দুর্গাপুর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তাকে ঘুষ না দিলে মেলেনা সমিতির নিবন্ধন

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ১৯ ২০২০, ১৯:১৩

দুর্গাপুর (রাজশাহী) প্রতিনিধি : রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলা সমবায় অফিস যেন দুর্নীতির মহা আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এই অফিসের বড় কর্তার চাহিদা অনুযায়ী ঘুষ না দিলে মেলেনা সমিতির নিবন্ধন। আবার চাহিদা মতো ঘুষ দিয়েও অনেকেই সমিতির নিবন্ধন করতে না পেরে দিনের পর দিন ঘুরছেন উপজেলা সমবায় অফিসে। উপজেলা সমবায় অফিসের এই বড় কর্তা হলেন কাওসার আলী। তিনি গত ৩ বছর ধরে দুর্গাপুর উপজেলা সমবায় অধিদপ্তরে কর্মরত আছেন। তার এই ঘুষ নেয়ার ঘটনায় ইতিমধ্যে সমবায় অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ের যুগ্ম নিবন্ধক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী লোকজন।

জানা গেছে, দুর্গাপুর উপজেলা সমবায় অফিসার হিসেবে ২০১৭ সালের ১৮ মার্চ যোগদান করেন কাওসার আলী। এরপর থেকেই তিনি সমিতি নিবন্ধনের নামে প্রকাশ্যেই অফিসে ঘুষ বাণিজ্য শুরু করেন। প্রথম দিকে লোকজন তাকে ঘুষ দিয়েই সমিতির নিবন্ধন করিয়েছেন। পরবর্তিতে ঘুষের চাহিদা বেড়ে গেলে লোকজন তার চাহিদা মতো ঘুষের টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এর ফলে কয়েকজনের সমিতির নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত করে দেয় সমবায় অফিসার কাওসার আলী। আবার কারো কারো সমিতির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিজেই গায়েব করে দিয়ে নথিতে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র নাই মর্মে সমিতি নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত রাখেন। উপায়ন্তর না দেখে ভুক্তভোগী লোকজন গত ৯ অক্টোবর সমবায় অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় যুগ্ম নিবন্ধক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। লিখিত ওই অভিযোগে ১২ জন ভুক্তভোগী স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু অনুসন্ধানে আরো ১০ থেকে ১২ জন ব্যাক্তি পাওয়া গেছে। যারা সমবায় অফিসার কাওসার আলীকে ঘুষ দিয়েও সমিতি নিবন্ধন করাতে পারেননি।

লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা সমবায় অফিসার কাওসার আলী দুর্গাপুরে যোগদান করার পর থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ১৫ দিনের মধ্যে সমবায় সমিতি নিবন্ধন দেয়ার কথা বলে প্রত্যোক সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ের পরেও সমিতির নিবন্ধন না পেয়ে ভুক্তভোগী লোকজন কাওসার আলীর কাছে গিয়ে সমিতি নিবন্ধনের জন্য চাপ প্রয়োগ করলে সমবায় অফিসার পুণরায় ঘুষ দাবি করেন। তার ঘুষ দাবির প্রেক্ষিতে চাহিদা মতোই টাকা দেয়া হয়েছে তাহলে আবার কেন টাকা চাইছেন ভুক্তভোগীরা এমন প্রশ্ন করলে ভুক্তভোগীদের কাওসার আলী বলেন যে টাকা দিয়েছেন তাতে হবেনা। এছাড়া জেলা অফিসের কর্মকর্তাদেরও ম্যানেজ করা লাগে। এই জন্য আরো টাকা দিতে হবে। কাওসার আলীর চাহিদা মতো ঘুষের টাকা দিতে না পারায় ২৫ থেকে ৩০টি সমিতির নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত আছে। এসব সমিতির মধ্যে মাত্র ১২ জন লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, মহিপাড়া আদর্শ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটের সভাপতি নান্নু গাজীর কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। মাড়িয়া ইউনিয়ন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি নাদের আলীর কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। চৌবাড়িয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি সাজ্জাদ আলীর কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। পূর্ব সিংগা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল আজিজের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা। হোজা অনন্তকান্দি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি ফরহাদ হোসাইনের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা। কলনটিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি মফিজ উদ্দিনের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সূর্যভাগ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি মকসেদ আলীর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বরিদ বাঁশাইল মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি রুস্তম আলীর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা। শানপুকুরিয়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবু হানিফের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সাহাবাজপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল হান্নানের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা। পানানগর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি নাদিম মোস্তফার কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা। সূর্যভাগ মৎস্য চাষী সমবায় সমিতির সভাপতি আজের আলীর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বেলঘরিয়া গ্রামের আব্দুল করিমের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সিংগা গ্রামের হৃদয়ের কাছ থেকে সমবায় অফিসার কাওসার আলী নিয়েছেন ২০ হাজার টাকা ও পিয়ন কৌশিক নিয়েছেন ৯ হাজার টাকা। এছাড়া সামাদ নামের এক ব্যাক্তির কাছ থেকে নিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা।

ভুক্তভোগী এসব লোকজন সমবায় অফিসার কাওসার আলীর চাহিদা মতো ঘুষের টাকা পরিশোধ করেও গত ৩ বছরে করাতে পারেননি সমিতির নিবন্ধন। এদের মধ্যে অনেকেই সমিতির নিবন্ধনের জন্য কাওসার আলীকে চাপ দিলে ফাইল থেকে কাগজপত্র গায়েব করে দিয়ে উল্টো ওই ব্যাক্তিকেই ভয়ভীতি দেখানো হয়। দীর্ঘদিন সমবায় অফিসের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে সমিতির নিবন্ধন করাতে না পেরে ভুক্তভোগী লোকজন গত ৯ অক্টোবর সমবায় অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় যুগ্ম নিবন্ধকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। একই সাথে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা সমবায় অফিসার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালককে অভিযোগের অনুলিপি দেয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা সমবায় অফিসার কাওসার আলী ঘুষ নেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, ফাইলে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় সমিতি গুলোর নিবন্ধন দেয়া সম্ভব হয়নি। প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র পেলে নিবন্ধন দেয়া হবে।

সমবায় অধিদপ্তরের যুগ্ম নিবন্ধক আব্দুল মজিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে কমিটি তার কাছে প্রতিবেদন দাখিল করলে অভিযুক্ত উপজেলা সমবায় অফিসার কাওসার আলীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।#