মাওলানা শব্দের ব্যবহার; একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ২৮ ২০২১, ২৩:২৯

মুফতী মোস্তফা সোহেল হিলালী: ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ধর্মীয়বিধি মেনে চলেন লোকদেরকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন শব্দে ভূষিত করা হয়। কেউ শাইখ, কেউ মুতাওয়া’ কেউ হুযুর কেউ মাওলানা ইত্যাদি শব্দে এই শ্রেণীর লোকদেরকে সম্বোধন করে থাকেন। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান তথা উপমহাদেশে ধর্মীয় শিক্ষার নির্দিষ্ট একটি সিলেবাস যারা শেষ করেন তাদেরকে ‘মাওলানা’ বলে ভূষিত করার রীতি অনেক পুরাতন।

কিন্তু ইদানিং কেউ কেউ এই শব্দটি ব্যবহারের ওপর আপত্তি তুলছেন। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তাদের আপত্তির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌছিয়েছে যে, তাদের কেউ কেউ গবেষণা বা অনুসন্ধান ছাড়াই এই শব্দ ব্যবহারকে শিরক পর্যন্ত বলতে দ্বিধা করছেন না।

এই শব্দ ব্যবহারে আপত্তিতে তাদের সন্দেহের মূল হেতু হলো, ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ প্রভু ও অভিভাবক। কুরআনে এই শব্দটি আল্লাহ তা‘আলার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন- قُل لَّن يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا ۚ [٩:٥١]

আপনি বলুন, আমাদের কাছে কিছুই পৌঁছবে না, কিন্তু যা আল্লাহ আমাদের জন্য রেখেছেন; তিনি আমাদের অভিভাবক। أَنتَ مَوْلَانَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ [٢:٢٨٦]

তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের কে সাহায্যে কর।

অতএব ‘মাওলানা’ শব্দের অর্থ যখন আমাদের প্রভু, তখন শব্দটি অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

এবার আমরা দেখি যে, আলেমদের ক্ষেত্রে এই শব্দের ব্যবহার করা আসলেই ভুল, নাকি শব্দের অর্থ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই এমন প্রশ্ন উত্থাপনের মূল কারণ?

এই শব্দের ব্যবহার ও অর্থ নিয়ে আলোচনা করলে আমরা দেখব যে, মূলত শব্দের অর্থ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাই এমন প্রশ্নের সৃষ্টি করে।

‘মাওলানা’ শব্দটি আরবী দুটি শব্দের সমষ্টি। ‘মাওলা’ এবং ‘না’। আরবী ভাষায় ‘না’ একটি সর্বনাম। ‘আমাদের’ এবং ‘আমাদের’ বুঝাতে সর্বনামটি ব্যবহার করা হয়। অতএব ‘মাওলানা’ শব্দের অর্থ আমাদের মাওলা।

এবার ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ জানলেই আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর ও মানুষের বেলায় শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উদিয় সন্দেহ দূর হয়ে যাবে।

প্রথমত আমরা শব্দটির আভিধানিক অর্থ নিয়ে আলোচনা করব এবং পরবর্তীতে কুরআন ও হাদীসে শব্দটির ব্যবহার দেখব। যাতে করে শব্দটির ব্যবহার নিয়ে কারো মনে কোন ধরণের সংশয় না থাকে।

আরবী প্রসিদ্ধ এবং অন্যতম অভিধান ‘লিসানুল আরব’এ ‘মাওলা’ শব্দের যে অর্থ করা হয়েছে তার কিছু উদ্ধৃতির বাংলা তুলে ধরছি।

লিসানু আরবে শব্দটির অর্থ এভাবে করা হয়, ‘আল-মাওলা অর্থাৎ আল-হালীফ’। আর হালীফ শব্দের অর্থ হলো চিরসাথী। চিরকাল বন্ধুত্বে আবদ্ধ থাকার শপথের মাধ্যমে যার সাথে বন্ধুত্বে আবদ্ধ হওয়া যায় তাকে হালীফ বলা হয়। চাচাতো ভাই অর্থেও শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এই অর্থ দেখাতে গিয়ে একটি কাব্যাংশ উল্লেখ করা হয়েছে, যার মর্ম হলো, “তারা আমাদের মাওলা, যদিও তারা আমাদের ওপর অবিচার করেছে”। ‘মাওলা’ শব্দের এ দুই অর্থ ছাড়া আরো অনেক অর্থ সেখানে দেখানো হয়েছে। সবগুলোর আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। আমাদের কেবল এ কথা দেখানো প্রয়োজন যে, ‘মাওলা’ শব্দের অর্থ কেবল প্রভুই নয়। বরং প্রভু ছাড়া অন্য অর্থে তার ব্যবহারও বহুল প্রচলিত। প্রয়োজনে দেখুন: লিসানুল আরব, মাদ্দাহ: (و ل ي),১৫/৪০৮।

আরবী আরেকটি প্রসিদ্ধ ‘আল-মুনজিদ’এ এই শব্দটির যেসব অর্থ ধারাবাহিকভাবে লিখা হয়েছে তা হচ্ছে: মালেক, নেতা, কৃতদাস, কৃতদাস মুক্তকারী, মুক্ত কৃতদাস, অনুদানকারী, অনুদান গ্রহণকারী, বন্ধু, সাথী, চিরসাথী, প্রতিবেশি, আগমনকারী, অংশিদার, ছেলে, চাচা, চাচাতো ভাই, ভাগ্না, শশুর বা জামাতা, যে কোন নিকটতম ব্যক্তি, অভিভাবক, অধীনস্থ। আল-মুনজিদ, (و ل ي), পৃষ্টা : ৯১৯।

আরবী ভাষার বিখ্যাত অভিধান ‘আল-ক্বামুসুল মুহিত্ব’এ আল-মুনজিদে উল্লেখিত সব অর্থ উল্লেখ সহ আরো দুটি অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে, যথাঃ প্রভু, সাহায্যকারী। আল-ক্বামুসুল মুহিত্ব, মাদ্দাহ: (و ل ي),৪/৪০১।

আরবী সুপরিচিত অভিধান ‘আল-মু‘জামুল ওয়াসিত্ব’এ ও অনুরূপ সবকটি অর্থই উল্লেখ করা হয়েছে।

আরবী থেকে ইংরেজী প্রসিদ্ধ অভিধান ‘আল-ক্বামুসুল ‘আসরী’তে ‘আল-মাওলা’ শব্দটির অর্থ করা হয়েছেঃ Master, Lord, Benefactor, Friend, Nighbor. আল-ক্বামুসুল ‘আসরী, পৃষ্টা : ৮১৬।

এছাড়া আরবী অন্যান্য অভিধানেও শব্দটির অনুরূপ অর্থ পাওয়া যায়। প্রসিদ্ধ কয়েকটি অভিধান দেখে নিলেই জানা যায় শব্দটির অর্থ কি?

যদি এমন দাবী করা হয় যে, শব্দটির প্রকৃত অর্থ প্রভু, যদিও তা কখনো অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে আমরা প্রথমত বলব যে, এটি একটি অবান্তর ও ভিত্তিহীন দাবী। আরবী লেখকদের অভিধানে এরকম কোন ইঙ্গিত নেই। বরং অনেক অভিধানে প্রভু অর্থের কথাটি উল্লেখ করা হয়নি। এতে বরং উল্টোটাই প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ ‘মাওলা’ শব্দের মূল অর্থ প্রভু নয়। তবে প্রভু অর্থেও তার ব্যবহার বিদ্যমান রয়েছে।

দ্বিতীয়ত আমরা যদি ধরেও নেই যে, ‘মাওলা’ শব্দের মূল অর্থ প্রভু, যদিও তা রূপক হিসেবে অন্য অর্থে ব্যবহার হয়, তবুও অন্যের ক্ষেত্রে ‘মাওলা’ শব্দের ব্যবহারে না শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে কোন সমস্যা রয়েছে, না ব্যবহারের প্রচলেনর ক্ষেত্রে কোন সমস্যা রয়েছে।

যেমন ‘সালাত’ শব্দের মূল অর্থ: নিতম্ব হেলানো, দু‘আ। তবে পারিভাষিক অর্থে আমরা আমাদের দৈনন্দিনের ‘ইবাদাতের বিশেষ এক পদ্ধতিকে সালাত বলে থাকি। এই রূপক অর্থ গ্রহণ কি না-জায়েয? নাকি ‘সালাত’ বলতে আমরা এই অর্থই বুঝে থাকি?

এতক্ষণ আমরা শব্দটির আভিধানিক ও পারিভাষিক ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করলাম। এবার যদি আমরা কুরআন ও হাদীসের দিকে দৃষ্টিপাত করি তবে দেখব যে, ‘মাওলা’ শব্দকে আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহারকে না-জায়িয বা শিরক বলা, অথবা অন্য অর্থে শব্দটির ব্যবহারকে অর্থের বিকৃতি বলা মারাত্মক অন্যায় ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার পরিচায়ক।

কুরআনুল করীমের একাধিক আয়াতে ‘মাওলা’ শব্দটিকে প্রভু ছাড়া অন্য অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ [٤:٣٣]

আর আমি পিতা-মাতা এবং নিকটাত্নীয়গণ যা ত্যাগ করে যান সেসবের জন্য মাওয়ালী (‘মাওলা’ শব্দের বহুবচন ‘মাওয়ালী’ অর্থাৎ উত্তরাধকারী) নির্ধারণ করে দিয়েছি।

আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

وَإِنِّي خِفْتُ الْمَوَالِيَ… [١٩:٥]

আমি ভয় করি মাওলাদেরকে (স্বগোত্রকে)।

অপর আরেক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

ادْعُوهُمْ لِآبَائِهِمْ هُوَ أَقْسَطُ عِندَ اللَّهِ ۚ فَإِن لَّمْ تَعْلَمُوا آبَاءَهُمْ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَمَوَالِيكُمْ [٣٣:٥]

তোমরা তাদেরকে তাদের পিতৃপরিচয়ে ডাক। এটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত। যদি তোমরা তাদের পিতৃ-পরিচয় না জান, তবে তারা তোমাদের ধর্মীয় ভাই ও মাওয়ালীরূপে (বন্ধুরূপে) গণ্য হবে।

অপর এক আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ [٦٦:٤]

তবে জেনে রেখ আল্লাহ জিবরাঈল এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণ তাঁর মাওলা (বন্ধু বা সহায্যকারী)।

কুরআনের এই আয়াতগুলিতে আমরা দেখলাম যে, ‘মাওলা’ শব্দকে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।

ভাষা, গ্রামার, ব্যাকরণ সহ সকল জ্ঞানের উৎস কুরআনুল করীমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেখানে ‘মাওলা’ শব্দকে বিভিন্ন অর্থে এবং তিনি ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার দেখিয়েছেন, সেখানে এর ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলা কুরআন সম্পর্কে চরম পর্যায়ের জ্ঞানহীনতার পরিচয় বহন করে।

কুরআনের পরে এবার আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামের হাদীসে শব্দটির ব্যবহার দেখি। একাধিক হাদীসে ‘মাওলা’ শব্দটিকে প্রভু ছাড়া অন্য অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, যার সুচি অনেক দীর্ঘ। এখানে নমুনাস্বরূপ কয়েকটি হাদীসের অংশ বিশেষ তুলে ধরছি।

সহীহুল বুখারীর একটি দীর্ঘ হাদীসের শেষাংষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম যায়দ (রাযি.)কে সম্বোধন করে বলেন, “তুমি আমাদের ভাই ও আমাদের মাওলা”। এখানে ‘মাওলা’ শব্দটি বন্ধু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

আরেকটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লাম বলেন, “আর যার কোন মাওলা নেই আমি তার মাওলা”। এখানে ‘মাওলা’ শব্দটি অভিভাবক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

অন্য হাদীসে রয়েছে, “যে কৃতদাস তার মাওলার অনুমতি ব্যতীত বিবাহ করবে, তার বিবাহ অগ্রাহ্য হবে”। এখানে মাওলা অর্থ মনীব বা কৃতদাসের মালিক।

অন্য হাদীসে রয়েছে, “আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা” এখানে মাওলা অর্থ অভিভাবক।

সর্বোপরি একটি হাদীসে মাওলা বলার নির্দেশ পাওয়া যায়। যেমন আরবদের মাঝে মনিব তার মালিক রব্ব বলার প্রচলন রয়েছে। যেকোন বস্তুর মালিককেও সেই বস্তুর দিকে সম্পৃক্ত করে রব্ব বলা হয়। যেমন রব্বু-দ্‌দার, অর্থাৎ ঘরের মালিক। বস্তুর দিকে সম্পৃক্ত করে রব্ব শব্দের ব্যবহারে আল্লাহর সাথে সাদৃশ্যের সম্ভাবনা নেই। বিধায় এমন ব্যবহারকে সমস্যা মনে করা হয় না। কিন্তু তার মালিককে আমার রব্ব বললে আল্লাহর রব্ব নামের সাথে সদৃশ হওয়ায় রাসূল এমনটি বলা থেকে বারণ করেন এবং আমার রব্ব বলা পরিহার করে ‘আমার মাওলা’ বলার নির্দেশ দেন। যেমন হাদীসে রয়েছে-

“وَلاَ يَقُلْ أَحَدُكُمْ رَبِّى. وَلْيَقُلْ سَيِّدِى مَوْلاَىَ ”

“আর তোমাদের কেউ যেন আমার রব না বলে। সে যেন বলে, আমার সরদার আমার মাওলা”

উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের ক্ষেত্রে মাওলা শব্দকে তার উপযুক্ত অর্থে ব্যবহারে না শিরক রয়েছে, না শিরকের কোন আবাস। বরং এর ব্যবহারে প্রশ্ন তুলা অবান্তর।

অতএব জাতির কর্ণধার আলেম সমাজ যারা জাতিকে দিচ্ছেন কুরআন হাদীসের দিক-নির্দেশনা, মমতার অভিভাকত্ব দিয়ে পথহারা মানুষকে দেখাচ্ছেন সঠিক পথ, তাদের ক্ষেত্রে ‘মাওলানা’ অর্থাৎ আমাদের অভিভাবক বন্ধু শব্দের ব্যবহার কেবল বৈধই নয়, বরং অত্যন্ত মানানসই। নবীগণের ওয়ারিস আলেমগণ অবশ্যই আমাদের মাওলা আমাদের অভিভাবক। তাদেরকে আমাদের মাওলা বা অভিভাবকের মর্যাদার আসনে বসাতেই হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝার তাওফীক দান করুন। আমীন।