দেশের চিকিৎসা পেশা ও বাস্তবতা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ০২ ২০২০, ১৮:৩৫

ডা.রাসেল চৌধুরী

বছর পাঁচেক আগের কথা। আমি তখন মিটফোর্ড হাসপাতালে পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেইনি হিসেনে শিশু বিভাগে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করছি। এমবিবিএস পাশ করার পর নব্য চিকিৎসকরা সবাই ইন্টার্নশিপের অংশ হিসেবে আমাদের শিশু বিভাগেও আসেন। এরই ধারাবাহিকতায় একবার এলো ডাঃ সুবর্ণা আলো ও তাঁর আরো কয়েকজন ব্যাচমেট।

ইন্টার্নশিপ শেষ করে সুবর্ণা পেডিয়াট্রিক্সে এফসিপিএস পার্ট ওয়ান পাশ করলো এবং শিশু বিভাগেই অবৈতনিক চিকিৎসক হিসেবে ট্রেনিং শুরু করলো। কালের পরিক্রিমায় সে বিএসএমএমইউতে এমডি কোর্সেও চান্স পেয়ে রেসিডেন্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করলো ।

এই চমৎকার যাত্রাপথের মাঝেই, হঠাৎ করেই ৩৬ তম বিসিএসের রেজাল্ট হবার পর দেখি সুবর্ণা পররাষ্ট্র ক্যাডারে ১ম হয়েছে। মেধাবী শিশু চিকিৎসক হবার স্বপ্ন বাদ দিয়ে সে এখন কূটনীতিক হিসেবে কাজ করছে।

আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, সুবর্ণা কূটনীতিবিদের পেশা ভালোবেসে কূটনীতিক হয়নি। চাইলে মেধাবী সুবর্ণা এমবিবিএস পাশ করার পর পোস্ট গ্রাজুয়েশনের এতগুলো ধাপ পেরোতো না। তারমানে তাঁর পেশা পরিবর্তনের মূল নিয়ামক ছিলো, ডাক্তারি পেশাটা তাঁকে আর টানছিলো না।

সুবর্ণা একা নয়, সুবর্ণার মতো এদেশের বহু মেধাবী চিকিৎসককে গত কয়েক বছর ডাক্তারি পেশাটা আর টানছে না।

এবারো ব্যতিক্রম নয়। ৩৮ তম বিসিএসের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এবারো বহু চিকিৎসক ডাক্তারি ছেড়ে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ এমনকি কর ক্যাডারেও চলে গেছেন। তাঁদের চিকিৎসক সহকর্মী ও শিক্ষকরা কিন্তু তাঁদের এই পেশা পরিবর্তনে মন খারাপ করছেন না। বরং অনেক তরুণ ও মধ্যবয়সী চিকিৎসকও এখন মনে করছেন, সময় থাকতে এদেশে ডাক্তারি ছেড়ে অন্য পেশায় না গিয়ে ভুল করেছেন।এই যে যেসব চিকিৎসক পেশা বদলেছেন, এদের প্রায় শতভাগই কিন্তু অন্য পেশা ভালোবেসে নয়, বরং এদেশে ডাক্তারি পেশাটা উপভোগ করতে পারছেন না বলেই ডাক্তারি পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।

কেনো বলছি সুবর্ণারা এদেশেই শুধু ডাক্তারি পেশার চাইতে অন্য পেশাকে বেশি মর্যাদাকর ভাবছেন?

কারণ সুবর্ণার মতো তরুণ চিকিৎসক যারা প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন, তাঁদের কেউই কিন্তু সেসব দেশে গিয়ে ডাক্তারি ছাড়া অন্য পেশায় যাচ্ছেন না। সেসব দেশে ডাক্তারি পেশাটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় বলেই এমনটি হয়েছে। অথচ চিকিৎসকরা অন্য পেশায় যাবেন বলে কিন্তু ৬ বছরের সুদীর্ঘ এমবিবিএস কোর্স পড়েননি। কারণ এদের অনেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং সহ অন্যান্য বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়ে ঠেলে একসময় উচ্চশির চিকিৎসকই হতে চেয়েছিলেন।

কিন্তু যেদেশে একজন চিকিৎসক বিসিএস পাশ করে সরকারি ডাক্তার হিসেবে জয়েন করার পর

(১) প্রত্যন্ত এলাকার হাসপাতালে জয়েন করে একটা চেয়ার টেবিল পর্যন্ত ঠিকমতো পান না,

(২) জয়েন করার ১০ বছরেও পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি করেও প্রমোশন পান না,

(৩) সর্বোচ্চ পদের বেতন গ্রেডও ৩ এর বেশি নয়,

(৪) এমনকি সর্বোচ্চ ৩য় গ্রেডের পদমর্যাদার চিকিৎসক হয়েও খুলনার ডাঃ রকিব খানের মতো প্রকাশ্যে রোগীর লোকের হাতে মার খেয়ে মরে যেতে হয় এবং সেই মৃত্যুর পরও এদেশের এক বিরাট অংশের জনগণ উল্লাস প্রকাশ করে;

(৫) বেসরকারি চাকরি করলে একজন চিকিৎসক যে বেতন ও সম্মান পায় সেটা যদি জনসম্মুখে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়, তবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাবে;

সেদেশে কেনো একজন বোধসম্মত মানুষ পেশা পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েও ডাক্তারি করতে চাইবে ?

বরং সেই মানুষটি (১) মানুষের ব্রেন সার্জারি করার চেয়ে মাথার উপর দিয়ে উড়ে বেড়ানো কূটনীতিক হতে চাইবে, (২) হার্টের চিকিৎসা দেবার চেয়ে পুলিশ হয়ে হৃদয়হীন অপরাধীকে শায়েস্তা করাকে বেশি মর্যাদাবান মনে করবে, (৩) একজন প্রসূতি মায়ের কোলে হাসি ফোটানো গাইনী চিকিৎসক হবার চেয়ে এসি রুমে বসে কাগজ কলম নিয়ে কাজ করা আমলা হতে চাইবে বা (৪) মহামারীর সময় গবেষণা করে রোগ নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে টাকার হিসাব করা কর কমিশনার হতে চাইবে ; সেটাই তো স্বাভাবিক।

খুব খারাপ সময় আসছে এদেশের স্বাস্থ্যখাতে। আমি চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছি, এদেশের সব ডাক্তার যদি একবার এক বিসিএসে ডাক্তারি বাদ দিয়ে তথাকথিত চকচকে ক্যাডারগুলোর বাসিন্দা হতে চায়, তবে ৮০% এর বেশি বিসিএস সাধারণ ক্যাডারের পদগুলো তাঁদের দখলে চলে যাবে। আগেও বলেছি, এবারো বলি; এদেশের ১৮ কোটি মানুষ ও তাঁদের ভাগ্যবিধাতারা যদি দেশি চিকিৎসকদের ও চিকিৎসা পেশাকে এই কোভিড সময়েও সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে না পারেন, তবে এদেশের ১ লাখ চিকিৎসকও ডাক্তারি করা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবেন, বেশ ভালোভাবেই পারবেন। প্রমাণ আজকের বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলেই দেখছেন।

কিন্তু পাঁচটি মৌলিক অধিকারের অন্যতম, মানসম্মত চিকিৎসা সেবা ছাড়া ১৮ কোটি বাংলাদেশি ভালো থাকবেন তো? মেধাবী চিকিৎসকদের অন্য পেশায় চলে যাওয়া মানে কিন্তু মৃত্যুশয্যায় তাঁকে আপনার কাছে না পাওয়া।

চিকিৎসকদের পায়ে ঠেলে দিয়ে অন্তিমশয্যায় সুচিকিৎসা না পাওয়ার এই শোক, এই বেদনা সইতে পারবে তো বাংলাদেশ ?

সমাধান কি একেবারেই নেই ?

অবশ্যই আছে। আজকের জাতীয় সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, সাবেক-বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যাঁরই হোক, অসুখ হলে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। প্রধানমন্ত্রী, আপনি একটা নির্দেশনা দেন। এমপি, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করবেন। জরুরি প্রয়োজন না হলে বিদেশ যাবে না। তাহলে উন্নতি হবে।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই কথাগুলো একটু গভীরভাবে চিন্তা করে ব্যবস্থা নিন। ইটকাঠের উন্নয়নের প্রাচুর্যের দেশে মানুষের ঝকঝকে স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ডাক্তারি পেশাটার ধুলি ময়লা ঝেড়ে একে তরুণ প্রজন্মের জন্য আকর্ষণীয় করুন প্লিজ।

কারণ জিডিপি ৮ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দেশে ডাক্তারদের ডাক্তারি পেশার প্রতি অনীহা সমগ্র উন্নয়ন কর্মকান্ডকেই হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। বিশাল অট্টালিকায় থাকা, হাতে স্মার্টফোন, গাড়ী হাঁকানো উন্নত বাংলাদেশের মানুষ দেশের সবচেয়ে মেধাবী চিকিৎসকদের সুচিকিৎসা পাচ্ছে না, এটা কি খুব সুখকর হবে? ভাবতে কেমন লাগছে ? সেদিন কিন্তু আসছে, খুব বেশি দূরে নয় সেদিন।