রাসূলুল্লাহ’র (সা.) দৃষ্টিতে কবি এবং কবিতা 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ২২ ২০১৯, ১৯:৪০

হাসান মাহমুদ

কবিতায় যেমন ভালো দিক আছে , ঠিক তেমনি মন্দ দিকটাও আছে। একদিকে যেমন অশ্লীলতা রয়েছে, অপরদিকে তেমনি সৎ উপদেশ ও নীতিবাক্যও রয়েছে । কবিতায় ভালো-মন্দ দু’টি দিক থাকায় রাসুল (সা.)-এর মনোভাবও তার প্রতি দুই ধরণের ছিল । মন্দ ও অশ্লীল কবিতার প্রতি তাঁর ছিল বিরূপ মনোভাব। সেজন্য অশ্লীল কবিতা শুনতে ও আবৃত্তি করতে স্বভাবতই রাসুল (সা.) নিরুৎসাহিত করেছেন এবং তার রচয়িতা কবিদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করেছেন। রাসুল (সা.) মন্দ কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, “তোমাদের কারো পেটে (এমনি মন্দ) কবিতা থাকার চেয়ে সে পেটে পুঁজ জমে তা পচে যাওয়া অনেক ভালো।” আয়েশা (রা.) হাদীসটি শুনে বলেছিলেন, রাসুল (সা.) কবিতা দ্বারা ঐ সমস্ত কবিতা বুঝিয়েছেন, যে কবিতায় তাঁর কুৎসা রচিত হয়েছে। (বুখারি)। ইবনে রাশিক তার উমদা গ্রন্থে এর ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন, এখানে সেই ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যার অন্তরে কবিতা এমনভাবে বদ্ধমূল হবে এবং কবিতায় সে এমনভাবে মত্ত হয়ে যাবে। যার ফলে কবিতা তাকে দ্বীন থেকে গাফেল করে দিবে। এবং সে কবিতা তাকে আল্লাহর যিকির,নামায ও কুরআন তেলাওয়াত থেকে বিরত রাখবে। আর এক্ষেত্রে শুধু কবিতাই নয় বরং যার ভ‚মিকা এ ধরনের তাই নিষিদ্ধ। যেমন জুয়া খেলা। আর যেসব কবিতার ভ‚মিকা এ ধরনের নয় বরং তা সাহিত্য,কৌতুক ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয় তাতে কোনো দোষ নেই। তাই দেখা যায়, খুলাফায়ে রাশেদীন, বহু-উচ্চ পর্যায়ের সাহাবি, তাবেঈ, ফকিহ প্রমুখ কবিতা আবৃত্তি করেছেন।

অপরদিকে ভালো কবিতা সম্পর্কে রাসুল (সা.) ভালো ধারণা পোষণ করেছেন, কোথাও তার উচ্ছ¡াসিত প্রশংসা করেছেন। কোথাও বা আগ্রহভরে কবিতা শুনতে চেয়েছেন। কোথাও সেসব কবিতা আবৃত্তি করতে সাহাবি কবিদের নির্দেশ দিয়েছেন। সেসব অর্থাৎ ভালো কবিতা বলতে বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। কখনো সেই কবিদের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। আবার কোথাও বা কবিকে পুরস্কৃত করেছেন; আবার কখনো স্বয়ং নিজেই কবিতা আবৃত্তি করেছেন। (জাবি যাদাহ আলী ফাহমি, হুসনুস সাহাবা)। রাসুল (সা.) এর কবিতা আবৃত্তি নিয়ে এবার জানা যাক। কবিতা সম্পর্কে রাসুল (সা.) সাধারণ মনোভাব ব্যক্ত করে বলেছেন, “কবিতা একধরনের কথামালা। কথার মধ্যে যেগুলো উত্তম ও সুন্দর কথা, কবিতার মধ্যেও সেগুলো উত্তম ও সুন্দর কথা। আবার কথার মধ্যে যেগুলো খারাপ ও ঘৃণিত কথা, কবিতার মধ্যেও সেগুলো খারাপ ও ঘৃণিত কথা। ইমাম বুখারি (র.) তাঁর আদাবুল মুফরাদ গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে এ মর্মে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন-রাসুল (সা.) বলেন,কবিতা কথার মতই। ভালো কথা যেমন সুন্দর ভালো কবিতাও তেমনি সুন্দর, এবং মন্দ কবিতা মন্দ কথার মতই মন্দ। (মেশকাত)। ইবনে রাশিক তাঁর উমদা গ্রন্থে হজরত রাসুল (সা.) থেকে এ ধরণের অন্য একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, হযরত রাসুল (সা.) বলেন- কবিতা সুসমঞ্জস্য কথামালা। যে কবিতা সত্যনিষ্ঠ সে কবিতা সুন্দর। আর যে কবিতায় সত্যের অপলাপ হয়েছে সে কবিতায় কোনো মঙ্গল নেই। (ইবনে রাশিক আল-কায়রাওনী)। অপর এক হাদীসে আছে- কবিতা হল বাক্য। আর বাক্যের মধ্যে খারাপও থাকে ভালোও থাকে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হাদীস হল: ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক বেদুঈন রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে আলাপ করতে লাগল। তার আলাপে বিমোহিত হয়ে রাসুল (সা.) বললেন, “কোনো কোনো বর্ণনায় যাদু রয়েছে। আর কোনো কোনো কবিতায় রয়েছে প্রকৃষ্ট জ্ঞানের কথা। (তিরমিজি)।

এক বর্ণনায় আছে, আমর ইবনুল-আহতাম-এর কথা যখন রাসুল (সা.)-কে বিমোহিত করে ছিল তখন উপরোক্ত উক্তি করার সাথে-সাথে ছন্দোবদ্ধভাবে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, আমি ভয় পাচ্ছি, তুমি যাদুকর হয়ে যাবে। কখনো বর্ণানাকারী হবে আর কখনো কবি হবে। (ইবনে আবদ রাব্বিহ, আল-ইকদুল ফারীদ)। হজরত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে। রাসুল (সা.) শুধু যে কবিতার প্রশংসা করেছেন তাই নয় বরং বহুক্ষেত্রে বিভিন্নরূপে কবিতার প্রতি তাঁর আন্তরিকতা প্রকাশ করেছেন। (মুসলিম)। সচ্চরিত্রবান কবির উত্তম ও সুন্দর কবিতা শুনতে রাসুল (সা.) আনন্দবোধ করতেন। রাসুল (সা.) অনেক কবিতা আগ্রহভরে শুনেছেন, এবং আরো কবিতা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। শারীদ আস-সাকাফী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একবার রাসুল (সা.)-এর পেছনে আরোহণ করেছিলাম। পথিমধ্যে রাসুল (সা.) বলেন, তোমার কী উমাইয়া ইবনে আবিস সাল্ত-এর কবিতা জানা আছে? আমি জবাবে বললাম হ্যাঁ জানা আছে। রাসুল (সা.) বললেন আবৃত্তি করো। আমি একটি কবিতা আবৃত্তি করলাম, তিনি বলেন আরো কবিতা শোনাও। আরো একটি কবিতা আবৃত্তি করলে রাসুল (সা.) বলেন আরো শোনাও। এমনি করে সেদিন আমি একশ’টি কবিতা আবৃত্তি করে রাসুল (সা.)-কে শোনালাম। (ইবনে আবদ রাব্বিহ্,আল-ইকদুল ফারীদ)। অন্য এক বর্ণনায় আছে, কবিতা শুনে রাসুল (সা.) বলেছিলেন এই ব্যক্তির জিহŸা ঈমান এনেছে কিন্তু অন্তর কুফরি করেছে। উমাইয়া ইবনে আবিস সাল্ত এর মতো একজন মুশরিক কবির কবিতা শুনেও রাসুল (সা.) পরাঙ্খমুখ হননি, বরং তিনি কবিতা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তার কারণ হল কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু ভালো ছিল। এ থেকে বুঝা যায়, ভালো কবিতার প্রতিরাসুল (সা.) এর কতোই না আগ্রহ ও অনুরাগ ছিল। (জাবী যাদাহ আলী ফাহমী, হুসনুস সাহাবা)। মহিলা সাহাবি কবি খানসা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার সময় কবিতা আবৃত্তি করলে, রাসুল (সা.) বললেন, আরো কবিতা শোনাও হে খুনাস! জাবির ইবনে সামুরা (রা.) বলেন,আমি রাসুল (সা.) এর সাথে একশ’টিরও বেশি বৈঠকে বসেছি। বৈঠকে রাসুলের (সা.) সাহাবিরা কবিতা আবৃত্তি করতেন। সাহাবিরা জাহেলি যুগের কোনো কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতেন (এবং ঠাট্টা করতেন) আর রাসুল (সা.) তখন চুপ থাকতেন, আবার কখনো সাহাবিদের হাসিতে যোগ দিতেন এবং মুচকি হাসতেন। এতে বুঝা যায়, রাসুল (সা.) বৈঠকে বসে সাহাবায়ে কিরামের আবৃত্তিকৃত অসংখ্য কবিতা শুনতেন এবং তাতে আনন্দও বোধ করতেন। এক হাদিসে আছে আয়েশা (রা.) বলেন, একসময় রাসুল (সা.) জুতা সেলাই করছিলেন। আর আমি বসে বসে গজল আবৃত্তি করছিলাম। অতঃপর আমি রাসুল (সা.) এর দিকে তাকালাম। দেখলাম রাসুল (সা.) এর কপাল ঘামছে এবং ঘামের বিন্দু থেকে নুর সৃষ্টি হচ্ছে। তখন আমি অকস্মাৎ গজল আবৃত্তি থেকে থেমে গেলাম। রাসুল (সা.) আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হল, থামলে কেন? আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আপনার দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেলাম, আপনার কপাল ঘামছে আর আপনার সে ঘাম থেকে নুর সৃষ্টি হচ্ছে। আবু কাবির আল-হুজালী যদি আপনাকে দেখত তবে অবশ্যই সে বুঝত, আপনিই তার কবিতার বেশি উপযোগী। রাসুল (সা.) বললেন, আয়েশা! আবু কাবির আল-হুজালী কী বলেছে? আমি বললাম, এই দু’টি শ্লোক: “সে যুবক হায়েজের অবিশিষ্টাংশ থেকে, দুগ্ধদানকারী মহিলার অনিষ্ট ও রোগ থেকে এবং গর্ভবতী মহিলার অসুখ ও ক্ষতি থেকে নিরাপদ। আর তুমি যখন তাঁর সম্ভ্রান্ত মুখমÐলের দিকে তাকাবে তখন দেখতে পাবে তা যেন আকাশে মেঘমালার মধ্যে বিদ্যুতের মতো চমকাচ্ছে।” আয়েশা (রা.) বলেন, অতঃপর রাসুল (সা.) তাঁর হাতের কাজ রেখে দিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং আমার দু’চোখের মাঝখানে চুমু খেয়ে বললেন, আয়েশা! আল্লাহ তোমাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমি তোমার উপর যেরূপ সন্তুষ্টি হয়েছি আমার উপর তোমার সেরূপ সন্তুষ্টির কারণে। (মাজিল্লাতুল বাহস আল-ইলমি তুরাস আল ইসলামি)।

 

লেখক : সম্পাদক, মাসিক ছন্দপাতা