নিত্যনতুন সমস্যা ও আমাদের ইফতা বিভাগ

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ফেব্রুয়ারি ২২ ২০২১, ১৪:০১

সৈয়দ শামছুল হুদা

ইসলামের ফিকাহ শাস্ত্র অনেক বেশি সমৃদ্ধ। হাজার বছর আগেই ফিকহের ইমামগণ আগত দিনের এমন সব সমস্যার সমাধান লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন যেগুলোর বাস্তব অস্তিত্ব সেই সময়ে ছিলই না। পরবর্তীতে সেগুলো বের হয়েছে। ফলে মুসলিম উম্মাহ উপকৃত হয়েছে। আমরা মাজহাব নিয়ে গর্ব করি। আমাদের দেশের প্রতিটি মাদ্রাসা ইলমে ফিকহের ওপর গর্ব করে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, দেশের বর্তমান ফিকাহ বিভাগগুলো সমসাময়িক বিষয় নিয়ে গবেষণা করা, সমাধান দেওয়ার সক্ষমতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।

খুব আফসোসের সাথে একটি বিষয় লক্ষ্য করছি যে, আমাদের দেশে একদল মানুষ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দিবস পালন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় অনেক এমন বিষয় রয়েছে যেগুলো পালন করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছে, কোন কোন ক্ষেত্রে বাধ্য করছে, সেসব বিষয়ে খুব কঠোর অবস্থানে থাকেন। আবার যখন রাষ্ট্রীয় চাপ সৃষ্টি হয় তখন তা এমনভাবে পালন করেন, যেটা দেখে আলেমদেরই অপর অংশটি হাসে। উপহাস করে। একদল আলেম অপর ব্যক্তিদের নিয়ে নানা টিপ্পনি কাটে। এসব বিষয়ে দেশের ইফতা বিভাগগুলোর যে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল সেটা তারা কতটুকু পালন করতে পারছে সেটা ভাবনার বিষয়।

গতকাল ছিল মাতৃভাষা দিবস। এর আগে জাগো নিউজ নামের একটি নিউজ পোর্টাল এ কিছু উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রকাশ করা হয়। তার মধ্যে কোন এলাকার কোন কোন মাদ্রাসায় শহীদ মিনার নেই, কোন কোন মাদ্রাসায় ভাষা দিবস পালন করা হয় না, এসব তালিকা করে করে মানুষের দৃষ্টি এমনভাবে মাদ্রাসাগুলোর দিকে নিতে চায়, যেন মাদ্রাসাগুলো খুব বড় ধরণের অপরাধ করে ফেলেছে। একদিকে এসব মিডিয়াবাজি, অপরদিকে, আমাদের মধ্যে কিছু কিছু ভাই জাতীয় দিবস পালন করতে গিয়ে নিজেদের মতো করে এমন অনেক তরিকা বের করে নিচ্ছেন যেগুলো অতীতে করা হয়নি। যেমন দলবেধে শহীদ মিনারে গিয়ে বসে কুরআন তেলাওয়াত করা, ফটোসেশন করা, মাদ্রাসা চত্বরে কৃত্রিম শহীদ মিনার বানিয়ে সেখানে গোল করে কুরআন হাতে নিয়ে দুআ করা, বিভিন্ন দিবসের র‌্যালি করতে গিয়ে গান বাজানো, আলোচনা করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলা, আবেগে আপ্লুত হয়ে এমন সব কথা বলা যেটা আলেমদের শানের খেলাফ হয়ে যায়, তাদের এতদিনের নীতি ও আদর্শের বিরোধী হয়ে যায়।

এসব বিষয়ে একদিকে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও মাত্রাতিরিক্ত ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের ফতোয়া বিভাগগুলো কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে দেশের মানুষকে মধ্যম পন্থার সমাধান কী হতে পারে সে সব বিষয়ে গবেষণা করছে বলে জানা যায় না। ফতোয়া বিভাগগুলো থেকে এখনো যেসব বিষয় বের হয, সেগুলোর অধিকাংশই চর্বিত চর্বন ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ যে বিষয়গুলো অনেক আগেই মিমাংসিত, যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে, সেসব পুরোনো বিষয় নিয়েই এখনো ব্যস্ত। এদিকে দেশের মানুষ পড়ে যাচ্ছে নানা সমস্যায়।

দেশের মাদ্রাসাগুলোতে পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত বিষয়ে সম্মিলিত সুন্দর সমাধান প্রয়োজন, ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ সরকারীভাবে ঈদে মীলাদুন্নবী পালনের নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে সে সব বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান কী হবে এসব বিষয় নিয়ে ফতোয়া বিভাগগুলোর কোন তৎপরতা চোখে পড়ে না। ফতোয়া বিভাগ থেকে গবেষণা করে এসব বিষয়ে দেশের আলেম সমাজের মধ্যে একটি ঐক্যমত্য তৈরি করা আলেমদের কাজ। যে কেউ এসব বিষয়ে নিজের মনমতো করে সমাধান দিয়ে দিচ্ছে, ফলে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। করোনা ভাইরাস সময়ে মসজিদে নামায আদায় নিয়ে বড় ধরণের সমস্যা তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষ, সাধারণ আলেম-উলামাগণও কোনটা অনুসরণ করবে, রাষ্ট্রকে করবে নাকি যেন তেন প্রকারে মতপ্রকাশকারী আলেমের মত অনুসরণ করে বিপদে পড়বে, এসব বিষয়ে আমাদের পীড়া অনুভব করছি না।

দেশে মুফতির অভাব নেই। কিন্তু একজন জাতীয় মুফতি, একটি জাতীয় মুফতি বোর্ড গঠন করা সম্ভব হয়নি। ফলে কোন বক্তব্যটা চূড়ান্ত অনুসরণীয় সেটা আমরা বলতে পারি না। দেশে যেহেতু লাখ লাখ মুফতি, ফতোয়াও হাজার হাজার ধরণের হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বিপাকে পড়ছে। আলেম সমাজও বিপাকে পড়ছে। এর সমাধানের আশু কোন লক্ষণ চোখে পড়ছে না।

এছাড়াও দেশের আর্থিক সেক্টরে আলেমদের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। অর্থনৈতিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে সুদ চরমভাবে সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে পৌঁছে গেছে। এগুলো মোকাবেলার কী পদ্ধতি? আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ইসলামীকরণের একটি প্রবণতা দেখা যায়, এটা ভালো, তবে তারা আসলেই কতটুকু ইসলামকে অনুসরণ করতে আগ্রহী, আর কতটুকু নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য হুজুরদের ব্যবহার করছে এসব বিষয়ও সামনে আনা উচিত। জাতির সর্বজন গ্রাহ্যতার দিকে উলামায়ে কেরামের এগিয়ে আসার কোন নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি না।

দেশে যেসব ইসলামী রাজনীতি করছে, তাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা চাপ সৃষ্টি করা হয়। নানা ইস্যুতে তাদেরকে এমনসব কাজ করতে বাধ্য করা হয়, যেগুলো তারা অতীতে কখনো করেননি। রাষ্ট্রের নেপথ্যে থাকা একদল ইসলাম বিদ্বেষী রাষ্ট্রকে দিয়ে আলেম সমাজের ওপর নানা বিষয় চাপিয়ে দেয়। এটা অতীতেও হয়েছে। আইয়ুব খানের মুসলিম পারিবারিক আইন আর আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর ভূমিকা আমরা এখনো স্মরণ করি। ভারতে ৩ তালাক আইন নিয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদি সংগঠন বিজেপির আগ্রহ ইত্যাদি ধর্মের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া সমস্যা। বাংলাদেশেও এমন অনেক বিষয় আছে, যেটাকে ধর্মীয় রূপ দিয়ে রাষ্ট্র জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। যেমন বাল্যবিবাহ। এটি বাংলাদেশে এক সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। একদিকে উপযুক্ত পাত্র পাওয়া সত্ত্বেও ১৫/১৬বছরের মেয়েকে বিবাহ দিতে দিচ্ছে না, অপরদিকে নানা অবৈধ কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে কিশোরী বোনেরা। এসব বিষয়ে দেশের আলেম সমাজের পক্ষ থেকে সম্মিলিত ফতোয়া আসা উচিত যার মাধ্যমে রাষ্ট্রকর্তৃক তৈরিকৃত নানা আইনকে যৌক্তিকভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।

দেশের শ্রদ্ধেয় মুফতিগণের প্রতি আকুল আবেদন, আপনাদের পক্ষ থেকে একটি জাতীয় ইফতা‌বোর্ড তৈরি হওয়া দরকার, যেখানে সব ঘরানার বড় মুফতিগণ থাকবেন, তাদের নিয়ে এসব সমস্যার সুন্দর সমাধান কীভাবে দেওয়া যায় তার জন্য চিন্তা-ভাবনা করা হবে।
একদিকে রাষ্ট্রকেও উপেক্ষা করা যাবে না, আঞ্চলিক সংস্কৃতিকেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না, আবার কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতি ও আদর্শের বাইরেও যাওয়া যাবে না। তার জন্য সুন্দর মধ্যপন্থার সমাধান আসবে আশা করি।