বিএনপিতে গণতন্ত্রের চর্চা নেই, আছে মনোনয়ন বাণিজ্য ; ইনাম চৌধুরী

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ১১ ২০১৯, ২০:৩৩

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হয়েছেন ইনাম আহমদ চৌধুরী। সম্প্রতি দৈনিক জাগরণকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তার বিএনপি ছাড়ার কারণ। বিএনপি প্রসঙ্গে বলেছেন, গণতন্ত্রের চর্চার নামে যেখানে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়, সেখানে কি গণতন্ত্রের চর্চা হতে পারে? বিএনপির সঙ্গে তার আস্থার সঙ্কট ছিল এটাও বলেছেন। জীবনের শেষ সময়ে দেশের কাজে সহযোগিতা করে যেতে চান বলেও জানিয়েছেন। দেশে-বিদেশে সরকারের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করা এই মানুষটি জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিকও। তার এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দৈনিক জাগরণ এর নিজস্ব প্রতিবেদক আল হেলাল শুভ

 

● শুরুতেই আপনার ছাত্র-জীবন সম্পর্কে জানতে চাই, বিশেষ করে কোন স্মৃতি এখনও আপনাকে এখনও তাড়িত করে ?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : শৈশব ও কৈশোর থেকেই সমাজ সচেতন ছিলাম। আপনা-আপনিভাবেই এটা আমরা মধ্যে বিধৃত হয়েছে। আমরা মা-বাবা ও পারিবারিক যে পট-ভূমিকা আছে সেটা আমার জন্য বিশেষ অবদান রেখেছে। ছাত্র থাকাকালে ‘প্রভাতি’ নামে একটা মাসিক পত্রিকা বের করেছিলাম আমরা। তখন প্রথম যে কিশোর গল্প সঙ্কলন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছিল সেটা ‘নতুন ছবি’ নামে আমরা তা প্রকাশ করি। সেটা ছিল একটা ছোটগল্প সঙ্কলন- যা পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম হয়েছিল। এর জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন অন্নদা শঙ্কর রায়সহ আরও গুণীরা। তাদের সঙ্গে আমাদের পত্রালাপ ছিল। বড় হয়েও সেই পত্রালাপগুলো আমাদের অক্ষুণ্ণ ছিল। কলেজে প্রবেশ করে আমি ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। এটা ১৯৫২-৫৩ সালের কথা। আমরা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় যোগদান করতাম। ঢাকায় তখন কলেজের সংখ্যা কম ছিল। তখন ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিরাও সেখানে যোগদান করতো। আমরা ঢাকা কলেজে একটা শহীদ মিনার স্থাপন করেছিলাম এবং ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সেখানে আমরা একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। ওই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবদুল গাফফার চৌধুরীর (প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট) সেই বিখ্যাত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ প্রথমবারের মতো গাওয়া হয়েছিল। শহীদ মিনার, সেই গান এবং ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। একই সঙ্গে আরও কয়েকজনকেও বহিষ্কার হয়েছিল। এ নিয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, আমিও লিখেছি। আমাদের বিরুদ্ধে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের জন্যে আন্দোলন শুরু হলো। সেই আন্দোলন বেশ দানা বেঁধে উঠলো। সেই আন্দোলনের সূত্র ধরে আমরা তদানীন্তন বিরোধী দলের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে আমরা দেখা করেছিলাম। তার সঙ্গে দেখা করে আমরা তার উপদেশ ও নির্দেশনা নিয়েছিলাম। তখনই আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। সেটাই ছিল তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমার মনে আছে, সেটা ছিল তদানীন্তন যে রমনা রেস্ট হাউস ছিল, সেখানে-গুলিস্তানের কাছে শহীদ সাহেব তার কক্ষেই ছিলেন। আমরা যখন গেলাম- আমি ছিলাম, গাফফার চৌধুরী ছিলেন আর আমাদের সহ-সভাপতি মশিউর হোসেন, তিনি সাংবাদিকও ছিলেন। আমার মনে আছে, তখন তিনি বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত হন নি। তিনি আমাদের ইন্সপায়ার করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, আমাদের দাবি অত্যন্ত ন্যায্য তবে এ জন্য আপনাদের সংগ্রাম করতে হবে। পরিষ্কারভাবেই তিনি এ কথা আমাদের বলেছিলেন। মুহিত সাহেব (সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত) তার একটি বইয়ে উল্লেখ করেছেন- ‘‘ তখন প্রথম অন্তপ্রাদেশিক যে একটা ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, সেটা আমাদের বহিষ্কার আদেশকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল।’’ পরে সেই বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। সে থেকেই আমি ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পরেছিলাম। তখন কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। এরপর আমি এস এম হল কেবিনেটের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেছি। একটা কেবিনেট আমি ও মুহিত সাহেব একসঙ্গে নির্বাচিত হয়েছিলাম, মুহিত সাহেব সহ-সভাপতি পদে আর আমি জয়েন্ট সেক্রেটারি পদে। আমি সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি। সংস্কৃতি সংসদে আমার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জহির রায়হান। তখন আমরা সংস্কৃতি সংসদের কার্যক্রমে নতুন একটা প্রাণ সঞ্চার করতে পেরেছিলাম। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে গঠনধর্মী, জনকল্যাণমুখী ও সমাজ সচেতনমূলক মুক্তবুদ্ধির সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল। ১৯৬০ সালে আমি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেই।

 

● রাজনীতিতে কিভাবে নিজেকে যুক্ত করলেন ?

ইনাম আহমদ চৌধুরী :প্রথম পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করে ওখানে প্রশাসনিক পদে খুব কম সময়ের মধ্যেই আমাকে সাব ডিভিশনাল অফিসার করা হলো সিরাজগঞ্জে। যাকে ‘ডেপুটি কমিশনার’ বলা হতো। সিরাজগঞ্জের মিউসিপ্যালটির চেয়ারম্যানও কিন্তু আমি ছিলাম। সিরাজগঞ্জে থাকাকালীন আমি বিয়ে করি। এরপর যশোরে ছিলাম, চট্টগ্রামে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্টেট ছিলাম। এরপর খুলনাতে জেলা ম্যাজিস্ট্যাট ছিলাম। তারপর অক্সফোর্ডে গিয়ে আমাকে ডেভলপমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়েছে। যখন বঙ্গবন্ধু আহ্বান করলেন, তখন তো সমস্ত জাতি তার পেছনে দাঁড়ালো। তখন সিভিল সার্ভিসের যে ইস্ট পাকিস্তান শাখা ছিল, ১১ মার্চ একটা মিটিং করে যার সভাপতি ছিলেন এস এন হাসান, যিনি অনেক সিনিয়র সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা ছিলেন তার সভাপতিত্বে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্ত ছিল- আমরা সিভিল সার্ভিসরা আমাদের জাতির প্রতি যে দায়িত্ব রয়েছে তাতে আমরা মনে করি, নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাবদলের যে সুযোগ এসেছে, সেই সুযোগে আমরা সহযোগিতা ও সমর্থন দেবো এবং এই হিসেবে আমরা মনে করি যিনি সংখ্যাগরিষ্টের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন, সংবিধান অনুসারে ক্ষমতা তারই লাভ করা উচিত। তখন বাংলাদেশ হয়নি, পাকিস্তানি আমল। এটা বঙ্গবন্ধুর গোচরে আনা হয়েছিল। আমার কাছে মনে হয়, পরবর্তীতে সিভিল সার্ভিসের প্রতি তিনি যে আস্থা দেখিয়েছেন, সেটার কারণ হয়তো এটা থাকতে পারে। সে সময় সিভিল সার্ভিসের অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন (দেশের জন্য) রুহুল কুদ্দুস সাহেব, এইচ টি ইমাম সাহেব, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাহাব উদ্দিন সাহেবসহ অনেকেই। দেশের বাইরে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে মুহিত সাহেব, শাহ এম এস কিবরিয়া সাহেব। বাংলাদেশ হওয়ার পরবর্তীকালে আমি প্রথম জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলাম। তখন থেকেই আমি সম্পৃক্ত হয়ে পড়লাম। ভারতে আমাদের প্রথম ডেলিগেশন টিম গেলাম জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে (১৯৭২), ৩ কিংবা ৪ তারিখে। যার নেতৃত্বে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ সাহেব, তখন তিনি নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। সেই ডেলিগেশনে ছিলেন ফারুক চৌধুরী, যিনি আমার বড় ভাই। আমি গেলাম বাণিজ্য সেক্টরের জন্য, এ ছাড়া হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোশারফ হোসেন, তিনিও গিয়েছিলেন। দিল্লি থাকাকালীনই আমরা খবর পেলাম, বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়েছেন। তিনি ঢাকা আসার পথে লন্ডনে যাচ্ছেন। আমার মনে আছে, জে এন দীক্ষিত দরজা খুলে আমাকে জানালেন- ‘বঙ্গবন্ধু ইজ ফ্রি’। এর পর আমি চীনের সঙ্গে কাজ করেছি, জাতিসংঘে কাজ করেছি। আমি লন্ডনে কর্মরত ছিলাম ৬ বছর। আমি বাংলাদেশে প্ল্যানিংয়ের (পরিকল্পনা কমিশন) সচিব ছিলাম। ইআরডিতে ছিলাম, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে ছিলাম, আমি ইসলামিক ডেভলপমেন্ট ব্যাংকেরও-(আইডিবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমি যখন আইডিবি’তে কর্মরত অবস্থায় জেদ্দাতে ছিলাম তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম সেখানে সফর করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার জেদ্দা সফর ছিল। তখন আমি সকলকে বললাম, দল-মত নির্বিশেষে তাকে আমাদের স্বাগত জানানো উচিত। তখন আমি এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সব দলের সবাইকে ডেকে নিয়ে আমি বলেছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী আসছেন। আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সহযোগিতায় আমি সব কিছুর আয়োজন করেছিলাম। এরপরে যখন আমি দেশে ফিরে এসে রাজনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ করতে চাইলাম, তখন আমি অপজিশনে (বিএনপি) যোগ দিলাম। কিন্তু আমি যখন অপজিশনে (বিএনপি) গেলাম তখনও তার (শেখ হাসিনা) প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমার সব সময়ই ছিল। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করেছেন, সব সময় আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কথা উচ্চারণ করেছি। বলেছি, তার নেতৃত্ব আমাদের রাখতে হবে, তিনি জাতির জনক। তিনি শুধু জাতির জনকই নন, তিনি বাঙালি জাতিস্বত্বার সৃষ্টাও। আমি সব সময়, গণতন্ত্রের চর্চা করতে চেয়েছি কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যখন আমি দেখলাম, গণতন্ত্র নিয়ে বাণিজ্য করতে তখন আমার কাছে এটা অদ্ভুত ব্যাপার বলে মনে হলো। গণতন্ত্রের চর্চার নামে যেখানে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়, সেখানে কি গণতন্ত্রের চর্চা হতে পারে? এটা আমাকে গভীরভাবে আঘাত করলো। তখন আমার মনে হলো, আমি কিসের পেছনে থাকবো। তখন আমি দেখতে পেলাম যে, জননেত্রী শেখ হাসিনা চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশকে উন্নত স্তরে এগিয়ে নিতে, কিছু ভুল-ত্রুটি হয়তো থাকতে পারে। তখন যেহেতু আমি ত্যাগ (দল) করলাম, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে সমর্থন জানাতে চাই। তার পেছনে থাকতে চাই, তার এই অগ্রযাত্রায় সামিল হতে চাই। এ জন্য কোনও শর্ত নেই, কিছু নেই, আমার কথা হচ্ছে উন্নয়নের পক্ষে থাকা আমার দায়িত্ব। আপনি জানতে চাইলেন, কেন আমি আওয়ামী লীগে যোগ দিলাম। আমি দেখলাম যে, ওখানে (বিএনপি) ওই সোনার হরিণ সেটা হচ্ছে না। এখানে (আওয়ামী লীগ) আমাদের দেশকে গঠন করার জন্য তিনি যে আগ্রহ নিয়ে শুরু করেছেন- তাকে সমর্থন জানানোই আমার উচিত হবে। তারই জন্য আমি তখন যোগদান করেছি (আওয়ামী লীগে)।

ইনাম আহমদ চৌধুরী। জন্ম সিলেটে, ১৯৩৭ সালের ২৯ জুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আইন এবং পরবর্তীতে অক্সফোর্ডে স্নাতকোত্তর অধ্যায়ন করেন। ১৯৫২-৫৩ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্র-সংসদের জেনারেল সেক্রেটারি থাকাকালে শহীদ মিনার নির্মাণ ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্যে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। ছাত্রজীবনে মাসিক প্রভাতী ও ছোটগল্প সংকলন ‘নতুন ছবি’ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে মাসিক যমুনারও সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬০ সালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগদান করেন। ব্যাংককে জাতিসংঘের ‘এস্কাপ’ কমিশনের সেক্রেটারি, আই.ডি.বি’র ভাইস প্রেসিডেন্ট। লন্ডনস্থ ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আই.এম.ও) নির্বাচিত সভাপতি। লন্ডনে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে থাকাকালে লন্ডনস্থ অর্থনৈতিক প্রতিনিধিবর্গের অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। ‘ই.আর.ডি’র সচিব হিসেবে বিশ্বব্যাংক ও এ.ডি.বি’র বিকল্প গভর্নর, প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় সরকারের প্রাইভেটাইজেশন কমিশনারের চেয়ারম্যান। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদানের জন্যে রাশিয়া থেকে ‘লিজিয়ন অব অনার’ প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত ভুবনে আছেন সহধর্মিণী নাগিনা এবং পুত্র নাদিম ও কন্যা ইনা ফেরিয়েল। পরিব্রজন তার একটি নেশা। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশ ভ্রমণ করার বিরল সুযোগ তার হয়েছে। তিনি একজন ভাষাসংগ্রামী।

শুধু মনোনয়ন বানিজ্য নয়, আরও অনেক কারণ রয়েছে। কতগুলো বিষয় আমার কাছে পছন্দ হতো না। যেমন- ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করা। এটাকে আমি কখনও সমর্থন করতে পারি নি। আসলে বিএনপির সঙ্গে আমার একটি আস্থার সঙ্কট ছিল। যার জন্য ২০ বছর ওখানে থেকেও, প্রথম থেকেই আমি দলের সহ-সভাপতি পর্যায়ে, দলের উপদেষ্টা, আমি দলের ফরেন রিলেশন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম কিন্তু আমি মনোনয়ন পাইনি। এটা আসলে আস্থার সঙ্কট। নিশ্চয়ই আমার ওপর আস্থা নেই। আস্থা থাকলে আমি মনোনয়ন পেতাম। গত ৩টি নির্বাচনে আমি সিরিয়াসলি অংশগ্রহণ করতে চেয়েছি কিন্তু মনোনয়ন পাইনি। দলের ভেতরে যে কেউ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না তা কিন্তু নয়। এমন কেউ নয়, যে আমার সমকক্ষ কিংবা কাছাকাছি ছিলেন। তবে আমি তাদের (বিএনপি) দোষ দেবো না। আস্থা আমার অর্জিত হয় নি। সুতরাং আমার মতামত, রীতি-নীতি, কথা-বার্তার জন্য চাল-চলন ও সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শনের জন্য হয়ত আস্থার উপযুক্ত বিবেচিত হয়নি। আমার গ্রহণযোগ্যতা অন্য জায়গায় থাকতে পারে কিন্তু ওখানে হয় নি। যখনই আমি সন্দাহাতীতভাবেই বুঝতে পারলাম সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না। সেখানে আমার থেকে কোনও লাভ নেই। বরং জীবনের শেষ সময়ে আমি দেশের কাজে সহযোগিতা করে যেতে চাই।

● আওয়ামী লীগের রাজনীতির কোন বিষয়টি আপনার ভাল লাগে ?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : আওয়ামী লীগ জনমুখী একটি রাজনৈতিক দল। জনসম্পৃক্ততা রাখার যে চেষ্টা সেটা এই দলে আছে। সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে, তা হয়তো নয়, কিন্তু একটা চেষ্টা রয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও এ বিষয়টি বার বার বলেছেন। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে- আওয়ামী লীগ কিন্তু হঠাৎ করে তৈররি হয় নি, ফরমায়েশি দল নয়। বঙ্গবন্ধু কিন্তু এই দলের জন্য মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে দল গঠনে মনোযোগী হয়েছিলেন। ‘জনমুখী, জনসম্পৃক্ততাই আমার কাছে মনে হয় আওয়ামী লীগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার। তারপর দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাও কিন্তু কোনও ষড়যন্ত্র করে ওখানে সভাপতি হননি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবেও হননি। ৭৫ সালের সেই ট্র্যাজেডির পরে অনেক বছর পর্যন্ত তাকে কষ্ট করতে হয়েছে। তাকে নিজে কাজ করে প্রত্যেকটা মুহূর্তে এগিয়ে যেতে হয়েছে।

● আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির মধ্যে গুণগত পার্থক্য কি?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : গুণগত পার্থক্য আমার কাছে যেটা মনে হয়, সেটা হলো জনভিত্তি। জনভিত্তিক আন্দোলনটা কিন্তু বিএনপির গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি। তার বিভিন্ন কারণ হতে পারে। আমি নিজে দেখেছি, এই যে মনোনয়নের কথা বললাম। এই মনোনয়নে বাণিজ্যিক কারণ ছাড়া কোনও কারণ দেখা যায় নি। দ্বিতীয় ব্যাপার হলো- বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ, অন্তর্দ্বন্দটা কি কারণে ঘটছে এটা কিন্তু কেউ বলতে পারছে না। দলের কোনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে দলের স্ট্যাডিং কমিটি বলছে, আমরা জানি না, মহাসচিব বলছে আমরা জানি না। রাজনীতি গণতান্ত্রিক চর্চার একটা ব্যাপার। আওয়ামী লীগের জনসম্পৃক্ততা অনেক বেশি। আওয়ামী লীগ যেটা সফলভাবে করতে পেরেছে সেটা হলো, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তার স্পিরিট ও জীবনকারী শক্তি তারা সফলভাবে দলের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছে।

 

● একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয় ও বিএনপির ভরাডুবি- আপনি কিভাবে দেখেন?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, এখানে নির্বাচন কমিশন তাদের দায়িত্বটা আরও ভালভাবে পালন করতে পারতো। তাদের পারা উচিত ছিল। নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এবং একজন নির্বাচন কমিশনার নিজেই এ সকল বিষয় বলেছেন। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বটা কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ভারতেও কিন্তু এবার নির্বাচন কমিশন নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে।

● দেশের উন্নয়নে আপনার কী কী পরামর্শ আছে?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : বাংলাদেশকে এখন জাতিগতভাবে ইউনাইটেড হতে হবে। জাতীয় স্বার্থে যেমন- তিস্তা চুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের একমত হতে হবে। এখানে যদি আমরা সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেই, তবে শুধু আমাদের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্যই অমঙ্গলকর হবে। এখন কিন্তু বাংলাদেশ বলিষ্ট একটা কণ্ঠ। এটা নিয়ে আমি গর্ববোধ করতে পারি, যে সুরের সঙ্গে আমি সুর মেলাতে চাই।

● রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আপনার মত কি?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। আমাদের সামর্থ ছিল না ১০ লাখ লোককে নেয়ার। তার সঙ্গে আমরা বলেছি, চিরকালের জন্য নয় সাময়িকভাবে তাদের নেয়া হবে। মিয়ানমারকে বুঝতে হবে, এটা তাদের দায়িত্ব এ সমস্যা তারা সৃষ্টি করেছে। এ বিষয়টি আমরা পৃথিবীর সামনে আমাদের সীমিত সামর্থ দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছি। এখানে চীন, ভারত, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেকের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী সকলের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

● প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ চীন সফর নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সফল একটা সফর করে এসেছেন। অত্যন্ত ব্যালেন্সন্ডভাবে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন। চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কিন্তু অগ্রগতি হচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে যদি আপনি দেখেন, তাহলে দেখবেন- চীনের সঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রী খুবই সুবিবেচনার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। চীন সম্প্রতি যে আশ্বাস দিয়েছে আমার কাছে তা অর্থবহ বলেই মনে হচ্ছে। তারা যথেষ্ট চেষ্টা করবে বলেই মনে হচ্ছে।

● চীন সহায়তা করলেই কি রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান হবে?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : চীন সহায়তা করলেই হয়তো সঙ্কটের সমাধান হবে না। আগেও আমরা দেখেছি, তারা তো অনেক পরিকল্পনা করে রাখাইনদের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। তাদের মিলিটারি অ্যাকশন দিয়ে বের করে দিয়েছে। এখানে আমাদের যে দায়িত্ব তা সুচারুরূপে সম্পন্ন হচ্ছে বলেই আমার মনে হয়। তবে শুধু চীন হলেই হবে না, ভারতের সমর্থনও আমাদের লাগবে। আমার কাছে মনে হয় সমর্থন পেলে সমস্যার সমাধান হবে।

● এখন কিভাবে রাজনীতি করতে চান?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বা আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে আমার যে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে- উন্নয়নের ব্যাপারে, কূটনীতির ব্যাপারে কোথায় যদি সুযোগ আসে সেখানে আমি যদি কনট্রিবিউট করতে পারি তাহলে নিজেকে সম্মানীয় ও সৌভাগ্যবান বলে মনে করবো। ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনও কিছু চাওয়া-পাওয়া নেই।

● আধুনিক বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান?

ইনাম আহমদ চৌধুরী : আধুনিক বাংলাদেশকে আমি পৃথিবীর বুকে অগ্রজ জাতি হিসেবে দেখতে চাই। চীনকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার অনেকগুলো তফাৎ আছে, কিন্তু চীন এগিয়ে গেছে এই যে প্রযুক্তিগত এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রজ দেখতে চাই। দ্বিতীয়ত- এই যে বাংলাদেশ রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, মুক্তি সংগ্রামে যে মূল্যবোধগুলো ছিল তা যেন রক্ষা পায়। তৃতীয় আমি চাই, সামাজিক ব্যবধান যেন ঘুচে যায়। এ জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমাদের যে সামাজিক অবক্ষয় হয়েছে এটা স্বীকার করতেই হবে। তার জন্য আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের আরও সচেতন হতে হবে।

সৌজন্যে: দৈনিক জাগরণ