বাগদাদি তরুণের সঙ্গে এক প্রহর

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

এপ্রিল ১৮ ২০১৯, ২০:০৬

তাওহিদুল ইসলাম। মাদীনাতুন নাসর, কায়রো থেকে…

মসজিদুল আজহারের ‘আলফিয়্যাহ ইবনে মালিক’-এর দরস থেকে বেরিয়ে মসজিদের আঙিনায় হাঁটছিলাম আর কারুকার্য খচিত চারপাশের দেয়াল মুগ্ধনয়নে দেখছিলাম৷
হাঁটতে হাঁটতে আঙিনার উত্তরপাশে এসে চব্বিশ- পঁচিশ বছরের সুদর্শন এক তরুণের মুখোমুখি হলাম৷ হালকা গঠনের৷ লম্বায় পাঁচ ফুট নয়-দশ ইঞ্চির কম হবে না৷ তাকে দেখেই অনুমান করে নিলাম সে মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশের অধিবাসী হবে৷ পরে আমার ধারনা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল৷
সে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ডান হাত দিয়ে একটি কিতাব বুকে চেপে ধরে আছে৷ লক্ষ্য করে দেখতে পেলাম সেটি মুখতাসারুল কুদুরির প্রসিদ্ধ শরাহ ‘আল লুবাব ফি শরহিল কিতাব’৷ তার কিতাব বহনের ধরনই বলে দিচ্ছিলো, কিতাবের সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে, তার মাঝে আসবাবে ইলমের কদর রয়েছে৷

‘আল লুবাব’ আমার অনেক প্রিয় একটি কিতাব৷ যখন মুখতাসারুল কুদুরি পড়তাম, তখন কুদুরির কোনো মাসআলার দলিল ও ইল্লত না বুঝলে সামনে এগোতাম না ৷ একটি মাসআলার দলিল বা ইল্লত না পেলে পেরেশান থাকতাম ৷ তখন ‘আল লুবাব’ আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে ৷ কখনও ‘আল লুবাব’-এও পেতাম না, তখন হিদায়া খুলতাম ৷ আমার মুখতাসারুল কুদুরি ও আল লুবাব সবসময় একসঙ্গেই থাকতো৷

হানাফি মাজহাবের এ কিতাবটি দেখে মনে বেশ কৌতূহল সৃষ্টি হলো৷ সালাম দিয়ে সৌজন্যতাস্বরূপ মুসাফাহা সেরে জিজ্ঞেস করলাম—
: আপনি কোত্থেকে এসেছেন?
ইরাক থেকে৷
: ইরাকের কোন এলাকা?
বাগদাদ৷

: আপনি কোত্থেকে এসেছেন? (আমাকে প্রশ্ন করলো)৷
বাংলাদেশ৷

: বাগদাদে তো ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মাকবারা আছে, তাই না? (জিজ্ঞেস করলাম)৷
জী৷
: কখনও কি তাঁর মাকবারা জেয়ারত করেছেন?
জী, বেশ কয়েকবার তার মাকবারা জেয়ারত করেছি৷ তাঁর মাকবারা থেকে আমার বাড়ির দূরত্ব মাত্র ১৫০ কিলিমিটার৷ তাছাড়া আমি হানাফি৷
: আচ্ছা, তাই নাকি! আমিও তো হানাফি৷

প্রথমে সৌজন্যতাস্বরুপ তার সঙ্গে শুধু মুসাফাহা করেছিলাম৷ কিন্তু যখন জানতে পেলাম, সে ইমাম আজম (রহ.)-এর এলাকার বাসিন্দা, আবার হানাফি, তখন বুকে জড়িয়ে মুআনাকা করে নিলাম৷

: আপনি তো ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মাকবারায় গেছেন ৷ তাঁর মাকবারা বাগদাদের ঠিক কোথায়? কেমন দেখেছেন মাকবারাটি? (প্রশ্ন করলাম)৷
বাগদাদের ‘আল আজমিয়্যাহ’ নামক এলাকায় দাজলা নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত মাকবারাটি৷ ঐ এলাকার নামটি ইমাম আজম (রহ.)-এর নামেই করা হয়েছে৷ একে ‘মাহাল্লাতু ইমাম আজম’ও বলে৷ ইমাম আজম (রহ.)-এর কবরের পাশে একটি মসজিদ রয়েছে৷ যাকে ‘জামিউ ইমাম আল আজম’ বলা হয়৷ এর সঙ্গেই লাগোয়া ‘জামিআতু ইমাম আল আজম’ নামে একটি ইউনিভার্সিটি রয়েছে৷ অনেক প্রাচীন ও বিশাল ইউনিভার্সিটি সেটা৷ সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের অনেক ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করে৷

[জামিআতু ইমাম আল আজম বিশ্বের চতুর্থতম প্রাচীন একটি ইউনিভর্সিটি৷ এর প্রতিষ্ঠাকাল ৪৫৯ হিজরি মোতাবেক ১০৬৬ খৃস্টাব্দে৷ বিশ্বের সর্বপ্রথম ইউনিভার্সিটি হলো তিউনেশিয়ার ‘জামিআতুজ যাইতুনিয়াহ’৷ যার প্রতিষ্ঠাকাল ৭৩৭ খৃস্টাব্দ৷ দ্বিতীয়তম প্রাচীন ইউনিভার্সিটি হলো মরক্কোর ফেস নগরীতে ‘জামিআতুল কারওয়াইয়্যিন’৷ যার প্রতিষ্ঠাকাল ৮৫৯ খৃস্টাব্দ৷ তৃতীয়তম প্রাচীন ইউনিভর্সিটি হলো মিশরের ‘জামিআতুল আজহার’৷ যার প্রতিষ্ঠাকাল ৩৬৯ হিজরি মোতাবেক ৯৭২ খৃস্টাব্দ ৷]

: আপনি এ কিতাবটি হাতে এখানে কেনো? (বললাম)
আজ এই হলে কিতাবটির দরস হওয়ার কথা ছিলো৷ (চত্বরের উত্তর দিকের একটি হলের দিকে ইশারা করে বললো)৷

: কে দরস দেন?
আজহারের একজন ডক্টর এই কিতাবটি সামনে রেখে সপ্তাহে দুদিন ফিকহে হানাফির দরস দেন৷ আজ দরস হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু কোনো কারণে উস্তাদ আসতে পারেন নি, তাই আজ দরসও হবে না ৷

আজহার মসজিদ কেবল একটি মসজিদই নয়; বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বটে৷ এই মসজিদুল আজহারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের চতুর্থতম প্রাচীন ইউনিভার্সিটি জামিআতুল আজহার৷ ফিকহ, হাদিস, উসুলে হাদিস, তাফসির, নাহব, সরফ, বালাগাতের দরস হয়৷ এসব দরস প্রদান করেন আজহারের বড়ো বড়ো ডক্টরগণ৷ দরসগুলোর মানও অনেক উন্নত৷
উন্মুক্ত এসব দরসে দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন বয়সের ইলমপিপাসু মানুষ উপস্থিত হন৷ সেও হয়তো কায়রো কোনো এলাকা থেকে এসেছিলো মাত্র একটা দরসের জন্য৷ দরস না হওয়ায় পেরেশানির ছাপ তার চোখেমুখে ফুটে উঠছিলো৷

.
এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করলো—

: আপনি মিশরের কোন প্রতিষ্ঠানে পড়েন?
জামিয়াতুল আজহারে৷
: কোন ক্লাসে?
দিরাসাতুল ইসলামিয়ার প্রথম বর্ষে৷
: আপনি কোথায় পড়েন?
আমি মাত্র কিছুদিন হলো দেশ থেকে এসেছি৷ আজহারের কুল্লিয়াতে ভর্তি হবো৷ কার্যক্রম চলছে৷

হঠাৎ তার মুঠোফোন বেজে ওঠলো৷ কিছুক্ষণ কার সঙ্গে কী যেনো কথা বললো৷ এরপর আমায় বললো—
: আমার রুমমেট কল দিয়েছে৷ আমাকে ডাকছে৷ সেও এসেছিলো দরসে৷ সে এখন মসজিদের বাইরে আছে৷ বাসায় ফেরার জন্য কল করেছে৷
ওকে, ওকে৷
: আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে অনেক আনন্দিত৷ (আমি বললাম)
আমিও৷

: আসসালামু আলাইকুম৷
ওয়াইকুম আসসলাম৷