বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়া ছিলেন সেই সময়ের এরদোয়ান

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ৩০ ২০২১, ১৫:১৬

সৈয়দ শামছুল হুদা: ১৯৮১সালের ৩০মে, আমার বয়স তখন ৮। এখনো পরিস্কার মনে আছে, সেদিন সেই গ্রামের নিভৃত পল্লিতে একজন রাষ্ট্রনায়কের জন্য মানুষের কী কান্না। রেডিওতে যখন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হয়, সাথে সাথে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে কান্নার রোল। সারাদিন রেডিওতে কুরআন তেলাওয়াত, হামদ ও নাত প্রচারিত হতে থাকে। জিয়ার প্রতি মানুষের ভালোবাসা তখনই দেখেছি। এরপর ১৯৮১সালের ১৫নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ৬৬% ভোট পেয়ে যখন বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন তখনও গ্রামের সেই মেটো পথে জনতার বিপুল বিজয় উল্লাস দেখেছি। কয়েকটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ সড়কে নেমে এতটাই আনন্দ প্রকাশ করেছিল, যা আজো আমার চোখে ভাসে। জিয়াউর রহমানকে মানুষ কতটা ভালোবাসে, সেটা তখনই কিছুটা অনুভব করেছি।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এমনই একটা পরিবেশে বাংলাদেশের ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভুত হয়েছিলেন যেই সময়টায় বাংলাদেশে মিডিয়ার স্বাধীনতা সম্পুর্ণরূপে নিয়ন্ত্রন করা হয়েছিল। ৪টি সরকারী পত্রিকা বাদে সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দেশে একটি মাত্র দল বাকশাল বাদে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল। সকল প্রকার ধর্মীয় রাজনীতি ছিল নিষিদ্ধ। বাক স্বাধীনতা, দল করার স্বাধীনতা, ধর্মীয় রাজনীতির স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তাজ উদ্দীন আহমদ ভারতের সাথে ৭দফা অসম চুক্তি করে দেশকে পরনির্ভরশীল করার আয়োজন করে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেই চুক্তিকে অকার্যকর করে রেখেছিলেন, তদুপরি একটি ভয় বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় মানুষের মধ্যে কাজ করছিল। ৭নভেম্বর এর পুর্বে মেজর খালেদ মুশাররফদের পক্ষে ভারতীয় সমর্থন ইত্যাদি জনমনে আরো ভীতি ছড়িয়ে দিয়েছিল, সেই রকম একটি লোমহর্ষক পরিবেশে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতার মঞ্চে এসে হাজির হন। তিনি ছিলেন ভাগ্যের বরপুত্র। নানা ঘটনা পরস্পরায় তিনি বাংলার মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে দেশে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, ভারত নির্ভরতা কাটিয়ে উঠে, দেশে বহুদল গঠনের পথ উম্মুক্ত করে দেন। সকল প্রকার ধর্মীয় রাজনীতির ওপর বাধা- নিষেধ তুলে নেন। ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছাকাছি যেতে থাকেন। বিভিন্ন মাদ্রাসার বড় বড় মাহফিলগুলোতে হাজির হতে থাকেন। ময়মনসিংহের অন্যতম সুদূর পল্লিগ্রামের মাদ্রাসা জামিয়া আরাবিয়া আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে উপস্থিত হয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের নার্ভটা খুব ভালো করে অনুভব করতে পেরেছিলেন। ক্ষমতায় আসার অল্পদিনের ভিতরে তিনি শুধু বাংলাদেশেই নয় মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধ করতে তিনি তৎপর হন। প্যালেস্টাইন যুদ্ধে ভুমিকা রাখতে সক্রিয় হন।

আজকের বিশ্বে রজব তাইয়েব এরদোয়ান যেভাবে একের পর এক মুসলমানদের আশা-আকাঙ্খা পূরণে সক্রিয় ভুমিকা রাখছেন, ঠিক সেইভাবেই সেই সময়ের পরিস্থিতিতে তিনিই যেন হয়ে উঠেছিলেন আজকের এরদোয়ান। বাংলাদেশকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মুসলিম বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হন। মুসলিম বিশ্বের সাথে অগ্রাধিকারমূলক সম্পর্ক তৈরিতে তিনি সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই একটি মুসলিম দেশ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হন।

একটি দেশের সংবিধান সেই দেশের প্রথম পরিচয় বহন করে। তিনি সংবিধানের গুরুত্ব বুঝতে পেরে সংবিধানে এমন কিছু ধারার সংযোজন করেন যা ছিল প্রতিটি মুসলমানের একান্ত চাওয়া। সংবিধানের শুরুতেই তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম উল্লেখ করার পাশাপাশি, “আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে সকল কর্মকান্ডের মূল ভিত্তি” এমন একটি তাৎপর্য পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এছাড়া তিনি সংবিধানের চার মূলনীতির মধ্যে সমাজতন্ত্রের একটি চমৎকার সহনশীল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের চপেটাঘাত করেনে। বিশেষভাবে সংবিধানে উল্লেখ করেন, মুসলিম বিশ্বের সাথে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হবে। এসব করে তিনি বাংলাদেশের মুসলমানদের মনের গভীর রেখাপাত করতে সক্ষম হন। ফলে তিনি ক্ষমতার অল্প দিনের ভেতরেই বিপুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য। অভিশপ্ত গোষ্ঠীর সংঘবদ্ধ চক্র তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে গভীর ষড়যন্ত্র করে। এবং সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়।

বাংলাদেশকে ইসলামের সাথে মুসলিম বিশ্বের কাছে গ্রহনযোগ্য করতে জিয়াউর রহমান এর অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আজকের এরদোয়ানকে যখন কোন মসজিদে দেখি, যখন কোন নির্যাতিত মুসলিম জনপদের পক্ষে কথা বলতে দেখি, তখন আমরা খুবই খুশি হই। এরদোয়ান এত ক্ষমতাশালী, এত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত কামালীয় সংবিধানকে সংশোধন করতে সক্ষম হননি। কিন্তু জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই সংবিধানে ইসলামের সাথে যে সকল বিষয় সাংঘর্ষিক ছিল তার অনেকটাই দূরীভূত করে মুসলমানদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে এমন একটি সংবিধান রচনা করতে সক্ষম হন। এটাও ছিল তাঁর একটি বড় অপরাধ(!)।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করতে, তরুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে নানাবিধ কমর্সূচী গ্রহন করেন। মেধাবী তরুনদের নিয়ে হিযবুল বাহার নামক জাহাজে করে সমুদ্র সফর করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের ডান-বাম সকল শক্তিকে একই ছাতার নীচে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। যে কোন প্রকার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভাজন নীতি এড়িয়ে চলতে সক্ষম হন। তাঁর হাত ধরেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া আওয়ামীলীগ নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। বাকশাল বিলুপ্ত হয়ে যায় অটোমেটিক। যার সুফল ভোগ করছে আজকের আওয়ামীলীগ। আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযোগ করে দেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীরা দেশে ফিরে আসার সুযোগ পায়। সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ স্বাধীনভাবে রাজনীতি করার অধিকার ফিরে পায়। মিডিয়া জগতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যাদের উপকার করে গেছেন তারাই আজ তার প্রতি বেশি অবিচার করছে। মিডিয়া চরমভাবে বিএনপি বিদ্বেষী ভূমিকা রাখছে। ইসলামী দলগুলোও তাকে ভুলে গেছে। রাজনীতি করার অধিকার কে ফিরিয়ে দিলো সে কথাটি তাদের স্মরণেই আসে না। ৭১থেকে ৭৫পর্যন্ত দেশে কোন প্রকার ইসলামী রাজনীতি করার অধিকার ছিল না। উপরুন্তু রক্ষীবাহিনীর আদর-আপ্যায়নতো ছিলোই। অথচ আজ আমরা সেই মানুষটিকে ভুলেই গেছি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক জাতীয় নেতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান যেমন অবিস্মরনীয় নেতা, মরহুম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী যেমন রাজনৈতিক পুরোধা, তেমনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর অবদানকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আজকের নতুন প্রজন্ম জাতীয় নেতাদেরকে মূল্যায়ণ করতে ভুলে গেছে। কোন পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসেছিলেন, তিনি দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কী করেছিলেন সেটা দেশের সাধারণ মানুষতো দূরের কথা, তাঁর দলের লোকেরাই মনে হচ্ছে ভুলে গেছে। জিয়াউর রহমান কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন সেই আদর্শ থেকে বর্তমান বিএনপিও দূরে সরে গেছে। আর এর খেসারত তারাই শুধু দিচ্ছে না, দেশবাসিকেও দিতে হচ্ছে। বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়েও বিএনপি শুধুমাত্র রাজনৈতিক দেউলিয়াদের পেছনে মনযোগ দিয়ে বিএনবি আসিফ আকবরের ভাষায় “একটি ক্লাব সংগঠনে” পরিণত হয়েছে।

ইসলামী মূল্যবোধই জিয়াউর রহমান এর সফলতার অন্যতম কারণ ছিল। অথচ আজকের বিএনপি নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার শ্লোগান দিতেও লজ্জাবোধ করে। মিছিলে নেমে আজকের বিএনপি আদর্শগতভাবে এতটাই দেওলিয়া সংগঠনে পরিণত হয়েছে যে, “জিয়া, জিয়া, খালেদা খালেদা” ছাড়া আর কোন শ্লোগানই খুঁজে পায় না। অথচ জয়বাংলার মোকাবেলায় তাদের একটি শক্তিশালী শ্লোগান দরকার ছিল। আর সেটা হতে পারতো নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবার ধ্বনি। আর এটা হতে পারতো জিয়াউর রহমান এর চিন্তা-চেতনার সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পর্কযুক্ত।

আজকের এই দিনে বাংলাদেশের অন্যতম সফল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। আর বিএনপির প্রতি অনুরোধ থাকবে, এখনো সময় আছে, বাম-রামদের পিরিতি ছেড়ে শহীদ জিয়ার ইসলামী মূল্যবোধের আদর্শে ফিরে আসো। জনগণ আবার তোমাদের মাথায় তুলে নাচবে, যেটা ১৯৮১সালের ১৫নভেম্বর নির্বাচনের পর দেখেছিলাম। অন্যথায় তোমরা হারিয়ে যাবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।