা ভ্রূক্ষেপও নেই। এ কেমন ইসলাম আমরা শিখছি, আল্লাহ মালুম!

নিজ এলাকায় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করলে তাকে মক্তবের শিক্ষক বলা হবে, তার বেতন কম হবে, বন্ধু-স্বজনদের সামনে তাকে হেয় হতে হবে- এমন ভয়েই হয়তো উত্তরবঙ্গের মাদরাসা-শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা তাদের নিজ এলাকায় ফিরে যান না। এটা সত্যি আফসোসের বিষয়। আমরা মাদরাসায় পড়ি এবং মানুষকে শিক্ষা দেই আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল-ভরসা করার ব্যাপারে। কিন্তু নিজেদের বেলায় আমরা তা পালন করতে ভয় পাই।

বিগত হাজার বছর ধরে যে উত্তরবঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ঘটেছে, সেই উত্তরবঙ্গ আজ আমাদের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার কারণে ধর্মহীন হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে কষ্টের বিষয় আর কী হতে পারে!

অদূর ভবিষ্যতে আমার ইচ্ছা আছে, উত্তরবঙ্গের নিভৃত কোনো এলাকায় একটি মাদরাসা কমপ্লেক্স তৈরি করার। আমি উত্তরবঙ্গের মানুষ না, আমার বাড়ি ঢাকায়। কিন্তু আমি উত্তরবঙ্গের মাদরাসা-শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য একটি ভরসার জায়গা তৈরি করতে চাই, যাতে তারা উত্তরবঙ্গ নিয়ে নতুন করে ফিকির করেন। আমার ফিকিরে উত্তরবঙ্গজুড়ে বড় কোনো ইমপ্যাক্ট তৈরি হবে না, যদি না সেই এলাকার আলেম-তলাবারা নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা কাঁধে তুলে না নেন। তাদের ফিকিরেই একদিন উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত জনপদে ইসলামের দূর্গ গড়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।