রাসূল সা. এর জীবনের নবুওয়াতপূর্ব অধ্যায়

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ২৮ ২০২০, ১৮:৫২

মুফতি আহমদ যাকারিয়া:
নবী মুহম্মদ সাঃ এর জীবন চরিত্র বর্ণনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই তার পূর্বের কিছু কথা আলোচোনায় চলে আসে । তখন আরবের সমাজ ব্যবস্থা ও নৈতিক অবস্থা ছিল শোচনীয় এবং একেবারেই বিপর্যস্ত। দাসত্বের শৃংখলে অষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা ছিল । সিংহাসন নিয়ে দলাদলি, হত্যা, বিবাদ, শিশুবধ, নারী নির্যাতন, ব্যভিচার, অশিক্ষা, জুয়াখেলা, মদ্যপান ইত্যাদি ছিল তখনকার নিত্য নৈমিত্তিক  সমাজিক ঘটনা। ধর্ম বলতে ছিল তাদের শুধূ কতগুলি পাথরের মূর্তি। তখন রোম ও পারস্যের উশৃংখল রাজা-বাদশাদের দ্বারা শাসিত ছিল আরব অঞ্চল। এককথায় সমস্ত কিছু মিলিয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত পথহারা ছিল তখনকার আরব জাতি। তাই সে যুগের নাম দেয়া হয়েছে “আইয়ামে জাহেলিয়া” বা “অন্ধকারের যুগ”।
নবী সা. এর জন্মের পূর্বাভাস:
যেকোন নবীর জন্মের সময় ও তার কিছু আগে এবং পরে অলৌকিক নানা ঘটনা ঘটেছে, যাতে সাধারাণ মানুষ আল্লাহর নবীকে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হতে পারে। তবে যেকোন নবীর চেয়ে এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল আমাদের নবী মোহাম্মদ  সা. এর ক্ষেত্রে এবং এসব ঘটনাও ছিল অনেক বেশি বিস্ময়কর।
এর কারণ হলো যে, নবী সা. ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর উপর নাজিল হওয়া ধর্ম বা শরিয়তও ছিল সবচেয়ে পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ। আর এই ধর্ম কিয়ামত পর্যন্ত বা বিশ্বের শেষ দিন পর্যন্ত টিকে থাকবে ও শক্তিশালী হয়ে থাকবে। অন্য নবী-রাসূলরা এসেছিলেন বিশেষ জাতি ও বিশেষ সময়ের জন্য। কিন্তু ইসলামের নবী এসেছেন সব মানুষ ও জিনের জন্য এবং কিয়ামত পর্যন্ত এই নবীর আনীত ধর্মই আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
নবী সা. এর জন্মের প্রাক্কালে ও জন্মের পরে সংঘটিত কিছু অলৌকিক ঘটনা: 
১. ইমাম সাদিক্ব রাহ. বলেছেন, শয়তান বা ইবলিস অতীতে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত যেতে পারত। অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য সে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত যেত। কিন্তু হজরত ঈসা আ. এর জন্মের পর থেকে চতুর্থ আকাশের উপরে ওঠা তার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এরপর যখন বিশ্বনবী সা. জন্ম নেন তখন তার জন্য সব আকাশই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। শয়তানকে আকাশের দরজাগুলো থেকে ধূমকেতু দিয়ে বিতাড়ন করা হয়।
২. যে ভোর বেলায় মহানবী সা. জন্মগ্রহণ করেন, সেদিন বিশ্বের সবগুলো মূর্তি মাটির দিকে নত হয়ে পড়ে।
৩. সেদিন পারস্যের রাজার বিশাল প্রাসাদের বারান্দা কেঁপে ওঠে এবং ছাদের ১৪টি প্রাচীর ধ্বসে পড়ে।
৪. সেদিন পারস্যের সভে অঞ্চলের হ্রদটি তলিয়ে শুকিয়ে যায়। বহু বছর ধরে এই হ্রদকে পূজা করা হত।
৫. সামাভে অঞ্চলে ( কুফা ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী) পানির প্রবাহ শুরু হয়। অথচ এর আগে বহু বছর ধরে সেখানে কেউ পানি দেখেনি।
৬. পারস্যের শিরাজ শহর সংলগ্ন অগ্নি উপাসনালয়ের আগুন সেই রাতে নিভে যায়। অথচ ওই আগুন এক হাজার বছর পর্যন্ত প্রজ্বলিত ছিল।
৭. সেই রাতে হিজাজ বা বর্তমান সৌদি আরব থেকে একটি আলো দৃশ্যমান হয় এবং তা পূর্বাঞ্চলসহ সারা বিশ্বের ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্বনবীর মাতা মা আমিনা বলেছেন, আল্লাহর কসম! আমার পুত্র জন্ম নিয়েই তাঁর হাতগুলোকে মাটিতে রেখে মাথা আকাশের দিকে তোলে এবং চারদিকে তাকায়। এরপর তার থেকে একটি নূর বা আলো ছড়িয়ে পড়ে এবং সে আলোয় সব কিছু দৃশ্যমান হয়। সেই আলোয় সিরিয়ার (রোমানদের) প্রাসাদগুলো দেখলাম এবং সেই আলোর মধ্যে একটি শব্দ শুনলাম, যাতে বলা হয়েছে, সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষকে জন্ম দিয়েছ, তাই তাঁর নাম রাখ ‘মুহাম্মাদ’।
আমিরুল মু’মিনিনি হজরত আলী রা. বলেছেন, সে রাতে তথা রাসুল সা. এর জন্মের রাতে পুরো দুনিয়া আলোকিত হয়। প্রতিটি পাথর ও মাটির টুকরো এবং বৃক্ষ বা গাছ হেসেছে। আর আকাশ ও জমিনের সব কিছু আল্লাহর তাসবিহ বা প্রশংসা জ্ঞাপন করেছে।
(সূত্র: খাসায়েসে কোবরাও তারিখুল খামিদ গ্রন্থে আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহ. উল্লেখ করেন, মা আমিনা বলেন, যখন আমার প্রিয় পুত্র ভূমিষ্ঠ হলো তখন আমি দেখতে পেলাম সে সিজদায় পড়ে আছে।)
নবীজি সা. এর জন্ম:
এ কথা সত্য, অপসংস্কৃতির ঘোর অন্ধকারে যখন তামাম পৃথিবী সয়লাব, মানবসমাজে মনুষ্যত্ব ও মানবতা যখন ধুলায় মিশ্রিত, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা করুণ, ব্যক্তিপূজা, অগ্নিপূজাসহ বহুঈশ্বরে বিশ্বাসী আরব সমাজ যখন অত্যন্ত কলুষিত, নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি যখন একেবারেই অনুপস্থিত এবং অস্থিরতা, অরাজকতা ও অশান্তি যখন সর্বত্র বিরাজমান ঠিক তখনই বিশ্বের সব মানুষের শান্তি ও কল্যাণের শাশ্বত বার্তা নিয়ে এ পৃথিবীতে শুভাগমন করেন মহামানব হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
যখন মক্কায় এই অবস্থা, তখন আল্লাহ্   পৃথিবীতে পাঠালেন তাদেরকে আলোর পথে নিয়ে আসতে এক পথপ্রদর্শক। যার হাতে ছিল শান্তির মশাল, মুখে ছিল প্রশান্তির বাণী। যার অন্তর ছিল সমস্ত গুনের আলোয় আলোকিত এক পরশ পাথর। সেই পরশ পাথরের স্পর্শে সমস্ত পাপ, পঙ্কিলতা, হিংসা, বিদ্বেষ, বিবাদ, বিষংবাদ আস্তে আস্তে পরিণত হলো ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে। তিনিই হলেন আল্লাহর মোস্তফা (নির্বাচিত ব্যক্তি) রাহমাতাল-লিল-আল-আমিন, (বিশ্বের জন্য করুনা স্বরূপ) আল হাবিব(আল্লাহর বন্ধু)।
শিল্পীর নিজ হাতেগড়া বস্তু তার দক্ষতায় এতই মনোরম হয় যে, শিল্পী তার ভালোবাসায় নিজেই মুগ্ধ হয়। এমনকি শিল্পী প্রদর্শনী করে তার গুণগড়িমার প্রচার-প্রসার করে। আল্লাহ তায়ালাও মোহম্মাদ সা. এর ক্ষেত্রে তাই করেছেন। মুহম্মদ সা. আল্লাহ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ মাহবুব, সর্বাধিক প্রিয়, এই সত্যের প্রকাশ ভঙ্গিমায় পবিত্র কোরানের এই আয়াতটি লক্ষণীয়-
“আপনি বলে দিন যে, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, এবং তা প্রতিপন্ন করতে চাও তবে আমার অনুসরন তোমাদের করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে শুধূ এটাই প্রতিপন্ন হবে যে, তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস বরং আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তোমাদেরকে ভালোবাসিবেন”। (পারা-৩, রুকু ১২)
সমগ্র সৃষ্টির সেরা মোহাম্মাদ সা. আসমান-জমীন , চন্দ্র-সূর্য, জ্বীন-মানব ,বেহেশত-দোজখ , ফেরেশতা সমস্ত কিছুই  মুহাম্মদ সা. এর পরে সৃষ্টি করা হয়েছে। মোহাম্মদ সা. ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের  ১২ রবিউল আউয়াল মতান্তরে ৯/৮ রবিউল আউয়াল সোমবার এই পৃথিবীতে মক্কার কুরাইশ বংশের মা আমিনার উদরে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রিয় নবী সা. -এর জন্মের সময় ছিল সুবহে সাদিকের পর এবং সূর্যোদয়ের পূর্বক্ষণ। যখন নবী সা. মাতৃগর্ভে ছিলেন তখন মা আমিনা স্বপ্নে দেখেন যে, এক উজ্জ্বলতর আলো সিরিয়ার প্রাসাদসমূহ পর্যন্ত আলোকিত করছে। এ আলোকরশ্মি মা আমিনা নবীজির তাশরিফলগ্নে স্বচক্ষে পুনরায় দেখতে পান। পুণ্যময় আলোয় তার ঘর আলোকিতও হয়।
রসুলুল্লাহ সা.-এর শুভাগমনের সংবাদ পেয়ে তার প্রিয় দাদা আবদুল মুত্তালিব আনন্দিত হন এবং তাকে কোলে তুলে নিয়ে কাবা শরিফে গমন করেন এবং আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জানিযে কল্যাণ ও বরকতের জন্য দোয়া করেন।
তার চাচা আবু লাহাবকে যখন সুয়াইবা নামীয় এক দাসী পেয়ারা নবীর আগমনের খবর জানান তখন আবু লাহাব ভাতিজার জন্মের কথা শুনে খুশি হয়ে আপন দাসী সুয়াইবাকে আজাদ করে দেন।
মোহাম্মদ সা. এর জন্ম অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তির মতো কোন রাজার ঘরে সোনার চামচ মুখে নিয়ে হয়নি। বিধবা মা আমিনার ঘরে যিনি ছিলেন নিতান্তই দরিদ্র, দ্বীনহীন এবং সাধারণ কিন্তু জগতের সেরা ভাগ্যবতী মা তার কুটিরে জন্ম নিলো আল্লাহর সেরা সৃষ্টি মোহাম্মদ সা.।
একদিকে পৃথিবীর দেবালয়ে নবুওয়াত রবির আবির্ভাব ঘটে। ঠিক সেই সময়ই ওকস্মাত পারস্যের রাজপ্রাসাদ ধবংস হয়ে যায় ভূমিকম্পে, শ্বেত উপসাগরের সমস্ত পানি শুকেয়ে যায়, জুলুমকারী রাজাদের তক্তপোষ থরথর করে কেঁপে উঠে। এটা অবশ্যই রাসূল সা. জন্মগ্রহণের পরবর্তী পর্যায়ের প্রথম মো’জেযা।
নবী সা. এর শিশুকাল:
পর্যায়ক্রমে সমাজ এবং পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী পিতার অবর্তমানে দাদা তার ব্যয়ভার গ্রহন করেন এবং যখন অতি আনন্দের সঙ্গে নাম রাখেন “মোহাম্মদ” অর্থাত প্রশংসিত, তখন আরবের বেশ কিছু লোক প্রশ্ন করলো, “দেব-দেবীর নাম না রেখে মোহাম্মাদ নাম কেন তিনি বেছে নিলেন? তখন দাদা আব্দুল মুত্তালিব উত্তর দিলেন, “আমি মনে করি যে, একদিন আমার এই শিশুটি আল্লাহর দ্বারা এবং তাঁর সৃষ্টির দ্বারা প্রশংসিত হবে। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের ভবিষ্যতবাণী অক্ষরে অক্ষরে পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়। নবীজির প্রথম ধাত্রী মা ছিলেন চাচা আবু লাহাবের দাসী “সুওয়াইবিয়াহ”। এবং মোহাম্মদ সা. এর জন্মের খুশীতে আবু লাহাব দাসী সুওয়াইবিয়াহকে তার দাসত্বের বন্ধন থেকে পর্যন্ত মুক্ত করে দেন। এরপর “বিবি হালিমার” ঘরে দুধ পান করার জন্য তাঁর ঠাই হয়।
বনী সাদাত গোত্রের আবু জাইয়িব’র কন্যা হালিমা নামের মহিলা ছিলেন নবীজির ধাত্রী মাতা। তিনি ছিলেন নিতান্তই রুগ্ন ও দুর্বল প্রকৃতির মানুষ।
সন্তান নেওয়ার জন্য মা হালিমা গ্রাম থেকে শহর এলাকা মক্কায় আসলে তার শারীরিক গঠন দেখে কোন ধনী পিতা-মাতাই তাঁদের সন্তান তাঁর কাছে দিতে রাজী হন নাই। আর এদিকে মুহাম্মদ সা. ছিলেন এতিম এবং মা আমিনা ছিলেন অতি দরিদ্র এক নারী। তাই তাঁর সন্তানও কোন ধাত্রী নিতে রাজী হচ্ছিলেন না এতিম দেখে। কারণ এতিম ছেলে নিলে টাকা বা বিনিময় পাবে কম এই ভয়ে। শেষপর্যন্ত মা হালিমা-ই মোহম্মাদ সা. কে দেখা-শুনার দায়িত্বভার নিলেন।
কথিত আছে যে, মোহম্মদ সা. এর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ধাত্রী মা হালিমার ঘরে-বাইরে তাঁর সংসারে অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকে। দেশে সে বছর প্রচন্ড দুর্ভিক্ষের মধ্যেও তার মাঠ ফসলে ভরে যায়। তার ৫টি উট, গাভীর দুধ ছিলো প্রচুর। অথচ এলাকার অন্যান্য লোকের গাভীর ওলান ছিল তখন দুধ শূণ্য। মাঠে পশুদের খাবারের জন্য ছিল না পর্যাপ্ত ঘাস। কিন্তু হালিমার পশু যে মাঠেই বিচরণ করত সে মাঠেই ঘাসে ভরে যেত। তার সংসারের সমস্ত অভাব-অনটন দূর হয়ে যায়। শিশু বয়সেই মোহাম্মদ সা. এর জীবনে কিছু আশ্চর্য ঘটনা ঘটে; যা সবাইকে মুগ্ধ করে। হালিমার আর একটি কোলের শিশু ছিল। কোনদিনও শিশু মোহাম্মদকে নাকি হালিমা তার দুই স্তনের দুধ খাওয়াতে পারতেন না। প্রথম রোজার মাসে লক্ষ করা যায় যে, শিশু মোহম্মদকে নাকি শত চেষ্টা করেও সমস্ত দিন কিছু খাওয়ানো যেত না। সন্ধার পর ইফতারের সময় তিনি ক্ষুধায় কান্না করতেন। হালিমার স্বামী হারিস বলেন, “যে শিশুর পালনের ভার আমরা নিয়েছি, তার উপর নিশ্চয়ই আল্লাহর আশীষ রয়েছে”।
হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের সময় সৃষ্ট বিবাদ ও তা নিরসন:
কাবা গৃহ পুনঃনির্মাণের সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়স ছিল ৩৫ বছর। তখন হাজরে আসওয়াদ স্থাপনের বিষয়ে বিভিন্ন গোত্রের লোকেদের মধ্যে বিবাদ তৈরী হয় এই বিষয়ে যে, এটা কোন গোত্রের লোকেরা প্রতিস্থাপন করবেন? এটা নিয়ে। সৃষ্ট বিবাদ নিরসনকল্পে একটি সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয় যে, আগামীকাল যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম কাবাঘরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে সেই এ ব্যাপারে ফয়সালা পেশ করবে। তার ফয়সালাকে সকলে খোদায়ী ফয়সালা হিসেবে মেনে নিবে। আল্লাহ তাআলার কুদরতে পরের দিন সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবেশ করলেন। তাকে দেখে সকলে সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল এই যে আমাদের প্রিয় ‘আল আমীন’! আমরা সকলে তার প্রতি সন্তুষ্ট। তিনি একটি চাদর বিছিয়ে স্বহস্তে পাথরটি চাদরের উপর রেখে দিলেন। এরপর প্রত্যেক গোত্রের প্রতিনিধিকে বললেন, তারা যেন প্রত্যেকে চাদরের এক প্রান্ত ধরে পাথরটি দেয়ালের কাছে নিয়ে যায়। তারা যখন নিয়ে গেল তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বহস্তে পাথরটি উঠিয়ে যথাস্থানে স্থাপন করলেন।
(আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২৬৩; আল কামিল ফিত তারীখ ২/৪২, ৪৫; তারীখুল ইসলাম যাহাবী ১/৫৩-৫৪; আল মুনতাযাম ফী তারীখিল মুলূকি ওয়াল উমাম ইবনে জাওযী ২/৩২১, ৩২৪; সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ ২/১৭২)
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে রাসূল সা. এর সিরিয়া সফর:
সিরিয়ায় প্রথম সফর:
আল্লাহ তাআলা পুরো পৃথিবীকেই মানুষের ধর্ম ও কর্মের জন্য অবাধ বিস্তৃত করে রেখেছেন। আর এ বিশাল বিস্তীর্ণ পরিসরের প্রতিটি স্থানেই রয়েছে আল্লাহপ্রদত্ত কোনো কল্যাণ ও জীবনোপকরণ। তাই শিক্ষা অর্জন কিংবা জীবিকা উপার্জন অথবা ধর্মের তাগিদে মানুষকে ছুটে যেতে হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।  মুহাম্মদ সা.ও তাঁর বরকতময় জীবনে নানা প্রয়োজনে দূরদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। সে দেশগুলো ইতিহাসে ‘বিলাদুশ শাম’ (সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও ফিলিস্তিন) নামে পরিচিত।
তৎকালীন সময়ে এই ‘বিলাদুশ শাম’ আরব ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বর্তমান আন্তর্জাতিক ভৌগোলিক সীমারেখায় তা কয়েকটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত।
বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রাসুল সা. দু’বার সিরিয়া সফর করেন। প্রথমবার মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁর শ্রদ্ধেয় চাচা আবু তালিবের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। ২৫ বছর বয়সে আরবের বিত্তশালী বিধবা নারী খাদিজা রা.-এর ব্যাবসায়িক পণ্য নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সিরিয়ায় গমন করেন। নবুওয়াতপূর্ব এ দু’টি সফরেই রাসুল সা. থেকে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ পেয়েছিল।
সিরিয়ার নিকটবর্তী শহরে জারজিস নামক এক খ্রিস্টান ধর্মযাজক বাস করতেন; তাঁর উপাধি ছিল বুহায়রা বা বাহিরা। আগের আসমানি গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত শেষ নবীর সব নিদর্শন সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন।
সেই সফরে কী হয়েছিল বা কী ঘটেছিল তা “আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া” কিতাব থেকে হুবহু তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
চাচা আবু তালিবের সঙ্গে রাসুলুল্লাহ সা. এর সিরিয়া সফর এবং পাদ্রী বাহীরার সঙ্গে সাক্ষাত প্রসঙ্গ:
ইবনে ইসহাক বলেন, অতঃপর আবু তালিব বাণিজ্য উপলক্ষে একটি কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া রওয়ানা হন। প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যেই মাত্র তিনি রওয়ানা হন, ঠিক তখনি রাসুলুল্লাহ সা. আবু তালিবকে জড়িয়ে ধরেন৷ এতে তার প্রতি আবু তালিব বিগলিত হয়ে পড়েন এবং বলে ওঠেন যে, একে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাব৷ আমিও তাকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করব না সে যেভাবে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাচ্ছে না।
যাই হোক, রাসুলুল্লাহ সা.-কে সঙ্গে করে আবু তালিব রওয়ানা হন।  কাফেলা সিরিয়ার “বুসরা” নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করে৷ সেখানকার একটি গীর্জায় একজন প্রসিদ্ধ পাদ্রী অবস্থান করেন৷ তার নাম ছিল বাহীরা বা বুহায়রা। খৃষ্টীয় ধর্মের তিনি বড় পণ্ডিত ছিলেন৷ পাদ্রী ঐ গীর্জায়ই সব সময় থাকতেন৷ খৃষ্টানদের ধারণা মতে, খ্রীষ্টীয় ধর্মগ্রন্থে তিনিই ছিলেন শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত৷ উত্তরাধিকার সূত্রে এই জ্ঞান তারা পেয়ে থাকেন৷
মক্কার এই বণিক কাফেলা এর আগেও বহুবার এ পথ চলাচল করেছে৷ কিন্তু পাদ্রী বাহীরা এতকাল পর্যন্ত কখনো তাদের সঙ্গে কথাও বলেননি এবং তাদের প্রতি ফিরেও তাকাননি গুরুত্ব দিয়ে৷ কিন্তু এই যাত্রায় কাফেলা পাদ্রীর গীর্জার নিকটে অবতরণ করলে পাদ্রী তাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেন৷ কাফেলার লোকজনের ধারণা মতে, পাদ্রী হয়তো তার গীর্জায় আমরা এসেছি বলে কিছু একটা মেহমানদারি করতে চাইতেছেন। কাফেলার লোকেরা সামনে অগ্রসর হয়ে পাদ্রীর কাছাকাছি একটি গাছের ছায়ায় অবস্থান নেয়৷ পাদ্রী রাসুলুল্লাহ সা. কে মেঘের ছায়া প্রদান এবং তার প্রতি গাছের ডাল-পালা ঝুকে থাকছে লক্ষ্য করেন৷ এসব দেখে পাদ্রী তার গীর্জা হতে বেরিয়ে আসেন তৎক্ষণাত৷ এদিকে তার আদেশে খাবার প্ৰস্তত করা হয়৷ এবার তিনি কাফেলার নিকট লোক প্রেরণ করেন। কাফেলার প্রতিনিধি দল পাদ্রীর নিকট উপস্থিত হলে পাদ্রী বলেন, ওহে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেছি৷ আমার একান্ত কামনা হলো যে, তোমরা প্রত্যেকে আমার এই
আয়োজনে উপস্থিত হবে, বড়-ছোট, গােলাম-আযাদ সকলেই এক সাথে খাবে৷ জবাবে একজন বলল, আজ
আপনি ব্যতিক্রম কিছু করছেন দেখছি৷ ইতিপুর্বে ক্খনাে তো আপনি আমাদের জন্য এরুপ আয়োজন করেননি৷ অথচ এর আগেও বহুবার আমরা এই পথে যাতায়াত করেছি৷ আজ এমন কি হলো বলুন তো? বাহীরা বললেন, ঠিকই বলেছ!তোমার কথা যথার্থ। ব্যাপার তেমন কিছু নয়৷ তোমরা মেহমান৷ একবেলা খাবার খাইয়ে তোমাদের মেহমানদারী করতে আশা করেছিলাম; এই তো বিষয়, আর কি।
কুরাইশ বণিক কাফেলার সকলেই পাদ্রীর নিকট সমবেত হন৷ বয়সে ছোট হওয়ার কারণে রাসুলুল্লাহ সা. গাছের নিচে তাদের মালপত্রের নিকট থেকে যান৷ পাদ্রী যখন দেখলেন যে, কাফেলার সব লোকই এসেছে৷ কিন্তু তিনি যে গুণ ও লক্ষণের কথা জানতেন, তা কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে না৷ তখন তিনি বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমার খাবার থেকে তোমাদের একজনও যেন বাদ না যায়৷ লোকেরা বলল, হে সম্মানিত পাদ্রি বাহীরা! আপনার নিকট যাদের আসা উচিত ছিল, তাদের একজনও অনুপস্থিত নেই৷ কেবল বয়সে আমাদের সকলের ছোট একটি বালক তাবুতে রয়ে গেছে৷ পাদ্রী বলল, “না, তা করো না৷ তাকেও ডেকে পাঠাও, যেন সেও তোমাদের সঙ্গে এই খাবাবে শরীক হতে পারে ৷” বর্ণনাকারী বলেন এর জবাবে কাফেলার এক কুরাইশ সদস্য বলে উঠল, লাত-ওজ্জার শপথ ! মুহাম্মদ ইবন আবদুল্লাহ ইবন আবদুল মুত্তালিব এই খাবারে আমাদের মধ্য থেকে অনুপস্থিত থাকা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য-ই বটে। অতঃপর সে নিজে উঠে গিয়ে মুহাম্মদ সা.-কে কোলে করে এনে সকলের সঙ্গে আহারে বসিয়ে দেয়৷ বাহীরা তাকে দেখে গভীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং তার দেহে সেসব লক্ষণ দেখার চেষ্টা করেন, যা তিনি তার ধর্মীয় কিতাব ইঞ্জিলে ইতিপূর্বে পেয়েছিলেন৷
আহার পর্ব শেষে সকলে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। এই সুযোগে বাহীরা রাসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে গিয়ে বললেন, “হে বালক! আমি তোমাকে লাত-ওজ্জার শপথ দিয়ে জানতে চাচ্ছি, আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করবো, তার যথার্থ জবাব দিবে কি?” বাহীরা লাত-ওজ্জার
নামে এই জন্যই কসম খেয়েছিলেন যে, তিনি মুহাম্মদ সা.-এর সম্প্রদায়কে এ দুই নামের শপথ করতে অভ্যস্ত বলে দেখেছিলেন বা শুনেছিলেন৷ যাই হোক, জবাবে রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, আপনি আমাকে লাত-ওজ্জার নামে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না৷ আল্লাহর শপথ! আমি এই দু’টোর মত অন্য কিছুকেই এত বেশি ঘৃণা করি না৷ বাহীরা বললেন, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে যা যা জিজ্ঞেস করবো, তার যথাযথ জবাব কি তুমি দিবে?রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, আপনার যা ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করুন৷ বাহীরা রাসুলুল্লাহ সা.-কে তার ঘুম, আকার-আকৃতি ইত্যাদি সব বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন৷ রাসুলুল্লাহ সা. এক এক করে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন। তার প্রদত্ত সব বিবরণ বাহীরার পুর্ব থেকে জানা নবীর গুণাবলীর সঙ্গে হুবহু মিলে যায়৷ তারপর বাহীরা তার পিঠে দৃষ্টিপাত করে পূর্ব থেকে জানা বিবরণ অনুযায়ী তার দু’টি স্কন্ধের মধ্যবর্তী স্থানে নবুওয়াতের মোহর দেখতে পান।
পাদ্রী বাহীরা এবার নবীজির চাচা আবু তালিব-এর দিকে ফিরে বললেন এই বালক আপনার কী হয়? আবু তালিব বললেন, আমার পুত্র। বাহীরা বললেন, না তো; সে আপনার পুত্র নয়৷ এই বালকের পিতা জীবিত থাকতে পারে না৷ আবু তালিব বললেন, ও আমার ভাতিজা৷ পাদ্রী বললেন, ওর পিতার কি হয়েছে? আবু তালিব বললেন, ও যখন তার মায়ের গর্ভে তখন ওর পিতা মারা যান৷ পাদ্রী বললেন, ঠিক বলেছেন।  আপনার ভাতিজাকে নিয়ে আপনি তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যান৷ তার জন্য এই অঞ্চল নিরাপদ নয়।
(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৫১৭)
আর এই ছেলের ব্যাপারে ইহুদীদের থেকে সতর্ক থাকবেন। আল্লাহর শপথ! ইহুদীরা যদি তাকে দেখতে
পায় আর আমি ওর ব্যাপারে যা কিছু বুঝতে পেরেছি, যদি তারা তা বুঝতে পারে, তাহলে ওরা তার অনিষ্ট করবে। আপনার এই ভাতিজাটি ভবিষ্যতে বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী একজন মহামানব হবেন৷ আপনি
তাকে নিয়ে শীঘ্রই দেশে ফিরে যান৷ আবু তালিব সিরিয়ার বাণিজ্য শেষ করে রাসুল্লাহ সা.-কে নিয়ে তাড়াতাড়ি মক্কায় ফিরে আসেন।
ইবনে ইসহাক বলেন, যারীরা, ছামামা ও দারিসমা আহলে কিতাবের এই তিন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিও বাহীরার মতো উক্ত সফরে রাসুলুল্লাহ সা. কে দেখেছিল এবং তাকে সনাক্ত করতে পেরেছিল৷ তারা রাসুল সা.-এর ক্ষতিসাধন করার চেষ্টাও করে৷ কিন্তু  বাহীরা তাদেরকে নিবৃত্ত করেন এহেন হীন কর্মকাণ্ড থেকে। তিনি তাদেরকে আল্লাহর কথা এবং তাওরাতে মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে যে বিবরণ আছে, সে সবের কথা স্মরণ করিয়ে দেন৷ তারা তার বক্তব্য বুঝে ফেলে এবং তাকে সত্য বলে মেনে নেয়৷ ফলে তারা মুহাম্মদ সা. কে ছেড়ে দিয়ে নিজ ঘরে ফিরে যায়৷
(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৫১৮)
আর সীরাতে মোস্তাফা কিতাবে এটাও উল্লেখ আছে যে, পাদ্রি কিশোর মুহাম্মদ সা.-এর অবয়ব, আচরণ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেন এবং তিনি তাঁর মধ্যে আখেরি নবীর নিদর্শন দেখতে পেয়ে তাঁর হাত ধরে বলেন, ‘ইনি হচ্ছেন বিশ্ব জাহানের সর্দার। আল্লাহ তাঁকে বিশ্ব জাহানের রাসুল মনোনীত করবেন।’
কাফেলার লোকজন বলেন, ‘আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে, তিনিই হবেন সর্বশেষ নবী?’ বললেন, ‘তোমাদের আগমনের সময় দূর থেকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি যে, এমন কোনো বৃক্ষ কিংবা প্রস্তরখণ্ড বাকি ছিল না, যা এই কিশোরকে সিজদা করেনি। আর এসব সৃষ্টিরাজি নবী-রাসুল ছাড়া অন্য কাউকে কখনো সিজদা করে না। তার কাঁধের নিচে ‘মোহরে নবুওয়াত’ দেখেও আমি তাঁকে চিনতে পেরেছি। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল সূত্রে আমরা এসব তথ্য আগেই পেয়েছিলাম।’
(সিরাতে মুস্তফা : ১/১১৬-১১৭)
সিরিয়াতে ব্যবসার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় সফর:
মানবতার মুক্তির দিশারি মুহাম্মদ সা. অন্ধকারাচ্ছন্ন, পাপ-পঙ্কিলতাময় এ বসুন্ধরায় জাহেলিয়াতের সব অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার-অশান্তি অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড- বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বমানবতার জন্য একটি পরিপূর্ণ আদর্শ জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সামাজিক অর্থনীতি সুস্থ রাখার লক্ষ্যে তিনি যেসব আদর্শ ও মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেগুলো একেকটি অমূল্য শিক্ষা। অর্থনীতি সুষ্ঠু ও বৈষম্যহীন করতে হলে সেগুলোর বিকল্প নেই। বিশেষকরে মানব নিষ্পেষণ ও সমাজবিধ্বংসী অন্যতম আইন সুদ, ঘুষ, লটারি ও মজুদদারি প্রভৃতি তিরোহিত করেছেন শক্ত হাতে। আল্লাহ প্রেরিত ওহির আলোকে তিনি হালাল ব্যবসাভিত্তিক একটি সর্বোত্তম, অভূতপূর্ব আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ করেছিলেন। রাসূল সা. নিজে ব্যবসা করেছেন। অন্যদের ব্যবসা করতে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি যে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই মক্কা শহর আরব উপদ্বীপের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। হজরত ইব্রাহিম আ. দোয়া করেছিলেন, ‘অতএব, হে আল্লাহ! আপনি লোকদের মনকে তাদের প্রতি আগ্রহী বানিয়ে দিন এবং তাদের রিজিক দিন নানা ধরনের ফলমূল দিয়ে, যেন তারা শোকর করতে পারে।’
(সূরা ইব্রাহিম : ৩৭)
এ দোয়াও মক্কাবাসীর জন্য খুবই কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে।
পঁচিশ বছর বয়সের সিরিয়ার দ্বিতীয় সফরেও “নাসতুরা” নামক এক সংসার-বিরাগী সন্ন্যাসী রাসুল সা.-এর মাঝে শেষ নবীর আলামত দেখতে পেয়েছিলেন। সেই সফরে খাদিজা রা.-এর কৃতদাস “মাইসারা” রাসুলের সঙ্গে ছিলেন। “নাসতুরা” মাইসারাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নবীর চোখে কি লাল ডোরা রয়েছে?’ “মাইসারা” বলল, ‘উনার ওই লাল বর্ণ কখনো দূর হয় না।’
তত্ক্ষণাৎ সন্ন্যাসী বলে উঠল, ‘তিনি বিশিষ্ট ব্যক্তি, তিনিই নবী, এবং তিনিই হবেন সর্বশেষ নবী।’ তাছাড়া প্রচণ্ড রোদে রাসুলের উপর অলৌকিক ছায়া এবং ব্যবসায় অপ্রত্যাশিত বিপুল মুনাফা মাইসারা ও খাদিজা রা.-কে অভিভূত করেছিল।
(সিরাতে মুস্তফা: ১/১৩০-১৩১)
যৌবনে উপনীত হওয়ার পর মেষ চরানো এবং পরে ব্যবসার মাধ্যমে শুরু হয় মহানবী সা. এর অর্থনৈতিক জীবন। তাঁর ব্যবসায়িক সুনাম ও ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ার কারণে খাদিজা রা. তাকে প্রথমত ব্যবসা ও দ্বিতীয়ত স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। হজরত খাদিজা রা. ছিলেন একজন ধনবতী, ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী মহিলা। তিনি তার পুঁজি দিয়ে লাভ-ক্ষতির অংশীদারিত্বভিত্তিক যৌথ ব্যবসা করতেন। খাদিজা রা. মহানবী সা. এর সততা ও উত্তম চরিত্রের কথা জানতে পেরে তাঁকে পুঁজি নিয়ে সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে যাওয়ার জন্য আবেদন জানালেন। মহানবী সা. তার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং দ্বিগুণ পুঁজি ও বিনিময় নিয়ে খাদিজার ক্রীতদাস ‘মায়সারাহ’র সঙ্গে সিরিয়ার পথে বাণিজ্যিক সফরে বের হলেন। বিগত সফরগুলোর তুলনায় এবার সফরে দ্বিগুণ লাভ হলো। ‘মায়সারাহ’ খাদিজার কাছে রাসূল সা. এর বিশ্বস্ততা ও মহান চরিত্রের বর্ণনা দিলেন। খাদিজা রা. বিশেষত রাসূল সা. এর সংস্পর্শে আসার পর তার সম্পদে যে সমৃদ্ধির চিহ্ন ফুটে উঠেছে, তা দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। তিনি তার বান্ধবী ‘নাফিসাহ’র মাধ্যমে রাসূল সা. এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। রাসূল সা. এ ব্যাপারে তাঁর চাচাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলে তারা বিয়ে সম্পন্ন করেন। স্বামী হিসেবে রাসূলুল্লাহ সা. খাদিজার ব্যবসার তত্ত্বাবধান করতেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেও খাদিজার পুঁজি নিয়ে পুরোদমে ব্যবসা করছিলেন। তিনি ছিলেন বাণিজ্য নগরী মক্কার সর্বাধিক পুঁজিবান ব্যবসায়ী। নিঃসন্দেহে এ দীর্ঘ ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাই তাঁর জন্য মদিনায় অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল বলে প্রমাণিত হয়েছিল।
মূল কথা হলো যে, মোহাম্মদ সা. হলেন ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রবর্তক। অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে মুহাম্মদ সা. ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা। তার এই বিশেষত্বের অন্যতম কারণ হচ্ছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় জগতেই চূড়ান্ত সফলতা অর্জন। তিনি ধর্মীয় জীবনে যেমন সফল তেমনই রাজনৈতিক জীবনেও পরিপূর্ণ সফল। সমগ্র আরব বিশ্বের জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে তিনি অগ্রগণ্য। বিবাদমান আরব জনতাকে একীভূতকরণ তার জীবনের অন্যতম সফলতা। তাই সংকটময় পৃথিবীর এই পরিস্থিতি উত্তোরনে নবী সা. জীবনী পাঠ ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সঠিক বাস্তবায়ন ই হবে পৃথিবীবাসীর মুক্তির একমাত্র উপায়। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে রাসূলের জীবনী পাঠ করতে এবং রাসূলের প্রতি মোহাব্বাত লালন করতে তাওফীক দান করুন। আমীন।