মাদরাসার ছাত্ররা হতাশ কেনো?

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ১৬ ২০২১, ১৬:১৬

মুস্তাফা সোহাইল হেলালী
দীর্ঘ দিন মাদরাসায় পড়ে ফারিগ হওয়ার পর একটি ছাত্র যখন দুনিয়ার বাস্তব জগতে পা রাখে, তখন তার কাছে সবই অন্ধকার মনে হয়৷ পৃথিবীর সর্বোত্তম জ্ঞান শিখার পর গর্ববোধের বদলে নিজের অবস্থান দেখে অনেকে আক্ষেপ করে বসে, যা নিআমতের কুফরি পর্যায়ে চলে যায়৷ হায় হুতাশ তাকে অনেক সময় দ্বীনের বাছ বিচার ভুলিয়ে দেয়, যা ছিলো তার দীর্ঘ দিনের দিক্ষা৷ দিন দিন সমস্যা আরো জটিল হচ্ছে এবং আমরা আমাদের মতো থাকলে এই সমস্যা দিন দিন আরো প্রকট হবে এবং আলেমরা তাদের সন্তানকে আলেম বানাতে অনীহা দেখাবে, যার সুচনা ভবিষ্যৎ নয়, এখনই শুরু হয়ে গেছে৷ খালিস নিরেট দ্বীনের কেন্দ্র কৌমি মাদরাসায় পড়ানোর জন্য অন্যের ছেলে মেয়েকে আহবান করার পরও অনেকে নিজের ছেলে মেয়েকে এখানে পড়াচ্ছেন না৷ কেউ কেউ সামাজিক লজ্জায় পড়াচ্ছেন বলেও তাদের হাবভাব থেকে ফুটে উঠে৷ হ্যাঁ, কেউ কেউ ছেলেকে নিজের মতোই প্রকৃত দ্বীন শিখার জন্য বিশুদ্ধ নিয়তে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কৌমি মাদরাসায়ই পড়াচ্ছেন৷ কিন্তু তার সময় ও বাচ্চার সময়ের ব্যবধানে বাচ্চাটি যখন পৃথিবী অন্ধকার দেখে হতাশায় ভোগবে, এই ভোগান্তি পিতাকে পাবে না৷

প্রশ্ন হলো, তবে কি আমরা কৌমি মাদরাসার পড়ানো বাদ দিবো? আর পড়ালে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা কী?

কৌমি মাদরাসা জ্ঞানের সুতিকাগার৷ এখানে যখন সর্বোত্তম জ্ঞান শিখানো হচ্ছে তখন মাদরাসায় পড়ানো বাদ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না৷ তবে আমরা আমাদের সন্তানদেরকে আলেম বানানোর সাথে সাথে সমস্যা মুক্ত কেমনে করতে পারি?

মূলত সকল সমস্যা আমাদের সৃষ্ট৷ আমরা আমাদের জীবনকে সাহাবাদের আদলে নিয়ে গেলে না দ্বীন শিখতে ব্যাঘাত ঘটবে, না দ্বীন শিখে দুনিয়ার জন্য হতাশায় ভুগতে হবে৷

দেখুন, সাহাবারা দ্বীন ও দ্বীনী জ্ঞান শিখিছেন নিজের আমল সঠিক করার জন্য এবং সঠিক আমলের মাধ্যমে জান্নাত লাভের জন্য৷ দ্বীনী জ্ঞান দিয়ে দুনিয়া কামানো এবং ইলমের উপর নির্ভর করে কর্ম ছাড়া বসে থাকা তাদের নীতি ছিলো না৷ সাহাবারা যেমন পরকালের সুখের জন্য রাসূলের দরবারে এসে ইলম শিখতেন, তেমনি দুনিয়ার জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা বানিজ্য, ক্ষেত খামার, চাকরি, পেশা, শ্রম সহ যাবতীয় কাজ করতেন যা আজকাল আমরা আলেম শ্রেণী ছাড়া সাধারণ সকল মানুষই করে থাকে৷ সাহাবাদের কাছে কোনো পেশা বা শ্রম ঘৃণার ছিলো না বা কোনো পেশাদার ও শ্রমজীবিকে তারা খাটো করে দেখতেন না৷ অন্যের গোলামির উপর নির্ভর করে যার জীবিকা ছিলো এমন সাহাবাও তাকওয়া ঈমানের ভিত্তিতে তাদের উত্তম বন্ধু ছিলেন৷ আমাদের ইলম ও তাকওয়া কি সাহাবাদের চেয়ে বেশি?

সাহাবাদের পরবর্তী, তার পরবর্তী যুগও এমনই দেখবেন৷ আমাদের ঈমাম আবু হানিফা রহ, কত বড় ফকীহ ছিলেন? যুগশ্রেষ্ট এই ইমাম ও ফকীহ কি তার ইলম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন? জি না৷ তিনি ব্যবসা দিয়ে জীবিকা চালাতেন৷

কিন্তু আজ? আমি কুরআন হাদীস পড়ে জ্ঞান শিখে এটির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহকে সর্বোত্তম মনে করছি, যা রাসূলের শিক্ষা ও সাহাবাদের জীবনের বাস্তবতার বিপরীত৷ আলেম হয়ে একটি ছেলে ব্যবসা বা কোনো কর্ম করলে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছি, অথচ সাহাবাদের মধ্যে কতজন এমন পাবেন যারা নিরেট ইলমের সেবায় থেকে কোনো কাজ করেননি? আবার যে ছেলেকে নিয়ে বিদ্রুপ করলাম নিজের বা মাদরাসার আর্থিক প্রয়োজনে তার কাছেই ধর্ণা দিচ্ছি৷

আমাদের নিজস্ব তৈরী সামাজিক এসব জটিলতাই আমাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যতকে হায় হুতাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ আমরা তাদের কর্মসংস্থান তো তৈরি করছি না বা করতে পারছি না, বরং শরীয়ত তাদের যে কর্মসংস্থানগুলো রেখেছিলো আমাদের ছোট মানসিকতা সেগুলোকেই সঙ্কোচিত করে তুলছে৷ কুরআনের খতম হাদীসের খতম ইত্যাদি হারাম ইনকাম জেনেও অনায়াসে এগুলো করেও আমার ইলম মাকবূল, আর যে ছেলেটি আলেম হয়ে নিজ হাতের উত্তম কামাই খাচ্ছে তার ইলম মাকবূল না হওয়ার এই সিদ্ধান্ত আমার আপনার কাছে কোন আরশ থেকে এসেছে?

অতএব তরুণ আলেম ও সদ্য ফারিগ ছাত্রদের প্রতি আমার আবেদন বা নাসিহাহ যাই মনে করো, তোমরা তোমাদের জীবনকে এভাবেই হতাশায় ঠেলো না৷ হতাশা ও আক্ষেপ তোমাকে কুফরির দিকে নিয়ে গেলে আল্লাহ অসুন্তষ্ঠ হবেন৷ জীবিকার জন্য যার সামনে যে সুযোগ আছে তা বৈধ হলে সেটা গ্রহণ করে নাও৷ যাদের দিকে লক্ষ্য করে তুমি মাদরাসায় পড়ানো ছাড়া বৈধ সুযোগ পেয়েও গ্রহণ করছো না, তারা মাসে মাসে এসে তোমার ঘরে ভাত দিয়ে যাবে না৷ তোমার বিবি বাচ্চার খরচ বহন করবে না৷ তোমার বিয়েতে সহযোগিতা করবে না৷ তোমাকে তার মেয়ে অর্পণ করবে না৷ ব্যবসা করে ধনী হতে পারলে তোমার হুজুরই তার মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হবে বলে দেখবে৷ নিজের জীবনের সাথে যুদ্ধ নিজেকেই করতে হবে৷ তাই যেকোনো বৈধ পেশা গ্রহণ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং সমাজের কুসংস্কারমূলক বিশ্বাস কর্ম দিয়ে দূর করো৷