ফকিন্নির পোলার কোটিপতি ভাব আর অন্যায় কাজে আনুগত্য করা মুসুল্লি

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ০৬ ২০২১, ১৩:৫৮

আব্দুল্লাহ মায়মূন


গত পর্বের পর থেকে….

গুম হওয়ার পর আমি টেনশন করি নুসরাতকে নিয়ে আর ড্রাইভার আব্দুর রহীম টেনশন করে তার গাড়ি নিয়ে। গাড়ি নিয়ে তাঁর টেনশনের কারণ হলো, সে একটি গাড়ি ভাড়ায় চালাত। কোনো এক কারণে ওই গাড়ি মেরামত করার প্রয়োজন পড়ে। তখন সে গাড়ি নিয়ে ওয়ার্কশপে যায়। ওয়ার্কশপের মালিক গাড়ি রেখে যেতে বলে। এর বদলে তার জন্যে ওয়ার্কশপের মালিক তাকে নিজের Lx মডেলের গাড়ি দেয়। ওই গাড়ি দিয়ে সে আমাদেরকে ট্রিপে নিয়ে যায়। এর‌ইমধ্যে ঘটে এই দুর্ঘটনা।

প্রথমে প্রথমে যখন আব্দুর রহীম তার গাড়ীর ব্যাপারে কিডন্যাপারদের জিজ্ঞেস করতো, তখন তারা বড় অবজ্ঞার সুরে বলতো তোমার গাড়ি কত টাকা মূল্যের? এত কম দামী গাড়ির জন্যে এত টেনশন? আমরা একটি গাড়ি দিয়ে দিবো!

তারা এমনভাবে বলতো, যেনো তারা কোটিপতির ছেলে। তাদের জন্যে এরকম গাড়ি দেওয়া কোনো ব্যাপারই না। তাদের কাছে এ ধরনের একটি গাড়ী কিনে দেওয়ার ক্ষেত্রে টাকা খরচ করা এবং রাস্তার ময়লা পরিষ্কারের পিছনে খরচ করা সমান। অথচ এরা আমার কাছে পাওয়া পাঁচ হাজার টাকা এবং দরিদ্র আব্দুর রহীমের কাছে পাওয়া তিন হাজার টাকার সব টাকা নিয়ে নেয়। এক টাকাও ফেরত দেয় নি। যাদের আচরণ ফকিন্নির পোলার মতো, তারা আবার কোটিপতির পোলার ভাব দেখায়। হায়রে মিথ্যাবাদী জালিম!

তারা যখন বার বার এরকম বলতো, তখন জবাবে আব্দুর রহীম বলতো, সে নিজে দরিদ্র। তার পুরো বাড়ী বিক্রি করলেও এ গাড়ীর মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না। কিন্তু এ সব পাথুরে অন্তরের পাষাণদের দিলে আব্দুর রহীমের এ আর্তনাদ সামান্য পরিমাণ আচড় কাটতো না। বরং তারা এর জবাবে উপহাসের হাসি হাসতো। একপর্যায়ে আমি বলি, আপনাদের নিকট হয়তো এই টাকা কিছুই নয়। কিন্তু বেচারা গরীব আব্দুর রহীমের নিকট এই টাকা অনেক কিছু। এক সময় তারা বলে, তারা নাকি ক্ষতিপূরণসহ গাড়িটা নিরাপদে আব্দুর রহীমের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।

 

গাড়ির ব্যাপারে পরে জানা যায়, ভাঙচুরের পরে গাড়িটি স্থানীয় থানা নবীগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গাড়িটির মালিক ওই ওয়ার্কশপওয়ালা গাড়ি উদ্ধারের জন্যে থানায় যায়। সে গাড়ির মালিকানার ব্যাপারে কাগজপত্র দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে গাড়ি ছুটিয়ে আনে। এরপর সে আব্দুর রহীমের গ্রাম তথা আমাদের নানাবাড়ীর গ্রামে গিয়ে বলে, ভাঙচুরের কারণে গাড়িটির অনেক ক্ষতি হয়েছে এবং থানা থেকে গাড়ি ছুটাতে তার টাকাও ব্যয় হয়েছে। এগুলো যেন গ্রামবাসী বিবেচনায় নেয়। তখন গ্রামবাসীরা ক্ষতিপূরণ বাবদ ত্রিশ হাজার টাকা তার হাতে তুলে দেয়। এই হলো কোটিপতির সন্তানের ভাব নেওয়া ফকিন্নির পোলাদের কথা আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য।

আব্দুর রহীমের টেনশনের দ্বিতীয় কারণ ছিলো, তার আট মাস বয়েসী মেয়ে। অভাব-অনটনে বড় হওয়া আব্দুর রহীম পড়ালেখা তেমন করে নি। কৈশোরেই তার বাবা মারা যান। শৈশব থেকেই উপার্জনে লেগে যায়। পেটের তাড়নায় সে বিভিন্ন জায়গায় আবাসিকভাবে থেকেও কাজ করেছে। প্রথমে সে ওয়ার্কশপের কাজ করতো। পরে ঘরে রঙ দেওয়া এবং রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। কাজের জন্যে সে নিজ জেলা মৌলভীবাজার ছাড়াও চিটাগাং, ঢাকা এবং সিলেটেও থাকে। এক সময় সে এসব ছেড়ে গাড়ীর ড্রাইভারি ধরে। প্রথমে সে সিএনজি চালাতো। কিছুদিন হলো প্রাইভেট কার চালানো শুরু করলো। এই গাড়ি চালানোর সময়েই তার মধ্যে দ্বীনের অনুভূতি জাগ্রত হয়। সে চলে যায় তাবলীগের চিল্লায়। ধারাবাহিক তিন চিল্লা দিয়ে সে নামাযি, দাড়িওয়ালা এবং সুন্নতি লেবাসধারী ব্যক্তিতে পরিণত হয়। এলাকার তাবলীগ জামাতের সাথে, আলেম-উলামার সাথে তার গভীর সম্পর্ক। আমানতদারি, সরলতা এবং দ্বীনদারির কারণে সবাই তাকে পছন্দ করে। তাবলীগ থেকে ফেরার পর আলেম-উলামা ও দ্বীনী মহলের পরামর্শে সে তার বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করে নেয়। অবশ্য বিয়ে করার আরেকটি কারণ তার শারীরিক অসুস্থতা। তার স্ত্রী অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত মাদরাসায় পড়ুয়া, স্ত্রীও দ্বীনদার। তার বাড়ীতে কয়েকজন আলেম থাকলেও তার পরিবারে অশিক্ষা এবং দারিদ্রতার জন্যে দ্বীনদারি তুলনামূলক কম। শরয়ী পর্দা রক্ষা করাসহ বিভিন্ন কারণে সে তার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। কারণ তার পরিবারে আছে যুবক ভায়েরা যাদের সাথে পর্দা রক্ষা করা কঠিন। তার ঘরে বাথরুম থাকলেও পানির মটর নেই। তার বউয়ের যাতে কষ্ট না হয়, পর্দা লঙ্ঘন না হয় এ জন্যে প্রতিদিন কাজে বের হওয়ার পূর্বে ঘরের প্রয়োজনে বাড়ীর পুকুর থেকে বালতি ভরে পানি দিয়ে যায়। তারপর সে গাড়ি ড্রাইভ করতে বের হয়। প্রতি মাসে সে উপার্জনের একটি অংশ তার মাকে দেয়। তার সাথে কথা বলে বুঝলাম, তারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অফুরন্ত ভালোবাসা বিদ্যমান। এই ভালোবাসার স্মারক স্বরূপ তাদের ঘরে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। একজন আলেমের পরামর্শে তার মেয়ের নাম রাখে মাহমূদা আক্তার রুহী। মেয়েটি দিনে দিনে বড় হতে থাকে, শোয়া থেকে বসা শুরু করে সবেমাত্র হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে। এই বয়সে বাচ্চাদের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা থাকে অপরিসীম। ঠিক এই মুহূর্তে আব্দুর রহীমের জীবনে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা। সে কিডন্যাপ হয়ে যায়।

ঘটনার পর তার বাড়ীর লোকেরা অনেক দৌড়াদৌড়ি করেন। অনেক পেরেশানি ও অস্থিরতায় তাদের দিন যায়। কখনো পুলিশের কাছে, কখনো র‍্যাবের অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন। নানা জনের নানান মন্তব্য শুনতে থাকে, আবার এগুলো কানেও নিতে থাকে। পুলিশের প্ররোচনায় খুব দ্রুত প্রভাবিত হয়ে আমাদের সাথে প্রথমে ভুল বুঝাবুঝি, একপর্যায়ে দূরত্বও তৈরী হয়ে যায়। আমাদের পরিবার বলতে আমার তো সবাই ইংল্যান্ড থাকে। দেশে যারা আছেন তারাও তার বাড়ী থেকে অনেক দূরে। শুধু তাদের গ্রামে আছেন মামারা। এখন তারা ক্ষোভ ঝাড়ার কোনো জায়গা না পেয়ে মাঝেমধ্যে আমার ওই বিধবা মামীর ঘরের সামনে গিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতো, যিনি নুসরাতকে মেয়ে বানিয়েছেন। যার বাড়ীতে ঘটনার রাতে আমাদের যাওয়ার কথা ছিলো। তার অপরাধ হচ্ছে তার ছেলে হা. মাও. সাফওয়ান হাবীব ট্রিপের জন্যে আব্দুর রহীমকে নির্বাচন করে।

আব্দুর রহীমের কিছু আত্মীয়-স্বজন ইংল্যান্ড থাকেন। তারা দেশে অবস্থিত তাদের আত্মীয়-স্বজনকে তার খোঁজ নিতে বিভিন্নভাবে তাগিদ দেন। দেরী হওয়াকে তারা অবহেলা মনে করে প্রয়োজনীয় ধমক দিতে থাকেন। দেশের আত্মীয়-স্বজন প্রবাসীদের ধমক নিরবে হজম করতে বাধ্য। কেননা বিভিন্ন উপলক্ষে এরা মুক্ত হস্তে দরাজ দিলে তাদের পাশে দাঁড়ান। তাদের এই ইহসান কি ভোলা যায়? আর মানুষ তো ইহসানের দাস। দেশের বিভিন্ন সংবাদও প্রবাসীরা জেনে ফেলেন। এখন আব্দুর রহীমের ভাইয়েরা চিন্তা করে তারা দেশের খবর জানেন কীভাবে? নিশ্চয় আব্দুর রহীমের বউ এগুলো পাচার করে! সন্দেহের তীর আব্দুর রহীমের অবলা বউয়ের প্রতি যায়। এদিকে আব্দুর রহীম পূর্বে থেকেই আলাদা ছিলো। এখন তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী এবং সন্তান তাদের জন্যে বোঝা হয়ে যায়। তাই তারা সূচালো কথাবার্তা দ্বারা তার স্ত্রীকে আঘাত করতে থাকে। তারা ‘এত মানুষকে খাওয়াতে পারবে না’ ইত্যাদি কথাবার্তা বলা শুরু করে। এদিকে স্বামী হারিয়ে তার স্ত্রী অসহায় হয়ে যায়। অপরদিকে তাদের সূচালো কথাবার্তা তার অন্তর এফোড়-অফোড় করে দেয়। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে তার মা-বাবাকে ফোন দেয়। আব্দুর রহীম গুম হওয়ার প্রায় দু’মাসের মাথায় সে বাবা-মায়ের সাথে প্রিয়তমের বাড়ীর দিকে তাকিয়ে অশ্রু ফেলে চলে যায় বাপের বাড়ী সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর থানাধীন কাতিয়া এলাকায়। এমনিতেই তার বাবার আর্থিক অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়। এরমধ্যে মেয়ে-নাতনী গিয়ে আরো কষ্টে ফেলে দেয়।

এদিকে তার স্ত্রীর যে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে এর কিছুই আমরা জানতে পারি নি। জানার মাধ্যম ছিলো তার ভাইয়েরা, কিন্তু তাদের আচরণে আমাদের সাথে তাদের সম্পর্ক অনেক তিক্ত হয়ে যায়। তাছাড়া এত অন্দরমহলের খবর কে রাখে?

অসহায় এই বেচারী স্বামী হারিয়ে একমাত্র সন্তান কোলে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়, সে জানে না তার ভবিষ্যৎ কী? নুসরাতের শুধু স্বামী হারানো ছাড়া থাকা-খাওয়া, আদর-যত্নে তেমন কষ্ট হয় নি। কিন্তু এ বেচারীর স্বামী হারানো ছাড়া আছে অনেক কষ্ট, থাকা খাওয়ার সমস্যা। এদিকে প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় প্রচুর কান্নাকাটিতে সে অসুস্থ হয়ে যায়। কাশি, জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়। বুকের বামপাশে ব্যথা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত সে ব্যথা বিদ্যমান। শিশুকন্যাও অসুস্থ হয়ে যায়। চিকিৎসার জন্যে নেই স্বামীর রেখে যাওয়া ক্যাশ টাকা। তাই অভাবী বাপ-ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজের এবং শিশুর চিকিৎসা করায়। স্বামীর বাড়ী থাকাকালে কিছু হলেও স্বামীর খোঁজ পেতো। কিন্তু এখন বাপের বাড়ী আসায় স্বামীর সে সংবাদটুকুও পায় না। স্বামীর বাড়ী থেকে কেউ তাকে ফোনও দেয় না। মাঝেমধ্যে ফোন দিলে পোড়ামুখীর কথা শুনে রেখে দেয়। দ্বিতীয় বার ফোন দিতে মন চায় না। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কষ্টে ছিলো এই বেচারী। আমরা গুম থাকলেও থাকা-খাওয়ার তেমন কষ্ট হত না। কিন্তু বেচারীর থাকা-খাওয়া-চিকিৎসায় সব দিক দিয়ে কষ্ট শুরু হয়। তাদের স্বপ্নের সংসারটি গড়ার পূর্বেই অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেলো। অফুরন্ত ভালোবাসায় গড়ে তোলা তাদের জান্নাতটুকু আকাশের চাঁদের মতোই হয়ে গেলো। ছোঁয়া যায় না, ধরা যায় না। শুধু কল্পনার চোখ দিয়ে দেখা যায়। ভালোবাসার স্মৃতিগুলো পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করে উঠে। কতবার যে সে স্বামীর জন্যে কান্না করেছে, তা একমাত্র সে জানে আর জানেন অন্তর্যামী, যার কাছ থেকে কোনো কিছু লুকানো সম্ভব নয়।

 

এদিকে আব্দুর রহীমের বাবা নেই। বাপের উত্তরাধিকার সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারাও হয় নি। সে মরে গেছে ভেবে তাকে বাদ দিয়েই তার ভায়েরা এই সম্পত্তি বন্টনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে! এই ছিলো তার পরিবারের অবস্থা! আহ! কী নির্মম!

একদিন তার স্ত্রী নবীগঞ্জের এক পীর সাহেবের বাড়ীতে যায়। এই নবীগঞ্জের আউশকান্দিতেই আমরা অপহরণের শিকার হই। নবীগঞ্জে আমাদের নানীর বাপের বাড়ী। সে হিসেবে সেখানে আমাদের নানীর দিক থেকে অনেক আত্মীয় আছেন। তো বাসে করে আসার সময় এক মহিলা তার পাশে বসেন। ওই মহিলার সাথে তার আলাপ শুরু হয়। মহিলা বলেন, আউশকান্দিতে আমার এক ভাগিনা অপহরণের শিকার হয়! এ কথা শুনে আব্দুর রহীমের স্ত্রী সচকিত হয়। সে সাথে সাথে জিজ্ঞেস করে, মায়মুন ভাই কি আপনার ভাগিনা হন? তিনি বলেন, হ্যাঁ। মহিলার নাম হচ্ছে রশীদা। তিনি লতায় লতায় আমাদের খালা হন। আমার জন্মের পর তিনি আমাদের বাড়ীতে দীর্ঘ দিন থাকেন। এজন্যে আমার প্রতি তার স্নেহও আলাদা। তিনি যেহেতু আমার খালা, তাই আমি তার ভাগিনা। তখন আব্দুর রহীমের স্ত্রী বলে, এখান থেকে তো আমার স্বামীও অপহরণ হন। ব্যস, এতে করে দু’জনের মধ্যে পরিচয় হয়ে যায়। তখন বেচারী আমার খালার কাছ থেকে আমার বিধবা ছোট মামীর ফোন নম্বর নিয়ে আসে। এরপর সে মামীকে ফোন দেয়। আব্দুর রহীমের ব্যাপারে ও আমার ব্যাপারে খোঁজ নিতে থাকে। তার হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক অবস্থা মামীর কাছে বর্ণনা করে। বেচারীর মনে এইটুকু প্রশান্তি যে, স্বামীর খবর নেওয়ার একটি মাধ্যম পেলো। মামী নুসরাতকে মেয়ে বানিয়েছেন, এ জন্যে নুসরাতের সাথে যোগাযোগ আছে। আর মামলার জন্যে তার ছেলে আমার মামাত ভাই আদনান দৌড়াদৌড়ি করছে, এজন্যে আমাদের পূর্ণ খবর‌ও তার জানা আছে। তো মামীর কাছ থেকে আমাদের আব্বা-আম্মার কাছে আব্দুর রহীমের স্ত্রীর দুরাবস্থার সংবাদ পৌঁছে। তখন আব্বা প্রতি মাসে তাকে প্রথমে দুই হাজার পরে তিন হাজার টাকা করে দিতেন। এ টাকা দিয়ে তার ব্যক্তিগত খরচ, মেয়ের চিকিৎসা-ঔষধের খরচ চলতো। তখন থেকে আর তার বাপ-ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নেওয়া লাগতো না। কিছুদিন পর যখন আমি আর আব্দুর রহীম প্রকাশিত হই, আমাদেরকে জেলে চালান দেওয়া হয়। তখন আব্বা আমার আর আব্দুর রহীমের জন্যে সমান সমান করে প্রতি মাসে তিন হাজার করে পিসি(পারসোনাল ক্যাশে) টাকা দিতেন। এভাবে আব্দুর রহীমের পিসির খরচ, তার স্ত্রী-সন্তান ও দু’টি মামলার জামিনের খরচ আমাদের পরিবার বহন করে। এখন পর্যন্ত কোর্টে হাজিরা দেওয়ার খরচ, যাতায়াত ভাড়া আমরা বহন করি। তাছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে তার পাশে দাঁড়াই। গত রমজানে সে তার ঘরে কাজ ধরে, এতেও আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকা দিয়ে শরীক হই।

জেলে ঢুকার আট মাস পরে একবার আমার ও আব্দুর রহীমের জামিন হয়ে যায়৷ তখন আব্দুর রহীমের স্ত্রী খবর পেয়ে স্বামীর বাড়ী যায়, কিন্তু জেলগেটেই আমাদেরকে আরেকটা মামলা দিয়ে আটকে রাখা হয়৷ এজন্যে বের হতে পারি নি। বেচারী তখন স্বামীর বাড়ী থাকা শুরু করে। কিন্তু তাদের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে এক মাসের মাথায় আবার বাপের বাড়ী চলে আসে। এরপর সে বেচারী আব্দুর রহীম জেল থেকে বের হয়ে বাড়ীতে পৌঁছার পর স্বামীর বাড়ী যায়। মধ্যখানে আর যায় নি। অনেকে ভাবতে পারেন এখানে এগুলো আলোচনা করার কী দরকার? আসলে এগুলো আলোচনা না করলেও হত। কিন্তু এজন্যে আলোচনা করলাম যাতে আপনারা বুঝতে পারেন যে, একজন মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন কত আপন পর হয় আর কত পর তখন আপন হয়। এখানে তো আপনি সামান্য পড়লেন। কারাগারে গিয়ে আমি এরচেয়ে নির্মম কাহিনী শুনেছি।

আপনি পড়েছেন, জালিমবাহিনীর এক দাড়িওয়ালা, নামাযি, তাবলীগি লোক একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে অপহরণ করে তাকে তার স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারকে কী কঠিন দুর্ভোগে ফেলে দিয়েছিলো? হেদায়াত না থাকলে আল্লাহ তা’আলা এদেরকে দুনিয়া-আখিরাতে কঠিন শাস্তি দান করুন। আমীন।

প্রসঙ্গের বাইরে আপনাদেরকে আরেকটি মর্মান্তিক কাহিনী বলছি। চলতি বছরের ২৬ মার্চ পরবর্তী ট্রাজেডিতে হেফাজতের মিছিল-হরতালে ২০ জন ভাই শহীদ হন। এরমধ্যে ১৫ জন বি.বাড়িয়া জেলার। আমরা সিলেট, সুনামগঞ্জের বাইরে বি.বাড়িয়ার শহীদ পরিবারের খোঁজ নেওয়া শুরু করি। আমরা আমাদের বিশ্বস্ত মাধ্যমে সেখানে রমজানে দুটি পরিবারের জন্যে ত্রিশ হাজার টাকা পাঠাই। আমাদের এই ত্রিশ হাজার টাকা পেয়ে ওই বিশ্বস্ত মাধ্যম আরো সত্তর হাজার দিয়ে প্রতি পরিবারে পঞ্চাশ হাজার করে টাকা দেন। ওই সময় এক শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী প্রেগন্যান্ট ছিলেন। উনার একটি ছেলে আছে। আমরা তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিই। পরে ডেলিভারির কথা শুনে গত ২ অগাষ্ট তার জন্যে দশ হাজার, এবং আরেক শহীদ পরিবারের জন্যে দশ হাজার করে মোট বিশ হাজার টাকা পাঠাই। পরে আমাদের প্রতিনিধি যখন ওই প্রেগন্যান্ট শহীদ পরিবারে যান তখন তিনি জানতে পারেন যে, প্রেগন্যান্ট মহিলা আছেন বাপের বাড়ীতে। আমাকে তিনি ফোনে জিজ্ঞেস করেন, টাকাটা কি আমি তার শ্বশুর-ভাসুরের হাতে দিয়ে দিবো? তখন আমার আব্দুর রহীমের কথা স্মরণ হয়। আমি সাথে সাথে বলি, না। আপনি তাদেরকে দিবেন না। ওই মহিলার হাতেই দিবেন। পরে তিনি কয়েকদিন পর শহীদের ওই স্ত্রীর কাছে যান, সেখানে গিয়ে শুনতে পান যে, আমরা ছাড়াও হেফাজত নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন মাধ্যমে উনার হাতে আরো এক লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার টাকা দেন। এই টাকাটা উনার ভাসুর নিয়ে নেয়। এগুলো ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে উনার ভাসুর-শ্বশুরের কাছে আরো টাকা আসে। সেগুলোর হিসাব তিনি জানেন না। তিনি ছিলেন শ্বশুর বাড়ী। এরমধ্যে আবার নেই স্বামী। তাই কিছু বলতেও পারেন নি। পরে এক সময় তিনি তার সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়ী চলে যান। কিন্তু ভাসুর তাকে এক টাকাও দেয় নি। ওই সময় আমরা তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেই। এক সময় তার প্রসবের সময় হয়, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তখন তিনি তার ভাসুরকে টাকার জন্যে ফোন দেন। তখন সে জবাব দেয়, ‘আমার বাপের ব্যাটা মারা গেছে। সে হিসেবে টাকা উনিই পাবে, তুমি কে? কয়েকদিন পরে তুমি অন্যের সাথে বিয়ে বসে যাবে?’ ওই কঠিন মুহূর্তেও তার প্রাপ্য টাকাটুকু দেয়নি ওই নিষ্ঠুর ভাসুর। চিকিৎসাধীন ওই পুরো সময় তিনি আমাদের মাধ্যমে পাওয়া টাকা দিয়ে খরচ বহন করেন। এতে তার পয়ত্রিশ হাজার টাকা খরচ হয়। এখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তিনি আর শ্বশুর বাড়ী যাবেন না।

এমনিভাবে আরেক শহীদ ভাইয়ের স্ত্রীর খবর পেলাম। তার আছে দুটি ছেলে ও একটি মেয়ে। তিনি এখনো স্বামীর বাড়ী থাকেন। তার কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে আসে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা। ওই টাকাটা ভাসুর নিয়ে নিয়েছে। সে অবশ্য শহীদের সন্তানদেরকে মাদরাসায় ভর্তি করিয়েছে। যৌথভাবে খাবার খাচ্ছে। কিন্তু শহীদের স্ত্রীকে হাত খরচের জন্যে কোনো টাকা দেয় না। তখন আমাদের মাধ্যমে আবার ওই দশ হাজার টাকা দেই।

শহীদ পরিবারের এই অসহায় অবস্থার জন্যে, মজলুমদের এই দুর্ভোগের জন্যে আপনি কাকে দায়ী করবেন? এদের এ অবস্থার জন্যে একমাত্র ওই জালিমরাই দায়ী, যারা আমাদের ভাইদেরকে শহীদ করেছে। সন্তানদেরকে এতিম করেছে। নারীদেরকে বিধবা করেছে। পর্দানশীন মহিলাকে বিভিন্ন মিডিয়ার সামনে এসে কথা বলতে বাধ্য করেছে। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, এই জালিমদের মধ্যে অনেকেই আছে দাড়ি-টুপিওয়ালা, পাক্কা নামাযী। যারা অন্যায় কাজেও সরকারের আনুগত্য করাকে ফরজ মনে করে পালন করে।

আল্লাহ তা’আলা এই জালিমদেরকে দুনিয়া-আখিরাতে কঠিন শাস্তি প্রদান করুন। আমিন।

চলবে ইনশাআল্লাহ….

মিহনা’র অন্যান্য পর্বের লিঙ্ক নিচে দেয়া হল—