মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ কী ছিলো?

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ২২ ২০২০, ২৩:৫৭

ড. আহমদ আবদুল কাদের: আজ মিডিয়ার প্রচারণায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে তুলে ধরা হচ্ছে। মনে হয় যেন এমন, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল! এ দাবি কি ইতিহাস সমর্থিত? একটু যাচাই করে দেখা প্রয়োজন।

১০ এপ্রিল, ১৯৭১। সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। স্বাধীনতায় ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে : ‘… এবং যেহেতু… আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের কর্তব্য। সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি…’ (দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২, তৃতীয় খণ্ড, স্বাধীনতার লক্ষ্য)।

ঘোষণাপত্রে তিনটি বিষয়কে স্বাধীনতার লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে ১. সাম্য ২. মানবিক মর্যাদা ও ৩. সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। এই তিনটিই হচ্ছে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য। এগুলো প্রতিষ্ঠার জন্যই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল।

১১ এপ্রিল, ১৯৭১। বাংলাদেশের নবগঠিত প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন বাংলাদেশের জনগণের উদ্দেশে এক বেতার ভাষণ দেন। এ ভাষণে তিনি বলেন : ‘বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতা থেকে মুক্তি। গড়ে উঠুক নতুন গণশক্তিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা, গণ-মানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তি প্রস্তরে লেখা হোক জয় বাংলা, জয় বাংলাদেশ’ (ঐ, পৃ. ৮)। প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভাষণেও সাম্য, ন্যায় বিচার আর শোষণ মুক্তিকে স্বাধীনতার উদ্দেশ্য বলে উল্লেখিত হয়েছে।

১৪ এপ্রিল, ১৯৭১। প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের প্রতি নির্দেশাবলি প্রদান করা হয়। এই নির্দেশনাপত্রের শীর্ষেই লিখা হয় ‘আল্লাহ আকবর’। সে নির্দেশনামায় স্বাধীনতার প্রসঙ্গ ব্যাখ্যা করে বলা হয়, “বাঙালির অপরাধ তারা অবিচারের অবসান চেয়েছে, বাঙালির অপরাধ তারা তাদের মা-বাপ, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততির জন্য অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসার দাবি জানিয়েছে, বাঙালির অপরাধ আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট পৃথিবীতে, আল্লাহর নির্দেশমতো অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে এক সুন্দর ও সুখী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলবার সংকল্প ঘোষণা করেছে। …. আমাদের সহায় করুণাময় সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য। মনে রাখবেন, আপনার এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, সত্যের সংগ্রাম। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার দুশমন বাঙালি মুসলমান নারী-পুরুষ, বালক-বালিকা কাউকে হত্যা করতে, বাড়িঘর লুট করতে, আগুন জ্বালিয়ে দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। মসজিদ-মিনারে আজান প্রদানকারী মুয়াজ্জেন, মসজিদ গৃহে নামাজরত মুসল্লি, দরগাহ-মাজারে আশ্রয়প্রার্থী হানাদারদের গুলি থেকে বাঁচেনি। … এ সংগ্রাম আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে ন্যায়ের সংগ্রামে অটল থাকুন। স্মরণ করুন : আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘অতীতের চাইতে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই সুখকর।’ বিশ্বাস রাখুন ‘আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী’।” (দ্রষ্টব্য, ঐ, পৃ.১৯-২২)

উপরোল্লিখিত নির্দেশাবলি ছিল সাধারণ জনগণের উদ্দেশ্যে। এটি ছিল প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম নির্দেশনামা। এটি শুরু হয়েছে ‘আল্লাহ আকবর’ দিয়ে। শেষ হয়েছে পবিত্র কুরআনের দু’টি আয়াত (সূরা দুহা : আয়াত ৪ এবং সূরা সাফ : আয়াত ১৩)। এতে রয়েছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের কথা, রয়েছে আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যাশা, এতে রয়েছে ‘আল্লাহর নির্দেশমত’ সম্মানের সাথে সুখে-শান্তিতে, অন্যায় অবিচার, শোষণ- নির্যাতনমুক্ত সুন্দর ও সুখী সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার। এ নির্দেশনামা বিশ্লেষণ করলে ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বরং ধর্মের প্রতি, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বাসের বিষয়টিই স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও চেতনা বলে স্বীকৃত হয়। মনে রাখা দরকার, এ নির্দেশনাটি সরকারি কোনো গোপন দলিল ছিল না। এটি পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত কোনো কূটনৈতিক সার্কুলার বা বিজ্ঞপ্তি ছিল না। এটি ছিল দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে; জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে উপযুক্ত নির্দেশনা দেয়ার উদ্দেশ্যে। এ নির্দেশনাটি তৈরি করা হয়েছে দেশের সাধারণ জনগণের মনোভাব ও ধ্যান-ধারণাকে সামনে রেখে। এতে ফুটে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের গণমুখী, গণগ্রাহ্য ও গণসম্পৃক্ত চেতনা ও আদর্শ। এ চেতনা ও আদর্শিক অনুভূতি নিয়েই জনগণ মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিল। আল্লাহ আকবর, আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলা, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যাশা ও কুরআনের বাণী এগুলোই ছিল সেদিনকার মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মর্মকথা, স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শিক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ও ভাবাদর্শ। জনগণকে একথাই বলা হয়েছিল এবং সাধারণ জনগণ এ কথার ভিত্তিতেই মুক্তিযুদ্ধ করেছিল।

প্রশ্ন উঠতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বা শুরুতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা না থাকলেও আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কিভাবে সংযোজিত হলো? মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও প্রবাসী সরকার গঠনের পর বাস্তব কারণেই ভারতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ জন্য ২৪ এপ্রিল, ১৯৭১ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য চিঠি দেয়া হয় (দ্রষ্টব্য,ঐ,পৃ.৭৬৯)। ঐ চিঠিতে স্বাধীনতা ঘোষণা,সরকার গঠন ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও কোনো রাষ্ট্রীয় মূলনীতির কথা ছিল না। ভারত সরকার এ আবেদনে সাড়া দেয়নি। ভারত সরকার যখন স্বীকৃতির ব্যাপারটি নিয়ে বিলম্ব ও গড়িমসি করছিল, তখন ১৫ অক্টোবর ’৭১ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আবারো স্বীকৃতির আবেদন জানিয়ে ভারত সরকারের কাছে চিঠি দেয়া হয় এবং সে চিঠিতে বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনী কর্তৃক বিশেষভাবে সংখ্যালঘু তথা হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর জুলুম নির্যাতনের বিষয়টি যুক্তি হিসেবে গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয় (দ্রষ্টব্য : ঐ, পৃ.৮৬৯)। দুর্ভাগ্যবশত ভারত সরকার দ্বিতীয় চিঠির প্রতিও কোনো সাড়া দেয়নি। এতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত বিচলিত ও হতাশ হয়ে পড়ে। তখন বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতির নাজুকতা ও ভারতের প্রকৃত মনোভাব আঁচ করতে পেরে ২৩ নভেম্বর ’৭১ প্রথম বারের মতো রাষ্ট্রীয় মূলনীতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে ভারত সরকারের স্বীকৃতি লাভের জন্য বিশেষ আবেদন জানায়। সেই আবেদনপত্রে ভারতের উদ্দেশে বলা হয় :

‘You have shown unflinching support to the principles of democracy, secularism, socialism and a non-aligned foreign policy … we like to reiterate here that what we have already proclaimed as the basic principles of our state policy, i.e. democracy, socialism and secularism and the establishment of an egalitarian society… . Against this background of this community of ideals and principles we are unable to understand why the Government of India have not yet responded to our plea for recognition, (দ্রষ্টব্যঃ ঐ, পৃ.৮৭২)

অর্থাৎ আপনারা (ভারত সরকার) গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জোট নিরপেক্ষ বিদেশনীতির প্রতি অবিচল সমর্থন প্রদর্শন করেছেন। … আমরা এখানে এ কথা পুনঃব্যক্ত করতে চাই যে, আমরা ইতোমধ্যেই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্যভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকে আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেছি। আদর্শ ও মূলনীতির এ পটভূমিতে আমরা বুঝতে অক্ষম যে, স্বীকৃতিদানের নিমিত্তে আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধের প্রতি ভারত সরকার এখনো কেন সাড়া দিচ্ছে না?’

বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া বা মধ্যবর্তী স্তরের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না। ভারত সরকারের চাপে এবং এ দেশের কোনো কোনো মহলের কারসাজিতে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। দেশের জনগণ বা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পররাষ্ট্র দফতরের বা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কোনো কোনো তারিখবিহীন কাগজপত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু সেগুলো কূটনৈতিক কিংবা বিশেষ কোনো অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীর মতামতের প্রতিফলন, দেশবাসীর নয়। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা জনগণের সামনে উপস্থাপিত বিষয়ের পরিপন্থী কোনো গোপন বা গোষ্ঠী কার্যক্রম অথবা কূটনৈতিক প্রয়োজনে পেশ করা কোনো বক্তব্য প্রকৃতপক্ষে কোনো মূল্য বহন করে না। অতএব, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল না, তা মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক কোনো ফসলও নয়, এতে জনগণের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেনি। কাজেই মুক্তিযুদ্ধের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সম্পৃক্ত করা নিছক বাইরে থেকে আরোপিত বিষয়। জনগণের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। বস্তুত গোটা মুক্তিযুদ্ধই সঙ্ঘটিত হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনা ও আধিপত্যের হাত থেকে রাজনৈতিক ও অথনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। ব্রিটিশ ভারতে এ দেশের মানুষ অনেক প্রত্যাশা নিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাবের সমর্থনে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোট প্রদান করেছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান অর্জিত হয়। প্রথমে এ দেশবাসী চেয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর ভেতরেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের সার্বিক সমস্যার সমাধান। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই কাঠামোর ভেতরে যাবতীয় বিশ্বাসঘাতকতা, জুলুম-নির্যাতন-শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি লাভের প্রয়াস চলেছে। কিন্তু দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় যখন দেখা গেল, তা সম্ভব নয় তখনই স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। তদুপরি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবির জবাবে এবং আলোচনাকালে বিশ^াসঘাতকতা করে একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, তখনই ঘোষিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই। এ ছিল বাঁচার সংগ্রাম, অস্তিত্বের লড়াই। এটা ছিল বৈষম্য, শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির লড়াই। এ ছিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকÑসাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রাম। এ ছিল ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের যথার্থ ও আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়নের প্রয়াস। এ ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের আত্মপ্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। কাজেই এ যুদ্ধের পটভূমি, এ যুদ্ধের প্রকৃতি ও লক্ষ্যই বলে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা হচ্ছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তি, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের অবসান, মানুষের মর্যাদা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করা, সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েম এবং জনগণের সমর্থিত সরকার তথা গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এ জন্যই জনগণ যুদ্ধ করেছিল; অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। বস্তুত ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গের মাধ্যমে গঠিত ঢাকাকেন্দ্রিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলার চূড়ান্ত পরিণতিই আজকের বাংলাদেশ। ৬৬ বছরের ধারাবাহিক সংগ্রাম ও পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমেই ’৭১-এ তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। কাজেই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ কথা বলে এদেশবাসীকে ইসলাম ও মুসলিম পরিচয় থেকে, ইসলামি ভাবধারা থেকে দূরে সরানোর প্রয়াস একটি আধিপত্যবাদী যড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়।

১৯৭২ সালে জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় এসে প্রথম যে ভাষণ দেন তাতে বাংলাদেশকে ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র’ বলে ঘোষণা করেন। ভারতীয় চাপে এবং এ দেশীয় কিছু লবির কারণে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করা হলেও প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধুর সরকার জনগণের মনোভাব ও সেন্টিমেন্ট বুঝতে পেরে জনগণকে শান্ত করা এবং সংবিধানের ঐ ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ প্রশ্নে জনগণের বিরূপ মনোভাব প্রশমিত করার লক্ষ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় বরং ধর্মীয় সহনশীলতা’ বলে ব্যাখ্যা দিয়েছে বারবার। যদিও তখনকার অনেক বুদ্ধিজীবী যেমন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা, অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ প্রমুখ এ জাতীয় ব্যাখ্যার কঠোর বিরোধিতা করেন এবং এ ধরনের ব্যাখ্যাকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ বলে আখ্যায়িত করেন (দ্রষ্টব্য : ধর্মনিরপেক্ষতা, আলী আনোয়ার (সম্পাদক), বাংলা একাডেমি, ১৯৭৩)। সেকুলারিজমের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশ বেতারে যখন কুরআন তেলাওয়াত বন্ধ করার জন্য মস্কোপন্থী কিছু লোক চাপ সৃষ্টি করেন, তখন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে কুরআন তেলাওয়াত চালু রাখা সম্ভব হয়। ইসলামবিরোধী কট্টর লবির বিরোধিতা ও চাপ সত্ত্বেও তিনি রাষ্ট্রীয় আনুকল্যে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখেন। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু লাহোরে ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন, মুসলিম বিশে^র সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গভবনসহ বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন। তার সরকারের মন্ত্রিরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে থাকেন। বস্তুত এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে এ কথা জনগণকে বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে তারা ধর্মের পক্ষেই আছেন, তারা ধর্মহীন নন। এমনকি ’৯২ তে এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং ‘বঙ্গবন্ধু আমলের পদক্ষেপসমূহ ইসলামের ভিত্তিতেই ছিল’- বলে দাবি করেছেন। ’৯২-এর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে এক বাণীতে শেখ হাসিনা বলেন : ‘ইসলামের সত্য, ন্যায়, কল্যাণ ও সাম্যের বাণী সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু শোষণহীন সমাজ কায়েমের পদক্ষেপ নেন’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ এপ্রিল, ১৯৯২)। ’৭৫ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, বঙ্গবন্ধুর সময়ে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ, পরে প্রেসিডেন্ট, জিয়াউর রহমান বীর উত্তম সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নীতির পরিবর্তে ‘আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ প্রতিস্থাপন করে মূলত ১৪ এপ্রিল ’৭১ এর সরকারি নির্দেশাবলিরই প্রতিফলন ঘটান এবং তার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে সমুন্নত করেন।

বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও আদর্শ হচ্ছে জুলুম শোষণ থেকে মুক্তি, মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা; গণতন্ত্র, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েম করা। এর সঙ্গে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং তার সাহায্য কামনা ও প্রত্যাশাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনা। এগুলোই মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী। আমাদের সবাইকে এই আদর্শ ও চেতনাকে আঁকড়ে ধরতে হবে। সেগুলোকে বাস্তবায়িত ও সমুন্নত করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই ইতিহাসের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করা হবে।