ব্যবসা-বাণিজ্যে আলেমদের আশা জাগানিয়া অংশগ্রহণ 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ২৫ ২০২০, ১৬:০৩

মুহাম্মদ ইমদাদুল হক ফয়েজী: যুগে যুগে মানুষজন নিজ হাতে বা নিজের কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে বা অন্য কোথাও থেকে আমদানি করার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্রত রয়েছেন। আবার অন্যান্য পেশার মানুষেরা নিজেদের চাহিদার আলোকে তাদের কাছ থেকে পণ্য, দ্রব্য ক্রয় করার মাধ্যমে দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ করছেন। এতে করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষই উপকৃত হচ্ছেন। ফলে এটি মানব জীবনের অনস্বীকার্য আনুষঙ্গিক বিষয় ও ঐতিহ্য হিসেবে হিসেবে রূপ নিয়েছে। অকপটে বলা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়া পৃথিবী অচল হয়ে পড়বে।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আল্লাহ বেচাকেনা হালাল করেছেন আর হারাম করেছেন সুদ।’ (সুরা বাক্বারাহ : ২৭৫) কোরআন-হাদিসে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ ও পদ্ধতি, নিয়ম-নীতি, গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও উপকারিতা বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে- আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘অতঃপর সালাত শেষ হলে তোমারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর ও আল্লহকে খুব বেশী স্মরণ কর, যাতে তোমারা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমুয়াহ : ১০)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণের বক্তব্য হচ্ছে, এখানে ‘অনুগ্রহ’ শব্দ দ্বারা হালাল উপার্জন উদ্দেশ্য। আর আমরা সকলেই জানি, হালাল উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ব্যবসা-বানিজ্য।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘ফরজ কাজসমূহের মধ্য থেকে একটি হচ্ছে হালাল উপার্জন।’ আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং পূর্ববর্তী অনেক নবী-রাসুল আ. ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামসহ রা. উম্মতের পূর্ববর্তী পৃথিবী খ্যাত আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকিহ, স্কলার ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করেছেন। চার মাজহাবের শীর্ষ ইমাম, সু-প্রশিদ্ধ ও বরেণ্য ইসলামি আইনবিদ আবু হানিফা নোমান রহ. ইরাকের কুফা নগরের প্রশিদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। এটি তাঁর পৈত্রিক ঐতিহ্যও ছিল। প্রযুক্তির উন্নত এ যুগে ব্যবসার রূপরেখা, পরিধি, ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েই চলছে। এক্ষেত্রে অনলাইনে বেচাকেনা, হোম ডেলিভারি সিস্টেম সর্বশেষ সংস্করণ এবং সহজলভ্য মাধ্যম।

আমাজন, আলিবাবা, দারাজ, ইভ্যালি ইত্যাদি অগণিত প্রতিষ্ঠান অনলাইন ব্যবসা অত্যন্ত সফলভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। দেশ-বিদেশ, শহর-গ্রাম সবখানেই এসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতার চাহিদা মতো পণ্যাদি সরবরাহ করে জনজীবনে আভিজাত্য আর নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানের বাইরে রয়েছে ব্যক্তি ও গ্রুপকেন্দ্রীক ছোট-বড় নানান অনলাইন সপ। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের পাশাপাশি হাল সময়ে আলেমগণও এপথে যুক্ত হচ্ছেন এবং বেশ সুনাম-সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষত করোনাকালের এ দুঃসময়ে কওমি ফাউন্ডেশন, কওমি উদ্যোক্তা অনলাইন বেচাকেনায় সোস্যাল মিডিয়ায় বেশ সাড়া ফেলেছে। কোনও কোনও আলেম নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে এসব গ্রুপে নিজস্ব উৎপাদিত পণ্য পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করছেন৷ আবার কেউ কেউ বিভিন্নভাবে সংগৃহীত খাদ্যদ্রব্য, পরিধেয় বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও গৃহস্থালি সাজসজ্জা সামগ্রী, হস্তশিল্পের রকমারি বস্তু, নতুন-পুরাতন মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি ক্রয় বিক্রয় করছেন। যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং আশাব্যঞ্জক।

আলেমরা ব্যবসায় সম্পৃক্ত হলে যেভাবে তারা নিজেরা উপকৃত হবেন সেভাবে সাধারণ শ্রেণীর মানুষজনও উপকৃত হবেন। যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস পরিলক্ষিত হয়, সেখানে সহজেই তারা সকলের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করা যায়। এটি আমাদের একান্ত কামনাও বটে। অবশ্য, এক্ষেত্রে প্রায় সকলেই নতুন হওয়ায় গ্রুপে বা ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই জানতে চান- শুরুটা কিভাবে করবেন বা কী দিয়ে শুরু করবেন। তাই নতুন আগ্রহী ভাইদের জন্য কিছু পরামর্শ তুলে ধরছি।

ইচ্ছা ও আত্মবিশ্বাস

আপনি এটিতে উত্তীর্ণ হতে পারলে ভেবেচিন্তে, আপনার অভিভাবক ও পরিবারের সাথে সাথে পরামর্শ করে তাদের অনুমতি ও দুয়া নিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় অভিজ্ঞদের কাছ থেকে আইডিয়া নিয়ে নামতে হবে। আগে থেকে আপনার অভিজ্ঞতা থাকলে ভালো। অবশ্য, এধারায় প্রায় সকলেই নতুন। সাবধান, আপনার হাতে কিছু টাকা রয়েছে অন্যদের দেখে মাথায় একটা আসলো, ব্যাস হুজুগের বশবর্তী হয়ে নেমে পড়লেন, এটা কোনোভাবেই কাম্য এবং কল্যাণকর নয়। যা পরবর্তীতে আক্ষেপ-আফসোস এর কারণ বৈ কিছুই হবে না।

পুঁজি, সময় ও পণ্যের চাহিদা

ধরুন, আপনার এলাকায় যেসব জিনিস আছে এবং আপনার বাইরের এলাকায় এগুলোর চাহিদা আছে, আপনার সেরকম পুঁজিও আছে, পাঠানোর ও ভালো ব্যবস্থা আছে তো আপনি সেগুলো দিয়েই শুরু করতে পারেন। বা আপনার এলাকায় যেসব জিনিসপত্র সাধারণত কম আবার যথেষ্ট চাহিদাও রয়েছে, অন্য জায়গা থেকে তা কালেকসনের ভালো সুবিধা রয়েছে সেগুলো দিয়েও শুরু করতে পারেন।যেমন, খাঁটি মধু, ঘি, বিভিন্ন প্রকার তেল, ইত্যাদি। আপনি বিশ্বস্ত কোনও ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ আলোচনা করে তার কাছে থেকে এগুলো পাইকারি মূল্যে ক্রয় করে পাইকারি বা খুচরা সেল দিতে পারেন। এক্ষেত্রে কিছু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, নিজ এলাকাকে টার্গেট করে অগ্রসর হতে পারেন। এছাড়া পরিবারের সদস্যদের ভালো হস্তকর্ম জানা থাকলে সেদিকেও মনোনিবেশ করতে পারেন। যেমন- ডিজাইন কাঁথা ও বিছানা চাদর ওয়ালম্যাট, সোপিছ, হস্তশিল্প ইত্যাদি। এগুলো অনলাইনেও সেল করতে পারেন।

ধৈর্য, সততা ও গুণগত মান

সুন্দর আচরণ, সততা, গুণগত মান, সময় মতো ডেলিভারি, যে কোনোও ব্যবসায় সুনাম ও সফলতা লাভের পূর্বশর্ত। কাস্টমার রাগ বা এমন আচরণ করতে পারে যা শোভনীয় নয়, এক্ষেত্রে আপনাকে ধৈর্য্য ও হেকমতের সাথে তা মোকাবিলা করতে হবে। কাস্টমারের জন্য বিরক্তিকর কাজ যেমন- অতিরিক্ত দামাদামি, অতিরিক্ত বা অসময়ে যোগাযোগ, জোরাজোরি, চাপাচাপি করা থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকবেন।

ভারসাম্যপূর্ণ দাম

আপনার পণ্যসামগ্রীর মূল্য অন্যান্য ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের সাথে ভারসাম্য বা সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখার চেষ্টা করবেন। অন্যদের থেকে মূল্য খুব বেশি বৃদ্ধি বা কম করবেন না। এক্ষেত্রে অবশ্য আপনার মূল্য, ক্যারিং খরচ ইত্যাদি ব্যয় মাথায় রাখতে হবে।

কথাবার্তায় স্বচ্ছতা

অনলাইন ব্যবসায় কাস্টমারের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা না বলে শুদ্ধ ভাষায় সুন্দর ও মাধুর্যতার সাথে কথা বলুন। ডেলিভারির পূর্বে কথা পাকাপোক্ত করুন। যেমন মূল্য পেয়ে পণ্য পাঠাবেন নাকি পণ্য ডেলিভারি কালে মূল্য পরিশোধ করা হবে, কয়দিনের মধ্যে ডেলিভারি হবে, হোম ডেলিভারি নাকি অন্যভাবে, ডেলিভারি খরচ, প্যাকেটিং খরচ ইত্যাদি উল্লেখ করে কথা পাকাপোক্ত করে পণ্য পাঠাবেন।

গিফট ও যোগাযোগ

সম্ভব হলে ক্রেতাকে কিছু গিফট করতে পারেন। এটি আপনার প্রতি তাকে আরোও আকৃষ্ট করতে সহায়ক হবে। ডিলেভারির নির্ধারিত সময়ের কিছু পরে কাস্টমারের সাথে যোগাযোগ করে তার পণ্য প্রাপ্তির ব্যাপারে নিশ্চিত হোন। এক্ষেত্রে অনিবার্য কারণে নির্ধারিত সময়ে পণ্য ডেলিভারি না হলে হলে দুঃখ প্রকাশ করে প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে তাকে চিন্তামুক্ত করুন। অপরদিকে সঠিক সময়ে ডেলিভারি হলে আপনার যোগাযোগে সে খুশি হবে, উৎসাহিত হবে। যা পরবর্তীতে আপনার কাস্টমার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।

অফার ও রিভিউ

ব্যবসা জমাতে স্পেশাল অফার দিতে পারেন। যেমন প্রথম ১০/২০ জনের জন্য সাথে বাড়তি কিছু ফ্রি, ডেলিভারি ফ্রি। ১০/২০ কেজি নিলে ডেলিভারি ফ্রি বা সাথে অন্য কিছু ফ্রি ইত্যাদি। আপনার পণ্যের প্রতি অন্যদের উৎসাহিত করতে কাস্টমার থেকে আপনাকে/ আপনার প্রতিষ্ঠানকে ম্যানসন করিয়ে পণ্যের গুণগত মান ও সেবার ওপর রিভিউ লিখাতে পারেন।

পরিচিতজনদের সাথে সেয়ার

আপনার প্রচারণার পাশাপাশি শিক্ষকমণ্ডলী, বন্ধুমহল, আত্মীয়, প্রতিবেশী, সহপাঠী, সজ্জ্বন, পরিচিতজনের সাথে ব্যবসার বিষয়টি সেয়ার করুন, তাদের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করুন। এতে করে পরিচিতি ও কাস্টমার বৃদ্ধি পেতে থাকবে।

মনে রাখবেন, ব্যবসায় সফল হওয়ার জন্য পরিচিতি ও বিশ্বস্ততা গুরুত্বপূর্ণভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই আপনার পরিচিতি ও বিশ্বস্ততা যত বেশি বিস্তৃত করতে পারবেন, ততবেশি সমৃদ্ধি ও সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।

সর্বোপরি, ব্যবসায় হালাল উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম, নবীগণের সুন্নত এবং মানবসেবামূলক কাজ। সততা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারি ও কল্যাণকামীতার সাথে ব্যবসায় ব্রতদের জন্য দুনিয়া-আখেরাত উভয় জগতেই সমৃদ্ধি ও সফলতা রয়েছে। এ লক্ষ্যের ওপর অটল থেকে আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ লাভের মানসে পথচলা শুরু করুন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন, আমাদের সকলকে সমৃদ্ধ করুন। আমিন।