যা পারস্য পেরেছে, যা উত্তর ভারত পেরেছে তা বাংলাকেও পারতে হবে

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ২১ ২০১৯, ২০:০৬

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত:

হিজাজী আরবে যে ইসলামের উত্থান তা অন্যান্য আরব ও আজম প্রদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যে মিথষ্ক্রিয়া করেছে তা একটা ইন্টারেস্টিং বিষয়। বৃহত্তর পারস্য, তুরান-খোরাসান, উত্তর ভারত ও বাংলা — এসব অঞ্চলে এই মিথষ্ক্রিয়া একটি চলমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া।

পারস্য শাহী সাম্রাজ্যিক মহাকাব্যিক ঐতিহ্য কিভাবে এই মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে তা অত্যন্ত আগ্রহ জাগানিয়া একটি প্রপঞ্চ। বিশেষ করে প্রাচীন আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির ধারক ফারসি ভাষা ইসলামের রসে জারিত হয়ে কিভাবে একটি ইসলামিত ফারসি ভাষার সংশ্লেষণ তৈরি হল তা ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নিয়ে যারা আগ্রহী ও অনুসন্ধিৎসু তাদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি বিষয় ও প্রসঙ্গ। এইসব গবেষকদের অনেকে আরব ও পারস্যের এই মেলবন্ধনকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে আরবি হিজাজী ইসলাম সামরিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ফ্রন্টে প্রাচীন সাম্রাজ্যিক পারস্য সভ্যতাকে বিজিত করতে পেরেছিল ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্রনৈতিক ও বিশেষ করে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি অভিযোজিত হয়ে নবরূপে আবির্ভূত হয়ে ইসলামের অঙ্গনে উচ্চশিখরে স্থান লাভ করেছিল। অনেকে মনে করেন এর ভেতর দিয়ে বিজিত ভাষা ও সংস্কৃতি বিজয়ী ধর্ম ও সামরিক শক্তির উপরে একটি পাল্টা বিজয় অর্জন করেছিল। এই সৃজনশীল মিথষ্ক্রিয়ার ফলাফলে ফারসি সাহিত্য ও সংস্কৃতি উর্বর হয়ে উঠেছিল এবং আমরা পেয়েছিলাম মওলানা রুমি, হাফেজ শিরাজী, শেখ সাদী, ওমর খৈয়াম প্রমুখকে।

উত্তর ভারতেও এমনি একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মিথষ্ক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। তুর্কী, আফগান ও বিশেষতঃ মুঘল শাসনের অধীনে উত্তর ভারতে আরবি, ফারসি, তুর্কী ও হিন্দুস্তানী ভাষাগুলোর মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ হল এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। উস্তাদ আমীর খসরু থেকে শুরু করে মীর ত্বকি মীর হয়ে মির্জা গালিব, স্যার সৈয়দ আহমেদ খান, আলতাফ হোসেন হালী, আল্লামা মুহম্মদ ইকবাল, শিবলী নুমানী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ থেকে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ পর্যন্ত এই ধারা নানামুখী স্রোতে প্রবহমান। এক্ষেত্রে সৈয়দ আহমদ সিরহিন্দী মুজাদ্দেদ আল ফেসানী থেকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি হয়ে সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ও শাহ ইসমাইল শহীদের বালাকোট জিহাদ, দেওবন্দ আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন এবং মওলানা আবুল আ’লা মওদূদীর জামায়াতি ইসলামি আন্দোলন পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ ধর্মীয়, সামাজিক, শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বহুমুখী ধারাও বয়ে চলেছে।

বাংলার মুসলিমরাও এইরকম একটি সংস্কারমূলক ও উজ্জীবনী মিথষ্ক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের অভিযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এক্ষেত্রে তাদের কাছে উপরিউক্ত ফারসি সাহিত্য ও সংস্কৃতি যেমন প্রেরণা হিশেবে কাজ করেছে তেমনি উত্তর ভারতের উর্দু সাহিত্য ও সংস্কৃতিও প্রভাব বিস্তার করেছে। পাশাপাশি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বাংলার রাজধানী কলকাতায় উদ্ভূত হিন্দুত্ববাদী বাঙালি ও আধুনিক-সেক্যুলার জাগরণের তরঙ্গ বাঙালি মুসলিম ধর্মীয়, সামাজিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও এমনকি রাজনৈতিক চেতনার পরিগঠনে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম, আলাওল প্রমুখ থেকে শুরু করে মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ, ইসমাইল হোসেন শিরাজী হয়ে কাজী নজরুল ইসলাম হলেন এই ধারার প্রধানতম ধ্রুপদী নিদর্শন।

তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে নানা ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণে বাংলায় পারস্য বা উত্তর ভারতের মত ইসলাম ও বাঙালি সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়ায় এখনো কোনো স্বতন্ত্র ও উৎকৃষ্ট বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি পরিগঠিত হয়ে ওঠেনি। প্রতিবেশী ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বাঙালি ও আধুনিক-সেক্যুলার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অসমানুপাতিক প্রভাব এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছে।

সুতরাং বলা যায় যে পারস্য যা পেরেছে বা উত্তর ভারতও যা পেরেছে তা বাংলাকেও পারতে হবে। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদার জন্য এটি অপরিহার্য ও অতি আবশ্যক একটি বিষয়।