মুসা আল হাফিজ: সমকালের সব্যসাচী আলেম-সাহিত্যিক

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ০৫ ২০২২, ০০:১৮

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

এক.

মুসা আল হাফিজ সমকালীন বাংলাদেশের সাহিত্যে একজন বহুবিষয়ে আগ্রহী, লেখনীতে সদাব্যস্ত, সব্যসাচী ও চৌকস সাহিত্যিক হয়ে উঠেছেন। তিনি শিক্ষাগত পরিচয়ে একজন প্রশিক্ষিত ও পেশাজীবী আলেম। ঐতিহ্যবাদী কওমী মাদরাসা শিক্ষায় তার শিকড় প্রোথিত। প্রথমত তিনি কুরআনের একজন হাফেজ; এরপরে তিনি কুরআনের তাফসির ও হাদিস অধ্যয়নে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বেও তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ আছে। কিন্তু যা তাকে বিশিষ্ট করেছে তা হল যে তিনি ইলমের প্রচলিত পরিসর অতিক্রম করে সাধারণ জ্ঞানচর্চা, ভাবনা, কল্পনা ও লেখালেখিতে নিবিষ্ট হয়েছেন। তিনি ইলমী, আকলী ও খেয়ালী এই সবগুলি পরিসরে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতে পারছেন। যেটা সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। তিনি সমকালীন বাংলাদেশের ধর্মীয় ও সাধারণ জ্ঞানীয় পরিমন্ডলের মধ্যেকার দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান স্বছ কাঁচের দেয়ালটি অনেক সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করে যেতে পেরেছেন। এখানেই রয়েছে তার অনন্য ও বিশিষ্ট কৃতিত্ব।

তিনি একাধারে পদ্য ও গদ্যে পারঙ্গম ও পারদর্শী। বাংলা ভাষায় তার সৃজনশীল ও মননশীল প্রকাশে স্বচ্ছন্দ ও নান্দনিক। এক্ষেত্রে তার ভাষা সাধারণ সাহিত্য ভাষারীতিকে অনুসরণ করে; তিনি খুব বেশি আরবী-ফারসি-উর্দু শব্দ আরোপ করেন না; আবার খুব বেশি তৎসম বা ইংরেজী শব্দাবলীরও আশ্রয় নেন না; আবার অন্যদিকে মধ্য বাংলাদেশ কিংবা তার জন্মজেলা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষাও ব্যবহার করেন না। প্রচলিত প্রমিত বাংলা ভাষাকেই তার আপন সত্তা ও চেতনার রঙে রাঙিয়ে নেন তিনি। অর্থাৎ তার ভাষায় কথ্যরীতির চাইতে লেখ্য আনুষ্ঠানিক রীতিই তিনি অনুসরণ করেন। এককথায় বলা যায় ভাষারীতি নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী না হয়ে প্রচলিত সাহিত্য ভাষাকেই তার সৃজন ও মননের বাহন করে নিয়েছেন তিনি।

মুসা আল হাফিজের মূল শিকড় যেহেতু ইলমী পরিমন্ডলে গাঁথা, তাই ইসলাম অবধারিতভাবে তার উল্লেখসূত্র ও উৎসভূমি। এর প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তার সব রচনা ও অনুবাদ কর্মের মধ্যেই। তা নিখাদ ইলমী বিষয়ের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি তিনি যখন সাধারণ বিষয়ে লেখেন তখনও তা সমভাবেই সত্য। ঐতিহ্যবাদী কওমি মাদরাসার ইলমী উত্তরাধিকার তিনি বহন করেন একথা বললে ভুল বলা হবে না। এই ঐতিহ্যবাদী ইসলাম ভাষ্যটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণেই একধরনের বিরাজনৈতিক চারিত্র ধারণ করেছে বলে আমরা জানি। ফলে মোটা দাগে মুসা আল হাফিজের ইসলাম বয়ানও এই ঐতিহ্যের অনুবর্তী বলা যায়।

তবে তিনি একুশ শতকের অন্যান্য আরো অনেক তরুণ কওমি আলেমদের মতই ক্রমাগত বিরাজনৈতিকতার আবরণ ভেদ করে একধরনের সফট রাজনৈতিকতার চর্চা করছেন। বিশেষ করে কওমি উলামাদের সাংগঠনিক অবস্থানের প্রতি তার অঙ্গীকার ও আনুগত্য দুটোই আছে বলে মনে হয়। এক্ষেত্রে ইক্কামতে দ্বীনপন্থী ও পীর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের সঙ্গে হয়তো ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনো এদের প্রতি অহেতুক সমালোচনা প্রকাশ করেন না।

তার ইসলাম ভাষ্যের চারিত্র সবসময়ই ইলমী ও স্কলার্লি। উচ্চকণ্ঠ ও আবেগী মৌখিক কিংবা লিখিত উপস্থাপনা তিনি পরিহার করে চলেন বলে মনে হয়েছে। তিনি তার লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে ইতিমধ্যে যে বিপুল সংখ্যক তালেবে ইলম এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ও জ্ঞানার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রভাবিত করতে পারছেন তা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। এর দীর্ঘমেয়াদী ভূমিকা ও ছায়াপাত সমাজে গুণগত পরিবর্তন আনতে বড় অবদান রাখবে, ইনশাআল্লাহ।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)