পলাশী ট্র্যাজেডি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ২৩ ২০১৯, ১৯:৪৮

এহসান বিন মুজাহির

উপমহাদেশের ইতিহাসে বাঁক ঘোরানো একটি নির্মম ট্রাজেডি হচ্ছে পলাশী ট্রাজেডি। পলাশী ট্রাজেডি শুধু পরাজয়ের দিন নয় বরং প্রেরণার উৎসও।

আজ ২৩ জুন পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের এই দিনে মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরদী নদীর তীরে পলাশীর আম্রাকাননে শুরু হয় স্বাধীনতা রক্ষার সশস্ত্র যুদ্ধ । পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমেই বিশ্বাসঘাতকদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। মীরজাফরদের দল বেঁকে বসে,তারা বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে অস্তমিত করে দিতে চাইল । কেড়ে নিতে চাইল নবাব সিরাজুদ্দৌলার শাসনক্ষমতা। মীরজাফরদের সাথে শুরু হয়ে গেল নবাব সিরাজদ্দৌলার সশস্ত্র সংগ্রাম। পলাশীর সেই প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন সিরাজদ্দৌর করুণ পরিণতির কথা ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেল।

পটভূমি: নবাব আলীবর্দী খানের ইন্তেকালের পর ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজুদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে সমাসীন হন। আর এদিকে আলীবর্দী খানের প্রথম কন্যাও ঢাকার প্রাদেশিক শাসনকর্তার বিধবা স্ত্রী ঘসেটি বেগম এবং পুর্নিয়ার শাসনকর্তার পুত্র শওকত নবাব সিরাজকে ক্ষমতার মসনদচ্যুত করার জন্য গভীরভাবে ষড়যন্ত্র ও হীন চক্রান্তের জাল বিস্তার করেন । আলীবর্দী খানের কন্যা ঘসেটি বেগম, দৌহিত্র শওকত জঙ্গ নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে ইংরেজদের সাথে আঁতাত করে;যার কারণে ইংরেজদের প্রতি সোচ্চার হলেন।

১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে ক্লাইভ সহজে কলকাতা পুনরুদ্ধার করেন এতে নবাব সিরাজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন,যার কারণে ক্লাইভ উত্তেজিত হয়ে নবাব সিরাজুদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। উপরিউক্ত কারণসহ আরও অন্যান্য কারণের প্রেক্ষিতে ১৫৭সালের ২২জুন ক্লাইভের আগমনের খবর পেয়ে নবাব সিরাজদ্দৌলা ৫০ সহস্র সৈন্য নিয়ে পলাশী প্রান্তরে মীরজাফরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য উপণিত হন । ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী পলাশীর আম বাগানে ইংরেজ ও নবাব সিরাজুদ্দৌলার সৈন্যবাহিনী একে অপরের মুখোমুখী হন ।

২৩ জুন সকাল ৮টায় পলাশীর আম্রাকাননে বাংলার স্বাধীনতার আলো নির্বাপিত হয়। সে দিন এদেশের স্বাধীনতা তরী কিছু বেঈমান প্রতারক,মুনাফিকদের কারণে অতল সমুদ্রে ডুবে যায়। দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়েও বাংলার জনগণ প্রাণ নিয়ে বাঁচার প্রচেষ্টা করে। তবে এটাও উল্লেখ্য যে,ইতিহাসে কায়েমী স্বার্থবাদগোষ্ঠি দেশ ও জনগণের পরম দুশমন মীরজাফর, বেঈমান গংদেরও বাঁচতে দেয়নি।

ভারতবর্ষে ইংরেজ বেনিয়াদের আগমন: ১৬০০ খৃষ্টাব্দে ইংরেজ বেনিয়ারা রাজকীয় অনুমতি পেয়ে প্রথমে ভারত উপমহাদেশে বিস্তার ঘটায়। ১৬০০সালে ২১৭ ইংরেজ বণিক নিয়ে ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়’ । কোম্পানী বিট্রেনের রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে ১৫ বছর বাণিজ্য করার অনুমতি নিয়ে ভারত উপমহাদেশে আগমন করে। ১৬৩২ খৃষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে বাংলাদেশ থেকে পর্তুগীজদের তাড়িয়ে তদস্থলে ইংরেজ বণিকরা বাংলা ও বিহারে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি পেয়ে যায় । তারা হুগলি, পাটনা, কাসিমবাজার, ঢাকা, মালদাহসহ প্রভৃতী স্থানে কুঠি স্থাপন করে।

১৭১৫ খৃষ্টাব্দে ইংরেজদূত জন্য স্যারম্যন বাণিজ্যিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে মোঘল সম্রাট ফররুখ সিয়ারের দরবারে উপস্থিত হন। তার সাথে বিশিষ্ট ইংরেজ ডাক্তার হ্যামিলটনও ছিলেন। তিনি সম্রাটের কঠিন রোগের চিকিৎসা করেন। এতে সম্রাট খুশি হয়ে কোম্পানীর লোকজনকে বাংলা বিহার, মাদ্রাজ ও বোম্বেতে বিনা ট্যাক্সে-শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন । এই অনুমতি পেয়ে ইংরেজ বেনিয়ারা নিজস্ব মুদ্রা ও কলকাতার চতূর্দিকে জায়গা-জমি ক্রয় করতে থাকে, এভাবে তারা সময়ের ব্যবধানে বিশাল একটি বাহিনী গড়ে তুলে এবং নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

পরাজয়-বিপর্যয়ের কারণ: পলাশীযুদ্ধে বিপর্যয়ের পেছনে বহু কারণরে মধ্যে উল্লেযোগ্য ক’টি হলো: ১. ইংরেজ বেনিয়াদের ভারতবর্ষ দখল।

২.নবাব সিরাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরজাফরের আলীর চরম বিশ্বাসঘাতকতা।

৩. ক্লাইভের নেতৃত্বে গঠিত বণিক ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির’ কুটবুদ্ধি ও গাদ্দারী ব্যক্তিদের স্বার্থপরতা।

৪. হিন্দুদের গভীর চক্রান্ত, যার নেপথ্যে রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহুদিনের পাঁতানে ষড়যন্ত্রের জাল।

৫. মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোন্দল এবং পারস্পরিক অনৈক্য।

৬. মুসলমান শাসকদের মধ্যে (ক্ষমতার লোভ) শাসনক্ষমতা বজায় রাখার প্রতিযোগিতায় তারা ছিলেন বিভোর। এসব কারণেই পলাশীযুদ্ধে বিপর্যয় নেমে আসে।

ফলাফল: 

১.পলাশী যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসকদের পরাজ ঘটে ।

২. গোটা ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতার সূর্য প্রায় দুশ বৎসরের জন্য অস্তমিত হয় ।

৩. পলাশী যুদ্ধেই স্বাধীন বাংলার নবাব সিরাজের পরাজয় হয় এবং ইংরেজ তাঁবেদার বেঈমান-বিশ্বাস ঘাতক মীরজাফররা বাংলার মসনদ দখল করে ।

৪. এযুদ্ধের মধ্যে দিয়েই বাংলায় লূটতরাজ ও ত্রাসের শাসন কায়েম হয়।

৫. নতুন নবাব কোম্পানিক নগদ এককোটি টাকা ও ২৪ পরগনা এলাকা দান কর ।

৬. এযুদ্ধের ফলে মীরজাফর এবং তার পরবর্তী নবাবগণ ইংরেজ শাসকদের হাতের পুতুলে পরিণত হন।

৭. পলাশীযুদ্ধের পরই বাংলায় ব্রিটিশ প্রভুত্বের আত্মপ্রকাশ হয়।

৮. এ যুদ্ধের পর থেকেই শুরু হল ভারতবর্ষে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার ।

৯. তাঁরা প্রায় দু’শ বৎসর দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ হন।

স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে যাবার পরও স্বাধীনতার সূর্য আবার ফিরিয়ে আনার জন্য অজস্র ওলামায়ে কেরাম তাজা-প্রাণ বিলিয়ে দিলেন । ফাঁসির দড়িতে ঝুললেন হাজারো ওলামায়ে কেরাম। কারাবরণ করলেন অগণিত ওলামায়ে কেরাম। কিন্তু আজও আমাদের স্বাধীনতার সূর্যকে অস্তমিত করে দেয়ার জন্য একশ্রেণীর মীরজাফররা সুগভীরভাবে দেশে চক্রান্তের জাল বুনছে।

স্বাধীন দেশে এখন বিপন্ন মানবতা। ধর্মীয় স্বাধীনতা, মানবিক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে চলা-ফেরার স্বাধীনতা আজ হুমকীর সম্মূখিন। ইসলামী তাহযিব-তামাদ্দুন, ঈমান-আকাইদ নস্যাৎ করার লক্ষ্যে সব মীরজাফরা ঐক্যবদ্ধভাবে চক্রান্ত শুরু করেছে। দেশকে অন্যের হাতে তুৃলে দেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। দেশের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে।

নেওয়ার সুগভীর চক্রান্ত চলছে। ইসলামে দুশমন ও মীরজাফরা বিভিন্ন কলা-কৌশলে ইসলামের ওপর আঘাত হানছে।

কাজেই আমাদেরকে সবদিকে সচেতন থেকে দেশ-জাতি ও ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে আর অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। পলাশী দিবসে আমাদের দৃপ্ত অঙ্গিকার হোক স্বাধীনতা-সার্বভৌম রক্ষার।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক