বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রেগিং জিরো টলারেন্সে এনে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন – সৈয়দ মবনু

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ১১ ২০১৯, ০৫:৩৯

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর কাছে খুব পরিচিত একটি শব্দ রেগিং। রেগিং-এর দুটি অর্থ হয়,
১. পরিচিতি রেগিং : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন নতুন শিক্ষার্থী আসে তখন পুরাতনরা তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলতে যখন চেষ্টা করে তখন সেটাকে পরিচিতি রেগিং বলে অভিহিত করা হয়। এতে থাকে একেঅন্যের সাথে পরিচিত হওয়া, গান গাওয়া, কবিতা আবৃতি করা ইত্যাদি। এই রেগিং-এর কিছু ভালোদিক রয়েছে। যেমন, রেগিং এর মাধ্যমে সিনিয়রদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠা। এই সম্পর্কের মাধ্যমে সিনিয়রেরা ক্লাসের সীট, হ্যান্ডনোট এবং পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের গাইডলাইন দিয়ে থাকেন। সিনিয়ররা জুনিয়রদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযোগি চলাফেরা এবং ব্যাচের সবার সাথে একতা বজায় রেখে চলার গাইডলাইনও দিয়ে থাকেন। এগুলো একজন প্রত্যেক নতুন ছাত্র-ছাত্রীর খুবই উপকারে আসে।

২. তিরস্কার রেগিং : যেখানে সিনিয়র অনেক খারাপ ব্যবহার করে থাকেন। সিনিয়রের নির্দেশে নতুন ছাত্র-ছাত্রীকে রোদে ক্যাম্পাসে দৌড়ানো, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন সহ বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এই রেগ অশ্লীল কথাবার্তা, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী প্রদর্শন ইত্যাদি অনেক নোংরামিতে ভরা। অনেক রেগার মেয়েদেরকে যৌন নির্যাতনও করে থাকে বলে বিভিন্ন রিপোটে প্রকাশ। রেগ অসহনীয় পর্যায়ে চলেগেলে অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অনেক জায়গায় রেগিং এর নামে সেক্সের বিষয়াদিও শেখানোর অভিযোগ রয়েছে। এমনও ঘটনা রয়েছে নতুনদেরকে সারারাত কিংবা রাতের বেশী অংশ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে নির্ঘুম রাখা হয়। অনেককে সবার সামনে লাঞ্চনার শিকার হতে হয়। ফলে অনেকের প্রাথমিক জীবনে নেমে আসে দুর্বিসহ অন্ধকার। অনেক রেগিং আতঙ্কে মানসিক রোগীও হয়ে যান। মেয়েদেরকে যৌন হয়রানি করেও রেগিং করা হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ। রেগ কখনও একক, আবার কখনও যৌথভাবে ঘটানো হয়ে থাকে। বেশিরভাগ রেগিং হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। প্রায় প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই রেগিং-এর জন্য পৃথক সেল রয়েছে বলে জানা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রেগিং-এর নামে যে ক্রাইম হয় সেগুলোর দিকে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টি না থাকায় দিনদিনে বিষয়গুলো লাগামহীনভাবে সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। বুয়েটে আবরার নির্যাতীত হয়ে মারা গিয়েছে, প্রতিবাদে ছাত্ররা আন্দোলন করছে, তাই বিষয়টি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু আমরা কি জানি, প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রেগিং-এর নামে কত প্রকার নির্যাতন চলে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন আর রেগিং-এর শিকার হননি, এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাই বললেই চলে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও কিছুটা কম। এই রেগিং-এর সাথে জড়িত বেশিরভাগই বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুর ছাত্র সংগঠনগুলো। এখানে শক্তিধর কেউ থেকে কেউ কম নয়। তবে সবসময় সরকার দলীয়রাই রেগিং-এর ক্ষেত্রে শীর্ষে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ছাত্রদল-শিবির ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগিং-এ এগিয়ে। আর আওয়ামীলীগের সময় ছাত্রলীগ। রেগিং সম্পর্কে যাদের কিছু অবগতি রয়েছে তারা তাদের সন্তানদেরকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করতে খুবই আতঙ্কিত থাকেন।

রেগিং-এর শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আকাশী (ছদ্মনাম) নিজের অভিজ্ঞার কথা বলেছিলো। বর্ণনাটা এমন ছিলো, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরে যেমন খুশি হয়েছিলাম, তেমনি হয়েছিলাম নার্ভাস। কারণ আমাকে এক আত্মীয় আগেই রেগিং পার্টির খবর দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার পূর্বে আমি কোনদিন ‘রেগিং’ শব্দও শোনেনি। আত্মীয়ের কাছে বর্ণনা শোনে আমার শরীর কাঁপতে থাকে। পরে যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে প্রথম পা রাখি সেদিন শুধু শোনতে পাই চার দিক থেকে আমাকে রেগিং গ্রুপগুলো ডাকছে। আমার মাথাটা আতঙ্কে কেমন ভনভন করতে থাকে। এভাবে আমি এগিয়ে একটি হলের সামনে আসতেই সিনিয়র ব্যাচের কিছু জটলাবাঁধা ছাত্র-ছাত্রী আমাকে ‘হ্যাঁলো দিদি’ বলে হাতের ইশারায় ডাকে। তখন আমার সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে। কারণ আমি এমনি নার্ভাস প্রকৃতির মেয়ে। তা ছাড়া মা-বাবা, ভাই-বোন ছাড়া অন্য কারো সাথে তেমন কথা বলার অভ্যাস আমার ছিলো না। আমি কাছে যেতেই একজন মন্তব্য করলো, মাল তো খারাপ না। আরেকজন বললো, ক্ষেত মনে হচ্ছে। কাছে এসে একজন প্রশ্ন করলো, সখি তর বাড়ি কৈ? ওদের কথাগুলো আমার নার্ভাস মনকে আরও নার্ভাস করতে থাকে। আমি কোন উত্তরই দিতে পারি না। একজন একেবারে আমার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে ওড়নার মাথা আঙ্গুলে প্যাচিয়ে জিজ্ঞাস করে, জিনিষটা কি দেশি না বিদেশী। এই জিনিষে তো একেবারে কাচা গোলাপের মতো লাগছে। আরেকজন এসে একেবারে ওড়নাটা সরিয়ে আমার বুকের দিকে চেয়ে বললো, একেবারে টাটকা মালরে ভাই, একেবারে টাটকা। আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো দৌঁড়ে পালিয়ে যাবো, কিন্তু পা চলছিলো না। আমার অজান্তে হাত থেকে বেনিটি ব্যাগ মাটিতে পড়ে গেলে একজন এসে তছনছ করে দেখতে থাকে ব্যাগের ভেতর কি? আরেকজন বলতে থাকে, দেখ ব্যাগে কন্ডম-টন্ডম আছে কি না? আমি কিংবর্তব্য বিমূঢ় হয়ে যাই। ভেবে পাই না ওরা এমন করে কেন? আমি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি।
অতঃপর কি হয়েছে, না হয়েছে তা আকাশি বলেনি। অবশ্য সে ফিনিসিং করেছে এই বলে, অবশেষে সিনিয়র একজনের মনে রহম হয়। সে তার সাথীদেরকে বলে, হইছে, ওকে বাদ দাও এখন।
আকাশির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তা কি তোমার মা-বাবা জানেন? সে বললো, পাগল নাকি? আকাশি তার এই অভিজ্ঞতার কথা মা-বাবাকে সেদিন বলতে পারেনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রেগিং-এর অবস্থা এতই মারাত্মক পর্যায়ের ছিলো, আকাশি জীবনে তা কোনদিন ভুলেনি। এখনও মাঝেমধ্যে সেদিনের কথা তার স্মরণ হলে সে অন্য মনস্ক হয়ে যায়।
আমাকে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন তার এক পরিচিত এক মেয়ের অভিজ্ঞতার কথা। মেয়েটির বাড়ি সিলেট শহরে। সে খুব মেধাবী। মা-বাবার ইচ্ছে ছিলো মেডিকেলে ভর্তির। কিন্তু তার ইচ্ছে বুয়েটে আটিটেকচারে ভর্তি হবে। ভর্তি পরিক্ষায় সে দশ-এর ভেতর ফলাফল করলো। প্রথমদিনে বুয়েটের অভিজ্ঞতা সে জানায় তাকে একটি রোমে সারারাত বন্ধী করে রাখা হয়। অবশ্য সে রাত মেয়ের সাথে কি ব্যবহার করা হয়েছে, যৌন হয়রানি করা হয়েছে কি না তা এই সাংবাদিক বন্ধুকে মেয়ের বাবা বলেননি। আমার এক ঘণিষ্ট ডাক্তার, যিনি সিলেটের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁর পরিবারও সিলেটের অত্যান্ত সম্মানিত একটি পরিবার। তিনি তাঁর ছেলের বুয়েটে ভর্তির পর এক বছর কীভাবে হলে তার জন্য বরাদ্দকৃত রোমে উঠতে পারেনি, সেই বর্ণনা দিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ওরা হলো দাজ্জাল। তিনি বলেন, রেগার অসভ্যরা এক রাত আমার ছেলেকে তার রোমে বন্ধি করে রাখে। তবে তারা তাকে মারামারি করেছে কি না সেটা ছেলে আমাকে বলেনি। হয়তো মেরেছে, কিন্তু ছেলে লজ্জায় আমাকে বলেনি।
এভাবে অসংখ্যা ঘটনা রয়েছে। গ্রাম কিংবা মফস্বল শহর থেকে আসা ছেলে-মেয়েরা বেশি রেগিং-এর শিকার হয়। অনেক ছেলে-মেয়ে এই রেগিং-এর ভয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায় না। যারা রেগিং সম্পর্কে অবগত এমন অনেক মা-বাবা রেগিং-এর আতঙ্কে নিজেদের ছেলে-মেয়েকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দিতে চান না। অর্থিক অসুবিধা থাকার পরও কেউ কেউ রেগিং-এর ভয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বিশেষ করে মেয়েরা। সরকারের উচিৎ ইভটিসিং-এর মতো রেগিং এবং রেগারদেরকে জিরো টলারেন্সে নিয়ে এসে প্রতিরোধ করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অসভ্য রেগিং বন্ধ হয়েগেলে খুন-খারাপি, হত্যা, মাস্তানী ইত্যাদি অনেকটা হ্রাস পেয়ে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।