মুসলিম বিশ্বে এরদোয়ান কেন এত জনপ্রিয়?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ১১ ২০১৯, ০১:০০

সৈয়দ শামছুল হুদা:

বিংশ শতাব্দীতে মুসলমানদের ওপর দিয়ে রাজনৈতিক যে ঝড় বয়ে গিয়েছে তা এককথায় অতুলনীয়। এ শতাব্দীতেই দু দু’টি বিশ্বযুদ্ধও হয়েছে। যুদ্ধে যেমন কোটি কোটি মানুষ মারা গিয়েছে, তেমনি বিভিন্ন মুসলিম দেশসমূহে বিশ্বযুদ্ধোত্তর নানা ছুতায় যে সকল গণহত্যা হয়েছে তাতেও মারা গিয়েছে কোটি কোটি বনি আদম। বিশেষ করে এ শতাব্দীতে মুসলমানদের মৃত্যুহার অস্বাভাবিকভাবেই বেশি। মুসলিম জনপদগুলোকে নেতৃত্বশুন্য করার জন্য হেন কোন কৌশল বাকী নাই যা প্রয়োগ করা হয়নি। নানা কৌশলে মুসলমানদেরকে দাবিয়ে রাখার জন্য কোথাও যদি মুসলমানরা একটু মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছে সেখানেই হামলে পড়েছে ইসলামবিদ্বেষী অপশক্তি। আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, চেচনিয়া, হারজেগোভিনা, বসনিয়া, কাশ্মীর, আরাকান, ইয়েমেন প্রভৃতি মুসলিম জনপদগুলো বারবার রক্তাক্ত হয়েছে।
মুসলমানরা যখনই কোথাও একটু আশার আলো দেখতে শুরু করেছে তখনই দুঃসংবাদের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে। বিশেষ করে ১৯২৩ সালে উসমানী খেলাফত বিলুপ্ত করে দেওয়ার পর তুরস্কে পাশ্চাত্যের ইঙ্গিতে রাজনীতির নামে যে নোংরা খেলা খেলানো হয়েছে তার কোন নজির নেই। কামাল আতাতুর্ক ইসলামকে পৃথিবী থেকে একেবারে নির্মূল করে দেওয়ার জন্য হেন কোন কৌশল নেই যা সে প্রয়োগ করেনি। ৬’শ বছরের খেলাফত যেখান থেকে পরিচালিত হয়েছে, যাদের হাতে মুসলমানদের সোনালী সময়গুলোর ইতিহাস রচিত হয়েছে, যাদের হাতে ছিল মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকার শক্তির উৎস, সেই জায়গাটায় কী পরিমান জুলুম-নির্যাতন খোদ মুসলমানদের ওপরই নেমে এসেছে তা ইতিহাস স্বাক্ষী। অতঃপর সেখান থেকে মূল উৎসের দিকে ফিরে যাওয়ার সামান্য চেষ্টা করার জন্য আদনান মেন্ডারেস থেকে শুরু করে নাজমুদ্দিন আরবাকান পর্যন্ত কত নোংরা খেলা শুধুমাত্র তথাকথিত সেক্যুলারিজমের দোহাই দিয়ে তুরস্কের সেনাঅপশক্তি বাস্তবায়িত করেছে তা শুনলে গা শিউরে উঠে। সেই জায়গাটায় সাহস করে এরদোয়ান একটু একটু করে নিজের পায়ের নীচের মাটি শক্ত করছেন। তিনি যে ইসলামের বিশেষ কিছু করে ফেলেছেন, তা কিন্তু নয়। কিন্তু যে পরিবেশে যতটুকু করছেন তার একটা বিশ্লেষণ করা সময়ের দাবী। এ বিশ্লেষণের ওপরই উঠে আসবে এরদোয়ান মুসলিম বিশ্বে কেন এত জনপ্রিয়!
উসমানী খেলাফত বিলুপ্তির পর তুরস্কের রাজনৈতিক পরিবেশ, আর অন্য দশটি মুসলিম দেশের পরিবেশ এক ছিল না। তুরস্কের ওপরে গোটা ইউরোপের ছিল প্রচন্ড ক্ষোভ। কারণ বারবার তুর্কি সুলতানগণ ইউরোপের বুকে হানা দিয়ে তারা সেখানে তাদের চাঁদতারা খচিত লাল পতাকা উড়িয়েছে। সে ক্ষোভের কথা ইউরোপিয়ানরা কখনোই ভুলে যেতে পারে নাই। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সভ্যতার নিদর্শন কন্সটান্টিনোপল হারানোর পর গোটা রোম ও ইউরোপ ক্ষোভে ফুঁসেছিল তুর্কি সুলতানদের ওপর। আর সে জন্যই তারা এমন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, যাতে করে খোদ তুরস্ককেই নাস্তানাবুদ করে দেওয়া যায়। কামাল আতাতুর্ক তুর্কির ভুমি রক্ষা করেছে ইসলামকে বিলূপ্তির শর্তেই। ইউরোপ কামাল আতাতুর্কের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে শত শত বছরের ক্ষোভ ঝেরেছে তুর্কির ওপর। সেই তুরস্কে আবার কেউ ইসলামের পতাকা উড্ডীন করবে, বিষয়টা এত সহজ নয়। আমরা দূর থেকে যতটা সহজ মনে করি, এরদোয়ানরা তুরস্কে বসে ইসলাম কায়েমের নতুন অভিযাত্রাকে ততটা সহজ মনে করেন না। তুরস্কে এরদোয়ানদের জন্য স্তরে স্তরে মৃত্যুফাঁদ তৈরী করে রাখা হয়েছে। তুরস্কে শুধুমাত্র আরবীতে আজানের অনুমতি দেওয়ার অপরাধে তিন বারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্ডারেসকে তুর্কি সেনাবাহিনী ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা নাজমুদ্দিন আরবাকানকে কতভাবে যে হয়রানি করা হয়েছে তার কোন তুলনা নাই। সেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে এরদোয়ান তুরস্ক শাসন করছেন। তিনি যে বাঘের পিঠে আরোহন করে তুর্কি শাসন করছেন তা তুর্কিগন যতটা উপলব্দি করেন, আমরা দূর থেকে ততটা উপলব্দি করছি না বলেই এরদোয়ানকে নিয়ে আমাদের মাঝে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। আমরা এরদোয়ানের শাসনকে আফগানিস্তানের তালেবানদের শাসনামলের সাথে তুলনা করি। তুলনাকরি মোল্লা ওমরের সাথে এরদোয়ানকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে একদল উলামায়ে কেরাম তুরস্ক সফর করেন। সে দলে মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ, বাংলাদেশ জমিয়তুল মুদাররেসীন এর সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা সাব্বির আহমদ মোমতাজি, দারুন নাজাত মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আবু বকর সাহেব প্রমুখ ছিলেন। সে দলে আমিও একজন ক্ষুদ্র সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। ইস্তাম্বুল এবং কোনিয়া দুটি প্রদেশ সফর করার সুযোগ হয়। তুরস্ককে খুব কাছ থেকে দেখার স্বপ্ন্ নিয়েই এদেশ থেকে ১৮সদস্যের আলেমদের একটি কাফেলা তুরস্কে যায়। এরদোয়ানের মাটি ও মানুষকে বুঝা, খুব কাছ থেকে তুরস্ককে অনুভব করা, বিশেষকরে ইস্তাম্বুলে উসমানী খেলাফতের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো দেখা এবং এরদোয়ানের মাটিতে বসে এরদোয়ানকে জানার জন্যই মূলত: ছিল এই সফর।
আমাদের দেশে নানামুখি মত প্রকাশের লোকের অভাব নেই। আর সে কারণে কেউ এরদোয়ানকে একেবারে এ যুগের সুলতান বলে ফেলেন। আবার কেউ কেউ এরদোয়ানকে এ যুগের কাফের মুশরেকদের বড় দালাল মনে করেন। আসলে এরদোয়ান এর কোনটিই নন। তিনি মূলত: সত্যিকারের একজন মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করছেন এবং তুরস্কের মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা তৈরীতে খুব ধীর গতিতে কাজ করছেন, যাতে করে সেক্যুলাররা তাকে গলাটিপে না ধরতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে এরদোয়ান বলেছিলেন, বর্তমান যে প্রজন্মকে আপনারা দেখছেন, সেটা পুর্বের শিক্ষা দর্শনের প্রজন্ম। আমার প্রজন্মকে দেখবেন আমার মৃত্যুর পর। আমি যাদেরকে গড়ে যাচ্ছি, তারা আমার চেয়েও অনেক বেশি প্রেক্টিক্যাল মুসলিম হবে ইনশাআল্লাহ। আমরা এর প্রমাণ তুরস্কের মাটিতে দেখেছি। একদিন আমাদের বাসস্থানের পাশ দিয়ে একটি স্কুলগামী শিশুদের গাড়ী যাচ্ছিল, তারা একদল উলামাদের দেখে যে পরিমাণ সম্মান দেখিয়েছে তা এক কথায় অদ্ভুত। তাদের প্রাণখোলা হাসি, তাদের মোসাফাহা আজো চোখে ভাসে। তুরস্কের নতুন প্রজন্ম ইসলামের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে বড় হচ্ছে।
এরদোয়ান একসাথে বহুমুখি কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন। একদিকে নতুন প্রজন্মকে ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে গড়ে তোলা। বর্তমান প্রজন্মকে ইসলামের প্রতি দরদী বানানো। অপরদিকে সেক্যুলারদের বুঝ দেওয়ার জন্য বস্তুগত উন্নয়নের এমন রূপরেখা তৈরী করা- যাতে ওরা হতভম্ব হয়ে যায়। তুরস্কের সীমিত সামর্থের ভিতর দিয়ে তুরস্ককে এমনভাবে গড়ে তুলছেন, যাতে আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তাদের যেন সেই পুরাতন বিষয় নিয়ে পড়ে থাকতে না হয়, তারা যেন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। সেই জন্যই আন্তর্জাতিক মানের সর্ববৃহৎ বিমানবন্দর যেমন বানাচ্ছেন, সর্বাধুনিক প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ যেমন বানাচ্ছেন, তেমনি তুরস্কের ঐতিহ্যের অংশ, গৌরবের প্রতীক, অতীতে নির্মিত প্রতিটি মসজিদকে নতুন করে জীবন দান করছেন। সাথে সাথে তৈরী করছেন অত্যাধুনিক নতুন মসজিদ। হাজার হাজার ইসলামশিক্ষা কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে তুরস্কে। সেখানে মানুষকে খুব বেশি ধৈর্য, উদারতা, সহনশীলতা, কৌশলের সাথে দ্বীনের অনুশীলন করানো হচ্ছে। কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি কোথাও কেউ দেখাতে পারবে না। তুরস্কে রাষ্ট্রের ভিত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি শক্তিকেই ইসলামের বিরুদ্ধে তৈরী করে গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই ভিতকে ভাঙ্গা কি এতই সহজ?
আমরা দূর থেকে যখন দেখি তুরস্ক সরকার কেন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক রাখে? কেন ন্যাটো থেকে এখনো বের হয়ে আসে না? কেন এখনই প্রকাশ্যে ইসলামের বিধি-বিধানগুলো বাস্তবায়নের হুকুম জারি করে না? কেন এরদোয়ান এখনো দাঁড়ি, পাগড়ি, জুব্বা পরিহিত হয়ে সামনে আসে না? তখন আমরা খুবই অবাক হই। আমি মনে করি, এরদোয়ান যে চমৎকারভাবে অতীতের সরকারগুলোর অনেক অনুসৃত নীতি এখনো যেভাবে ধরে রেখেছেন এবং কৌশলে নতুন প্রজন্মকে নতুনভাবে তৈরী করছেন এরচেয়ে ভালো কোন বিকল্প তুরস্কের জন্য হতে পারে না। তুরস্কের মানুষ পরিশ্রমী, আনুগত্যশীল, ধৈর্যশীল। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের যে ভূমি দান করেছেন, তার মধ্যে তুরস্কের মাটির মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার বিশেষ একটা গুণ আলাদাভাবে দান করেছেন। যার কারণে সুদূর তুরস্ক থেকেও সে মক্কা ও মদীনার খাদেম হতে পেরেছে। দীর্ঘদিন মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছে। ধর্মীয় সহনশীলতা, উদারতার বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান, আদর্শ, নীতি তাদের মধ্যে রয়েছে। তুরস্কে এতটা দমন-নিপীড়নের পরও সেখানে উগ্রপন্থা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেনি। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী রহ. এর মতো প্রখ্যাত দা’য়ীদের বিশেষ কোরবানীর বদৌলতে ইসলামবান্ধব সরকার বারবার ক্ষমতায় আসছে। মাহমুদ এফেন্দি দা.বা. এর মতো বিখ্যাত দায়ী, দ্বীনের আশেকদের সামনে আজ এরদোয়ানরা শাসক হয়েও তাদের পায়ের কাছে নিজেদের সোপর্দ করতে কুণ্ঠিত হয় না।
এরদোয়ান একদিকে নতুন প্রজন্মকে ইসলামের মূলনীতি ও আদর্শের আদলে ধীরে ধীরে গড়ে তুলছেন, অপরদিকে সেক্যুলারদের খুব কৌশলের সাথে মোকাবেলা করছেন। পাশাপাশি তার দৃষ্টিকে শুধু তুরস্কের মাটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছেন না। তিনি তার দৃষ্টিকে গোটা আফ্রিকার দিকে সম্প্রসারিত করেছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্রের কষাঘাতে গোটা আফ্রিকা যখন জর্জরিত, তখন তিনি সেখানে আর্বিভুত হয়েছেন আল্লাহর বিশেষ দান হিসেবে। বর্তমান মুসলিমদের মধ্যে একটি দলের চিন্তা হলো, সবকিছুরই সমাধান হবে অস্ত্রের ভাষায়। এরদোয়ান সে পথটা মাড়াচ্ছেন না। ফলে আফ্রিকায় যে সব অঞ্চলে সশস্ত্র গ্রুপগুলো মুসলমানদের জীবনমানকে অতিষ্ট করে তুলেছিল তিনি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। আফ্রিকার অনেক দেশে দুতাবাস ছিল না। আফ্রিকার প্রতিটি দেশে তিনি দূতাবাস খুলেছেন। সোমালিয়ায় বারবার রক্ত ঝরছিল। সেখানে তিনি সেনা মোতায়েন করে অহেতুক রক্তপাতকে বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আরব রাজ্যগুলো পরশ্রীকাতরতায় যখন কাতারকে একঘরে ফেলার উদ্যোগ নেয়, তখন এরদোয়ান সেখানে বীরদর্পে এসে হাজির হন। তাদের পাশে দাঁড়ান। আরাকানে যখন মুসলমানদের খুন ঝরছিল, তখন এরদোয়ান নিরব থাকেননি, তিনি বিশেষ টিম বাংলাদেশে পাঠান। আরাকানের বিষয়টি আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় নিয়ে আসেন। তিনি সোচ্চার প্রতিবাদ করেন। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা মুসলমানদের স্বচক্ষে দেখার জন্য তার স্ত্রী এমিনে এরদোয়ান বাংলাদেশে ছুটে আসেন। শুধু লোক দেখানো ছুটে আসাই নয়, রোহিঙ্গা মুসলমানদের থাকা-খাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ দানের হাত নিয়ে উপস্থিত হয় তুর্কি প্রশাসন। এভাবেই তিনি ইসরাইলের সাথে পুর্ব থেকে চলে আসা সম্পর্কের জেরে কূটনৈতিক সম্পর্ককে ছিন্ন না করে মাঝে মাঝে তাদের সাথে তুরস্কের স্বার্থে একসাথে বসছেন, আবার ফিলিস্তিনি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার সেই এরদোয়ানই।
এভাবে মুসলিম দেশের শাসকরা যখন জাতিয়তাবাদী চিন্তায় বিভোর, সকলেই নিজ নিজ দেশকেন্দ্রিক চিন্তায় অস্থির, তখন এরদোয়ান নিজ দেশের সঙ্কট মাথায় নিয়েও মুসলিম বিশ্বের সঙ্কট নিয়ে প্রায়শই কথা বলেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে রক্তপাত এড়াতে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ যখন মুসলমানদের রক্ত নিয়ে খেলছিল, তখন তিনিই সবার আগে এগিয়ে আসেন। প্রথমে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে দেশকে রক্তপাত এড়ানোর জন্য নানা কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু সিরিয়া ইরানের ইন্ধনে তার অপকর্ম অব্যাহত রাখে। সুন্নী মুসলমানদের রক্তের বন্যা বয়ে যায় সিরিয়ায়। যুদ্ধ যখন বেধে যায়, তখন তুরস্ক চেষ্টা করে সশস্ত্রভাবে বাশার আল আসাদকে সরিয়ে দিতে। বিজয় যখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে তখন ইরান রাশিয়ার সহযোগিতায় ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয় তুর্কি অনুগত মুজাহিদ বাহিনী। সিরিয়ায় তৈরী হয় আইএস নামক একটি বিশেষ বাহিনীর, যাদের মূল নেতৃত্ব ছিল ইসরাইল ও আমেরিকার প্রতি আনুগত্যশীল। তাদের চমকদার কৌশলের সামনে অনেক সরলপ্রাণ দ্বীনদার প্রকৃত মুজাহিদও তাদের দলে ভীড়ে। ফলে তৈরী হয় বড় ধরণের ধর্মীয় সঙ্কটের। এ অবস্থায় এরদোয়ান খুব দক্ষতার সাথে পুনরায় রাশিয়া ও ইরানের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে। সিরিয়ায় রক্তপাত কমানোর উদ্যোগ নেয়। তার বিশেষ উদ্যোগের কারণেই বর্তমানে সিরিয়ায় অনেকটা শান্তি বিরাজ করছে।
মিশরের নির্বাচিত শাসক ড. মুহাম্মদ মুরসীকে নিয়ে যখন আরব শাসকরা নোংরা খেলা শুরু করে, তখনও তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। নিজ দেশের গন্ডী পেরিয়ে এখানেও তিনি কথা বলেন। এসব কারণে এরদোয়ান সরকার মুসলিম বিশ্বের সাধারণ মানুষের কাছে একজন বীর শাসক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। আর আরব শাসক ও পশ্চিমাদের কাছে চোখের কাঁটা হয়ে উঠেছেন। তিনি মাঝে মাঝে জাতিসংঘের একচোখা নীতির কঠোর সমালোচনা করছেন। মুসলমানদের সংকট সামনে আসলে জাতিসংঘ এক ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়, আবার অমুসলমানদের মধ্যে কোন সঙ্কট তৈরী হলে সেখানে ভিন্ন সিদ্ধান্ত চোখে পড়ে। এসব বিষয় নিয়ে আর কোন শাসক কথা বলার সাহস করে না। এসব কারণেও সাধারণ মুসলমানদের মনে এরদোয়ানের ভালোবাসা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এরদোয়ান শত্রুর সাথেও সম্পর্ক রাখছেন, আবার মিত্রের সাথে ঘনিষ্টতা দিনে দিনে বৃদ্ধিই করছেন। এটা বুঝার মতো ক্ষমতা অনেক মুসলমানদের মধ্যে নেই বলেই এরদোয়ানকে নিয়ে নানা সমীকরণ তৈরী হয়। এরদোয়ানের কোনরূপ প্রশংসা করলেই কেউ কেউ বলতে চেষ্টা করেন, তিনি শরিয়া কটুকু বাস্তবায়ন করেছেন? এরদোয়ানকে নিয়ে যখনই কেউ প্রশংসার আবেগটা একটি বেশি প্রকাশ করে ফেলে, তখনই তাকে নিয়ে মোল্লা ওমরের জায়গা থেকে তাকে বিচার করা হয়। বিবেচনা করা হয়। এটা বলা হয় যে, এরদোয়ানতো কোন মুসলিমই নয়। এতদিন ধরে সে ক্ষমতায়, কই? কোথাওতো সে এখনো কোন প্রকার শরিয়া আইন কায়েম করতে পারলো না! সে আবার কিসের সুলতান? আমরা এটা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি যে, তিনি যে সকল পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা মূলত: মুসলিম স্বার্থেই। কিন্ত তিনি রাষ্ট্রীয় পদ্ধতির কারণে শত্রুর সাথেও মাঝে মাঝে গলাগলি করছেন। আবার মিত্রের কাছেতো তিনি অবিসংবাদিত নেতাই। ফলে সারাবিশ্বেই সাধারণ মুসলমানদের কাছে এরদোয়ান বিশ্বনেতা। ইসলামের নামে সশস্ত্র অভুত্থান চিন্তার লোকদের কাছে তিনি ভিলেন। আর ইসলামের প্রকৃত শত্রুদের কাছে এরদোয়ান এক আপদ। আরব শাসকদের কাছে তিনি এক জঞ্জাল।
সম্পাদক : বাংলাদেশ ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট ( বিআইএম)
০৩.০৭.২০১৯