পলাশীর বেঈমান মীর জাফর 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ২৪ ২০২০, ১৩:৪৩

হুসাইন আহমদ মিসবাহ;

২৩ জুন। আজ থেকে ২৬৩ বছর পূর্বে ১৭৫৭ সালের এই দিনে ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাস ঘাতকতায়। সেদিন অবসান ঘটেছিল ভারত উপমহাদেশের প্রায় সাতশত বছরের মুসলিম শাসনের। যা আজও ফিরে আসেনি! তবে যে নরাধমের কারণে এই উপমহাদেশের শেষ শাসক নবাব সিরাজ উদ দৌলার পতন হয়েছিল, ইতিহাসে তার নামটি “বিশ্বাস ঘাতক” হিশেবে স্বীকৃত। মানুষ বিশ্বাস ঘাতক বুঝাতের তার নাম ব্যবহার করে। কেউ বিশ্বাস ঘাতকতা করলে লোকে তাকে বলে “মীর জাফর”। বিশ্বাস ঘাতকতার প্রতিশব্দ” মীর জাফরী”। কাউকে মীর জাফর বললে আর বিশ্বাস ঘাতক বলতে হয়না। মীর জাফর বিশ্বাস ঘাতকতার প্রতীক।

কেন ও কী ভাবে নবাব সিরাজ উদ দৌলা পতন হয়েছিল, ভারত উপমহাদেশ কী ভাবে পরাধীন হয়েছিল, নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কী ভাবে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিল, সেই ইতিহাসের দিকে আজ যাবনা। নবাবের পতনের পর তথা এই ভারত উপমহাদেশ পরাধীন হবার পর, যার বেঈমানীর জন্য সাতশত বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাস কলংকিত হয়েছিল, সেই বিশ্বাস ঘাতকতার প্রতীক মীর জাফর আলী খানের পরিণতি তুলে ধরতেই আজকের প্রয়াস।

নবার এর পতনের কিছুকাল পরেই ইংরেজ সেনাপ্রধান কর্ণেল রবার্ট ক্লাইভ প্রকাশ্য দরবারে মীর জাফরকে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার মসনদে বসান। তার পূর্ণাঙ্গ নাম হয় ‘সুজা-উল-মূলক-হিশাম-উদ-দৌলা মীর মোহাম্মদ জাফর আলি খান মহাব্বত জং। জাফরপুত্র মিরনের প্রবল আগ্রহে তাকে ‘শাহাম্মত জং’ উপাধি প্রদান করা হয়। মসনদে বসানোর পর রবার্ট ক্লাইভ এ দেশের প্রচলিত রীতি অনুসারে মীর জাফরকে আনুষ্ঠানিক নজরানা প্রদান করে তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।

এর আগে মীর জাফর ক্লাইভের সাথে গোপন চুক্তির শর্তানুসারে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার অধিকারে থাকা সরকারী রাজ ভান্ডার ও সেখানে প্রাপ্ত সম্পদের দখল ও ভাগাভাগির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই সরকারী ভান্ডারে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা রৌপ্যমুদ্রায়, ৩২ লাখ টাকা স্বর্ণমুদ্রায়, দুই সিন্দুক ভর্তি সোনার পাতা, চার সিন্দুক ভর্তি হীরা-জহরত ও অপেক্ষাকৃত ছোট দুই সিন্দুক ভর্তি মণিমুক্তা পাওয়া যায়। আরও জানা যায়, নবাবের হেরেমে একটি গোপন ভান্ডারে আরও ৮ কোটি টাকা ছিলো। ক্লাইভকে চালাকির মাধ্যমে বঞ্চিত করে এই ৮ কোটি টাকার সবই মীর জাফর, আমির বেগ, রামচাঁদ ও নবকৃষ্ণ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। এই টাকার ভাগ না পেলেও ক্লাইভের পুষিয়ে গিয়েছিলো। তবে নবাবের প্রকাশ্য ভান্ডারে অর্থ না পাওয়ায় এবং গোপন চুক্তির শর্তানুসারে ক্লাইভকে দেড় কোটি টাকা না দিতে পারায় মীর জাফরকে বর্ধমান ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ইংরেজদের কাছে ইজারা দিতে হয়।

নবাব সিরাজের হারেম রক্ষিত অজস্র অর্থ ও সুন্দরী তরুণীকুল হস্তগত করার পর মীর জাফর সীমাহীন ভোগবিলাসে নিমগ্ন হন। পিতার সাথে তরুণপুত্র মিরনও নিঃসঙ্কোচে ভোগবিলাসের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক অবস্থার নিয়ন্ত্রণ, সশস্ত্র বাহিনীর বেতন পরিশোধ বা কৃষকদের অবস্থার উন্নতির কোনো চিন্তাই তার মনে উদয় হয় নি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়ে যায় যে, বেতনের অভাবে সৈন্যরা তাদের অসহায় ঘোড়াগুলোকে খাবারের জন্যে মাঠে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পিতা-পুত্রের অধীন শ’খানেক প্রিয়পাত্র ও নারী ব্যতীত আর কারও নিয়মিত বেতন পাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো না।

রাজ্যের এই কঠিন অবস্থায় মীর জাফরের রাজত্বের এক বছর ও তিন মাস অতিক্রান্ত না হতেই সৈন্যরা ধৈর্য্যহীন হয়ে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এর ফলে মীর জাফরের বড় ভাই মীর কাজিম ও প্রধান সেনাপতিদের অন্যতম খাজা আবদুল হাদী মীর জাফরের কুটিল চক্রান্তের শিকার হয়ে নির্মমভাবে প্রাণ হারায়। কিন্তু তাতেও পিতা-পুত্রের ভোগসর্বস্ব প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন হয় নি। তারা উভয়েই জনগণের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। ইংরেজরা তাদের নিয়ে মহা মুশকিলে পড়ে যায়। মীর জাফর যে এতো অপদার্থ, সে কথা তারা ভাবতেও পারে নি। ইংরেজরা তাকে অপসারণের চিন্তা করতে লাগলো। কিন্তু তার স্থানে বসাবে কাকে? তার গুণধর পুত্র মিরন তার’চেও অপদার্থ।

এদিকে পূর্ণিয়া অঞ্চল নিয়ে মহাবিপদে পড়লেন পিতা-পুত্র। পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা ও মিরনের সারাজীবনের দুষ্কর্মের সাথী, সৈয়দ খাদিম হাসান খান বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইংরেজ কর্মকর্তার অধীনে বিরাট এক বাহিনী নিয়ে মিরন বের হনখাদিমকে শায়েস্তা করতে। সংবাদ পেয়ে খাদিম তার সৈন্যবাহিনী ও ধন-সম্পদ সব নিয়ে আজিমাবাদ-পাটনার দিকে পালিয়ে যান। মিরন ইংরেজদের সাথে নিয়ে তাকে ধাওয়া করলে ভয় পেয়ে খাদিম পাটনা থেকে বেশ দুরে, গঙ্গার উত্তরে জঙ্গলাকীর্ণ এক জায়গায় গিয়ে আত্মগোপন করেন। মিরনও সেই সময় এক জঙ্গুলে জায়গায় শিবির স্থাপন করেন, উদ্দেশ্য খাদিমকে চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সাধন করার আগে মিরন নিজেই দুনিয়া ছেড়ে দেন।

ইংরেজদের বন্ধু ও সে যুগের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সৈয়দ গোলাম হোসেন খান তবতবায়ী তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সিয়ার-উল-মুতাখখিরীন’-এ উল্লেখ করেছেন যে, ঝড়-বৃষ্টিময় এক মহা দুর্যোগের রাতে তাঁবুতে বিশ্রামরত অবস্থায় হঠাৎ বজ্রাঘাতে মিরন মারা যান। পরবর্তীকালে ফরাসি সেনাপতি মসিয় লাসহ অনেকেই একে একটি বানোয়াট কাহিনী বলেছেন। কারণ স্বরুপ বলা হয়, ইংরেজরা মিরনের ঔদ্ধত্য ও তাদের প্রতি অনমনীয় মনোভাব দেখে এক ঝড়–বৃষ্টির রাতে তাকে হত্যা করে। পরে তাদের বেতনভুক্ত গোলাম হোসেনকে দিয়ে এমন কাহিনী লিখায় মিরনের বজ্রাঘাতে মৃত্যুর কাহিনীটি।

মিরনের মৃত্যুর পরে কয়েক মাসেও মীর জাফর মসনদে থাকতে পারেন নি। ইংরেজরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার জামাতা মীর কাশিমকে সিংহাসনে বসায়। মীর কাশিম শ্বশুরের মতো মেরুদন্ডহীন ছিলেন না। তার স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে ইংরেজদের সাথে তার বিরোধ বাধে ও বেশকিছু যুদ্ধ হয়। তাকে কোণঠাসা করে ইংরেজরা আবার মীর জাফরকে মসনদে বসান। নির্লজ্জ মীর জাফর তা গ্রহণ করে আবারো আরামে দিন কাটাতে থাকেন।

৭৩ বছর বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে মীর জাফরের শরীর ভেঙে যায়। মহারাজ নন্দকুমার নামে এক কুচক্রী ব্রাহ্মণ তখন তার প্রধানমন্ত্রী ছিলো। সে-ই মাত্র ১০ কী ১২ হাজার টাকার বিনিময়ে ফরাসীদের চন্দননগর দূর্গ ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিলো। এই অতি ধূর্ত লোকটির প্রভাব তার উপর এতো বেশি ছিলো যে, মৃত্যুর আগে কঠিন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হলে মীর জাফর একজন সৈয়দ হয়েও হিন্দুদের দেবী কিরীটেশ্বরীর পাদোদক পান করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শুধু একজন মানুষের লোভের কারণে পুরো একটি উপমহাদেশের ইতিহাস কীভাবে পরিবর্তিত হতে পারে তার উদাহরণ বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর। তার জীবন যত সুখেরই হোক না কেন, নিন্দনীয় মৃত্যু ও প্রজন্মান্তরে লব্ধ ঘৃণাই তার কৃতকর্মের যোগ্য পরিণাম।