মাকামে ইব্রাহিম: কুদরতে ইলাহীর অনন্য নিদর্শন 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ৩০ ২০২০, ১৯:১৯

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম: কাবা শরীফের পূর্ব দিকের তাওয়াফ ভূমি সংলগ্ন কাঁচে ঘেরা মিনার সদৃশ্য ছোট ঘরটিতে রয়েছে জান্নাতী এক খন্ড বর্ঘাকৃতির পাথর ; যা মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় উপহার এবং প্রাচীনতম নির্দশন। পবিত্র কাবা শরিফ নির্মাণকরার সময় মানবজাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) এর নির্মাণ কাজের প্রয়োজনে হজরত ইসমাইল (আলাইহিস সালাম) এ পাথরটি নির্বাচন করেছিলেন। এর উপর দাঁড়িয়ে হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) কাবাঘর পূর্ণ নির্মাণ করেছিলেন। পাথরের উপর তাঁর কদম মুবারক রাখলেই সেটা নরম হয়ে যেত এবং হযরতের কদম মুবারক পাথরের ভিতর চার আঙ্গুল পরিমাণ দেবে যেত. যাতে নির্মাণ কাজ আঞ্জাম দানের সময় পা পিছলে না যায়। এমনকি এটা ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) আপন ইচ্ছানুযায়ী উপরে- নিচে, ডানে- বামে নিয়ে গিয়ে নিজ প্রয়োজন অনুসারে কাজ করেছিলেন অবলীলায়। কাবা ঘর নির্মাণ শেষে ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) পাথরটি এ জায়গায় স্থাপন করেন। কালামুল্লাহ শরীফে এ পূণ্য পাথরের মহিমা ঘোষণায় ইরশাদ হয়েছে – “ওয়াত্তাখিযু মিম মাক্বামে ইব্রাহিমা মুসোল্লা।” অর্থাৎ তোমরা ইব্রাহিমের দাঁড়ানোর স্থানটিকে নামাজের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো। (সুরা বাকারা :১২৫) অত্র আয়াতে এটিকে মাক্বামে ইব্রাহিম বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং নামাজের স্থান রূপে গ্রহণ করার জন্য আদেশ করা হয়েছে। তাই পবিত্র কাবা গৃহের তাওয়াফ শেষে মাক্বামে ইব্রাহিমকে সামনে নিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। ভিড়ের জন্য যদি নিকটে দাঁড়ানো সম্ভব না হয় তাহলে আশে পাশে বা দূরবর্তী কোন স্থানে সেই বরাবর দাঁড়িয়ে পড়া যাবে।

এ প্রসঙ্গে হজরত আমর বিন আস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি- ‘নিশ্চয়ই হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিম বেহেশতের দুটি ইয়াকুত পাথর। আল্লাহ এই দুটি পাথরে নূর মিশিয়ে দিয়েছেন। এগুলোর আলোতে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সমস্ত ভূখণ্ড আলোকোজ্জ্বল হয়ে যেত।’ (সুনানে তিরমিজি)

সাধারণ মূল্যহীন পাথরটি হযরত ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) এর সংস্পর্শে এসে অনন্য মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। একথাও প্রতিয়মান হয় যে, নামায সম্পন্ন করার সময় আল্লাহ ব্যতিত অন্য কিছুর প্রতি সম্মান প্রদর্শণও জায়েজ আছে। কেননা, মাক্বামে ইব্রাহিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শণ নামাজের মধ্যে হচ্ছে।

মক্কার উম্মুল জুদস্থ জাদুঘরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালেহ বিন আব্দুর রহমানের সূত্রে জানা যায়, চার হাজার বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও মাক্বামে ইব্রাহিমে ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) এর পদ চি‎হ্ন অপরিবর্তিত রয়েছে। পাথরটির ওপরে প্রতিটি ছাপের দৈর্ঘ্য ২৭ সে:মি: এবং প্রস্থ ১৪ সে: মি:। পাথরের নিচের অংশে রূপাসহ প্রতিটি পাথরের দৈর্ঘ্য ২২ সে: মি: এবং প্রস্থ ১১ সে: মি: । পাথরটিতে ‎‎হযরত ইব্রাহিম ( আলাইহিস সালাম ) এর পদ চিহ্নের গভীরতা পাথরটির উচ্চতার অর্ধেক, ৯ সে: মি:। দীর্ঘদিন ধরে লাখ লাখ নবীপ্রেমিকের হাতের স্পর্শের পরও আঙ্গুলের চি‎হ্নগুলো এখনো বিদ্যমান। ভালো করে লক্ষ্য করলে এখনো বুঝা যায় আঙ্গুলের চাপ, বুঝা যায় পায়ের গোড়ালির চি‎হ্ন। আগে পাথরটি প্রয়োজনে স্থানান্তর করা যেত। জাহেলী যুগে লোকেরা বন্যার ভয়ে মাক্বামে ইব্রাহিমকে কাবা শরীফের মঞ্চে লাগিয়ে রাখত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়কাল থেকে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর খিলাফাতের সময় পর্যন্ত এ পাথর বাইতুল্লাহর সঙ্গে মিলিত ছিল। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর খিলাফাতের সময়কালে বন্যার স্রোতে এ পাথরটি ভেসে যায়। পরে তিনি তা সংগ্রহ করে বাইতুল্লাহ থেকে একটু দূরে সরিয়ে বর্তমান জায়গায় বসানো হয়। (সুনানে বায়হাকী) যুগে যুগে বহু শাসক মাক্বামে ইব্রাহিমের সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নেন। ১৬০ হিজরীতে খলিফা মাহদী হজ্বে এসে মাক্বামে ইব্রাহিম-পাথরটির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রূপা দিয়ে মজবুত করে মুড়িয়ে দেন। ইতোপূর্বে মানুষ পাথরটি হাতে ধরে দেখার সুযোগ পেয়েছিল। এখন শুধু দেখা যায়, ধরা যায না।

কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হযরত ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) এর শেষ জীবনের ইবাদতের স্থান মাক্বামে ইব্রাহিম। এর প্রতিটি অনুকণা খলিলুল্লাহর অশ্রু ধারায় সিক্ত/ সিঞ্চিত। তাঁর কর্মের অঙ্গন বিশ্ব মুসলিমের ইবাদতের স্থান। দিন-রাত এ স্থান জনাকীর্ণ। হজ ওমরা ও জিয়ারতকারীরা কাবা চত্ত্বরে কাঁচ ঘেরাও মাকামে ইবরাহিমের পাশে দু রাকাআত নামাজ পড়ে বারেগাহে ইলাহীতে স্বীয় মনোবাসনা কামনা করেন এবং তা স্বচক্ষে দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে হারামায়নে শরীফায়নের যিয়ারত, মহান নিদর্শনসমূহ স্বচক্ষে দেখা এবং মাকামে ইবরাহিমে নামাজ পড়ার পাশাপাশি মনের আশা-আকাঙক্ষা পূরণে দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন বিজাহিন নবিয়িল আমীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

লিখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা। খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।