ফারাবী ও তাঁর জেলজীবনের কিছু কথা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ০৩ ২০২১, ১৪:২০

মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক: কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার -৪ এর পাঁচ তলায় থাকতাম আমি ৷ বাইরে সাক্ষাতে কেউ এলে সাক্ষাৎ শেষে পাঁচতলায় উঠার সময় চার তলার পূর্ব-পশ্চিম দুদিকের বন্দিদের সাথেই কিছু কথোপকথন হতো ৷ চারতলার পশ্চিম দিকে একটা ছেলে খুব অনুনয় বিনয় করে তার মুক্তির ব্যাপারে চেষ্টা করতে বলতো ৷ নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে দুটি তথ্য দিত ৷ ব্লগার রাজিবের জানাযার ইমামের হুমকি দান আর হাটহাজারী মাদরাসার মুনির সাহেব তাকে চিনে ৷ এই দুটি তথ্য দিয়ে নিজের নাম ফারাবী পরিচয়ের মাধ্যমে তার মুক্তির জন্য একটু চেষ্টা করতে খুব কাকুতি-মিনতি করত ৷ আমি তখন এই তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক জগৎ সম্পর্কে তেমন অবগত নই ৷ আর আমার পরিবার ও মাদরাসার লোকজন ছাড়া আর কারো সাথে তেমন একটা যোগাযোগও নেই ৷ ভিতরে আটক হেফাজতের অন্যান্য আসামীদের জন্য যেমন টুকটাক কিছু করার প্রয়াস পেয়েছি, ফারাবীর জন্যও ততটুকুই করেছি ৷ পরিচয়ের প্রভাব ব্যবহার করার যোগ্যতা আমার নেই ৷

আমরা যারা এক ব্লকে একসাথে থাকতাম, খাওয়া- দাওয়াসহ কিছু সুন্দর ব্যবস্থা সেখানে ছিল ৷ আমাদের ব্লক থেকে হেফাজতের বন্দিদের মুক্তিতে কিছু সিট খালি হলে অন্যান্য ব্লক থেকে নতুন কিছু লোক আনার সুযোগ তৈরি হলো ৷ তখন ঐ জমাদারকে জনপ্রতি পাঁচশত করে টাকা দিয়ে পছন্দমত কিছু বন্দি আমাদের ব্লকে আনা হলো ৷ নবাগত ঐ বন্দিদের মধ্যে এই ফারাবীও ছিল ৷
পুরো নাম শাফিউর রহমান ফারাবী ৷ খুব ছোট থাকতেই মাকে হারিয়েছে ৷ এরপর ওর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন ৷ এখন ওর বাবাও নেই ৷ তিনিও মারা গেছেন অনেক দিন হলো ৷ থাকার মত আছে ওর শুধু ঐ এক সৎ মা আর বৈমাত্রেয় এক বোন ৷ এই তিনজনের সংসার ৷ চাচারা আছেন, কিন্তু তেমন যোগাযোগ নেই ৷ বোনটা সিলেট মেডিকেলে পড়ার সুবাদে পরিবার থাকে সিলেটেই ৷ ঐ এক “মা”ই ওর অভিভাবক ৷ বেচারী মহিলা মানুষ ৷ খুবই সরল ও অবলা ৷ তিনিই ওর জন্য যা করার, করেন ৷

ফারাবী ছেলেটার ব্যপারে আমার পর্যবেক্ষণ হলো, খুবই সরল ও আবেগী একজন তরুন ৷ ইসলামের প্রতি ভালোবাসা আছে ৷ আছে আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি অগাধ প্রেম ৷ তবে বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলের রয়েছে প্রচন্ড অভাব ৷ আর সবচেয়ে বড় সমস্যা কারও কথাই মানতে চায় না ৷ ওর মায়ের সাথে ওর বিষয়ে আমার একাধিকবার কথা হয়েছে ৷ বেচারি ওকে নিয়ে পড়েছেন এক মহা বিপাকে ৷ আমাকে অনেক অনুরোধ করেছেন, ওকে একটু বুঝানোর জন্য ৷ কিন্তু ওর মধ্যে সিরিয়াসনেস বলতে কিছু আসেই না ৷

তাকে আগের বার যখন গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছিল, প্রথমে তো বিশাল একটা কিছু মনে করেছিল ডিবির লোকজন ৷ কিন্তু দুইটা বাড়ি মারতেই শিশুদের মতো এমন চিৎকার শুরু করেছিল, তাতে গোয়েন্দাদের ওকে বুঝতে সময় লাগেনি ৷ দুটো সাধারণ মারই সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই ৷ কতটা বেখেয়ালী মানুষ যে ও তা কল্পনাও করা যায় না ৷ আমরা ওকে জিজ্ঞাসা করতাম, তোমার জীবনের লক্ষ কী? ও তখন বলতো, আমার জীবনের একটাই লক্ষ, জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়া ৷ আর কোনো দিন জেলখানায় আসতে চাই না ৷
খামখেয়ালিপনা থেকেই আল্লামা আহমদ শফী সম্পর্কে আজেবাজে মন্তব্য করে ৷ এগুলো বুঝার যোগ্যতাও ওর নেই ৷ আমার সম্পর্কেও একবার একটা স্ট্যাটাসে যা তা লিখেছিল ৷ আমি ওকে ইনবক্সে জিজ্ঞাসা করলে আমার কাছে আবার দুঃখ প্রকাশ করেছিল ৷
আসলে ফারাবী হলো আবেগ প্রবণ সরল প্রকৃতির একজন ঈমানদার মেধাবী তরুন ৷ জঙ্গিবাদ ইত্যাদির কাজ করার যোগ্যতা ওর নেই ৷ ও শুধু এই বুদ্ধিবৃত্তিক কিছু লেখালেখিই করতে পারে ৷
RAB বা গোয়েন্দারা অযথাই জিজ্ঞাসাবাদ করবে ৷ তারাও দুই কথা ওর সাথে বললেই বুঝতে পারবে ও যে কতটা সরল ! আর তারা জঙ্গী মনে করে কেমন বোকা একটা মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়েছে ৷
আমার মনে হয়, গোয়েন্দাদের কাছেও এই ইনফরমেশনগুলো আছে ৷ ও যা বলার এই ফেইসবুক আর ব্লগেই বলে ৷ ও হলো ডিজিটাল মুজাহিদ ৷ মক্তবের বোগদাদী কায়দায় যের সবর পেশ পড়াকে যেমন “হরকতের” ট্রেনিং মনে করলে আর ঐ কায়দাকে আল-কায়েদা মনে করলে যেমন হবে, ফারাবীকে মুজাহিদ মনে করলেও তাই হবে ৷ হাতির মূশক প্রশবের মতোই ফারাবী কাহিনীর সমাপ্তি ঘটবে ৷ তবে যদি প্রশাসনের কোনো জায়গায় ঘাপটি মেরে থাকা কোনো নাস্তিক এই মোক্ষম সুযোগে ওর চলমান ব্লগিং তৎপরতা ও ফেইসবুকিংকেই বন্ধ করে দিতে চায়, তবে তো তিলকে তাল বানানো বা “জজ মিয়া”র সাজানো নাটকের দৃষ্টান্ত আছেই ৷

আমরা আমাদের এই সরল সহজ মেধাবী বোকা ও বেয়াদব ডিজিটাল মুজাহিদটার মুক্তি চাই ৷ “জজ মিয়া” জাতীয় ষড়যন্ত্রের শিকার না হয়ে যায়, সেই দেয়াই করি ৷ এই জাতীয় আধা পাগল মেধাবীরা জাতিকে অনেক কিছু দিতেও পারে !! জাতি তাদেরকে সঠিক প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করবে কিনা সেটা জাতির চিন্তা ও সিদ্ধান্তের বিষয়!!!

৩রা মার্চ’১৫, ঢাকা।