বিনয়ের মর্যাদা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

আগস্ট ০২ ২০২১, ১৮:৩৬

মাওঃ হাসান মুরাদ

বিনয় ও নম্রতা নবী-রাসুলদের প্রকৃতিগত স্বভাব। দরবেশদের অভ্যাস। মুমিনের ভূষণ। যার কাছে বিনয়ের গুণ নেই সে প্রকৃত মুমিন নয়।

কিন্তু বিনয় কাকে বলে?

কীভাবে বিনয়ী হওয়া যায়?

বিনয়ের দৃষ্টান্তই বা কী?

বিনয়ঃ

(১)হযরত ফুযায়েল ইবনে ইয়াজ রা. বলেন, বিনয় হলো অকপটে সত্য স্বীকার করা। সত্য মেনে তা অনুসরণ করা যদিও তা অধীনস্থ,ছোট বা মূর্খের কাছে হয়।( (আল-ইহইয়া ৩/৩৬২ (২)হযরত হাসান রা. বলেন, বিনয় হলো নিজেকে ছোট মনে করা। অন্যকে নিজের উপর প্রাধান্য দেয়া। (আত-তাওয়াজু ওয়াল খুমুল -১৫৪) (৩)হযরত ইয়াহইয়া বিন কাছির রহঃ বলেন, বিনয় তিন গুণের সমষ্টি। ১. উত্তম মজলিসে নিজেকে ছোট মনে করা। ২. আগে অন্যকে সালাম দেয়া। ৩. আত্মপ্রশংসা, খ্যাতি এবং নিজের কৃত কল্যাণকর কাজ প্রকাশ পাওয়াকে অপছন্দ করা।( আত-তাওয়াজু ওয়াল খুমুল -১৫৫)

(৪) ইবনে মুবারক রহ. বলেন: বিনয় হল, পার্থিব-ঐহিক নিয়ামতে নিজেকে নিম্নস্তরের মানুষ থেকে তুচ্ছ জ্ঞান করা এবং উপরস্থ মানুষের তুলনায় নিজেকে তুচ্ছ মনে না করা।

বিনয়ীর মর্যাদা:

(১) হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন: যে বিনয়ী হয় আল্লাহ তার হেকমত বৃদ্ধি করে দেন। এবং বলেন উন্নীত হও,আল্লাহ তোমাকে উন্নতী দান করেছেন। আর যে অহংকার, সীমালঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে জমীনে নীচু করে দেন, আর বলেন তুমি লাঞ্ছিত হও, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করেছেন। অহংকারী নিজের চোখে বড় কিন্তু অন্যের চোখে ছোট। এমনকি সে অন্যের চোখে শুকুর থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। ( আল-ইহইয়া .২/২৫৪

(২) হযরত আবু হাতিম রা. বলেন; বিনয় মানুষের মান,মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেয়। মানুষের সম্মান উচু করে দেয়। (আযযুহুদ লিল ইমাম আহমদ -২০)

(৩) হযরত আয়েশা রা. বলেন; তোমরা উত্তম ইবাদতের ব্যাপারে খুবই উদাসীন। উত্তম ইবাদত হলো,নম্রতা-বিনয়। (বুখারী শরিফ)

(৪) হযরত ইউসুফ বিন আসবাত রহ: বলেন; অধিক আমল থেকে কম খোদাভীতি উত্তম। এবং অধিক ইজতিহাদ থেকে কম বিনয়ী হওয়া শ্রেষ্ঠ। (Avj-BqBqv-৩/৩৬১)

বিনয়ীর কিছু দৃষ্টান্ত:

(১) রাসুল সা. এর সামনে বাসি খাবার এবং গমের রুটি দেয়া হলেও তিনি তা নি:সংকোচে খেতেন  (তিরমিযী)

(২) হযরত আনাস রা. বলেন: রাসুল সা. এর সামনে পোকা খাওয়া খেজুর পেশ করা হতো। তিনি তা বেছে বেছে খেতেন। (সহীহ জামে) এছাড়াও রাসুল সা. নিজের কাজ নিজে করতেন। ঘরের কাজে স্ত্রীদের সাহায্য করতেন। ইবনু আছির রহ: বলেন এর দ্বারা রাসুল সা. বিনয়ী হতে চাইতেন এবং অহংকার দুর করতে চাইতেন। (মাদারিজুস সালিকীন- ২৪৪ )

(৩) হযরত আবু মুলাইকা রা. বলেন; হযরত আবু-বকর রা. উটের পিঠে ছিলেন। তার হাত থেকে উটের লাগম পড়ে গেল। লাগাম উঠানোর জন্য তিনি উটকে বসালেন এবং লাগাম তুলেনিলেন। আবু মুলাইকা বলেন আমি বললাম: হযরত আমাকে আদেশ করলে আমিই তা তুলে দিতাম। হযরত আবু-বকর রা. বললেন আমার হাবিব সা. আমাকে কারো কাছে কোন কিছু চাইতে নিষেধ করেছেন।(সিফাতুস সফওয়া -১/২৩৫)

(৪) হযরত উরওয়া ইবনে জুবাইর রা. বলেন;আমি দেখলাম, হযরত ওমর রা. নিজ কাঁধে পানির মশক বহন করছেন। আমি বললাম হযরত আপনি নিজে মশক বহন করছেন কেন? উত্তরে বললেন,গত দিন বিভিন্ন প্রতিনিধিদল এবং শ্রোতারা আমার কাছে এসেছিল। এতে আমার অন্তরে কিবির অনুভব হচ্ছে। তাই আমি তা দূর করছি। (মাদারিজুস সালিকীন ২/৩৩.)

(৫) হযরত হুসাইন বিন আলী রা. একদিন ফকির,মিসকিনদের পাশ দিয়ে হাটছিলেন। এসময় মিসকিনরা ডেকে বলল, হে রাসুলের সন্তান আমাদের কাছে আসো। হুসাইন রা. তাদের ডাকে সাড়া দিলেন। তাদের সাথে শুকনো রুটি খেলেন। তারপর তাদের সাথে করে বাড়ি নিয়ে গেলেন। বাড়ি গিয়ে খাদেমদের বললেন; তোমরা যা সঞ্চয় করেছ,তা এদের দিয়ে দাও।(তাম্বীহুল গাফিলীন .৯৫)

(৬) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কোন প্রয়োজনে বের হলেন। তখন কিছু মানুষ তার পেছনে হাটতে লাগলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, তোমরা আমার পেছনে হাটছ,তোমাদের কোন উদ্দেশ্য আছে? তারা বলল না। আমরা আপনার সাথে চলার ইচ্ছা করেছি। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.বললেন তোমরা ফিরে যাও। এতে অনুসারীরা নীচুতা অনুভব করে এবং অনুসৃত ফিতনায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে। (সিফাতুস সফওয়া.১\৪০৬)

(৭)মুবারক ইবনে ফুজালা রহ: বলেন;ওমর রা. এক ব্যক্তির সাথে কোন বিষয়ে কথা বলছিলেন।কোন কারণে লোকটি ওমরকে (রা.) বললেন: ওমর আল্লাহকে ভয় করো! একথা শুনে পাশে থাকা লোকগুলো অবাক হলেন! লোকটিকে বললেন;তুমি ওমরকে বলছ; আল্লাহকে ভয় করো? ওমর রা. তখন তাদের বললেন, তোমরা তাকে বলতে দাও! শুনে রাখ; তোমাদের মাঝে এমন কথা বলার মানুষ না থাকলে তোমাদের কোন কল্যাণ হবেনা। আর এমন কথা না শুনলে আমাদেরও কোন কল্যাণ হবে না।(তারিখু ওমর লিইবনু জাওঝি- ১৭৬) প্রিয় পাঠক! বিনয়ীদের বর্ণিত দৃষ্টান্তে আমাদের ভাববার যথেষ্ট অবকাশ আছে। আমরাও মানুষ। আল্লাহ সেরা সৃষ্টি। কিন্তু আমরা কি বনয়ী? আমরা কি নিজেদের তুচ্ছজ্ঞান করি? রাত-দিনের আবর্তনে আমাদের কত ঘটনা ঘটে।সামান্য ব্যত্যয় হলে তুঘলকিকান্ড করে বসি।নিজেকে অনেক বড় কিছু আবিষ্কার করি। আসলে কি তাই? আমরাতো রঙিন বেলুনে ভর্তিবাতাসের মত। দর্শক দেখে আনন্দ পায়। কিন্তু যেকোন সময় তা ফেটে যায়। তারপর সে বেলুন খড়কুটোর মত পদদলিত হয়। পৃথিবীতে সব ছন্দেরই পতন হয়। অহংকার চূর্ণ হয়। তবে সফল তারাই যারা রবের সন্তুষ্টির জন্য বিনয়ী হয়। বিনয়ীদের মর্যাদা আল্লাহ দুনিয়াতে দান করেন। আর আখেরাতেও দিবেন নিরবছিন্ন পুরস্কার। আমরা যেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনয়ী হতে পারি। আমিন!