দুটি সংস্কৃতি সন্দেশ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ২২ ২০১৯, ০০:২৩

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

১. সাংস্কৃতিক ইশতেহারের প্রথম নোক্তা

পূর্ব বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির মূলশক্তি হল এর কৃষিভিত্তিক গ্রামীন সভ্যতা। গত শতকের পঞ্চাশ দশক থেকে এই গ্রামীন সভ্যতার বৃহত্তর পটভূমিতে একটি নাগরিক ও আধুনিক সভ্যতাও এখানে জায়মান। পূর্ব বাংলার নাগরিক আধুনিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হল এটির সঙ্গে এর গ্রামীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিবিড় ও অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ ও সম্পর্ক। ফলে পূর্ব বাংলার আধুনিক নাগরিক সংস্কৃতির মধ্যে কথিত “ভদ্দরলোকপনা”র কৃত্রিমতা ও উঁচুনীচুপনা নেই। আশরাফ আতরাফ বিভাজনকে এই মিশ্র সংস্কৃতি ও সভ্যতা কোন জায়গা দেয় না।

কাজেই পূর্ব বাংলার এই সুষমিত মিশ্র আধুনিক-নাগরিক ও গ্রামীন-লোকজ সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে যেমন আরোপিত উচ্চমন্য “সুশীলতা”র কোন জায়গা নেই, তেমনি গ্রাম্য অরুচিকর হীনমন্য “ফইন্নিপনা”রও কোন অবকাশ নেই।

২. কাগমারী সম্মেলনের কারনামা

আমরা জানি পূর্ব বাংলায় ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা পরিণত হয়েছিল মজলুম কৃষক প্রজায়। আর অন্যদিকে সংখ্যালঘু হিন্দুরা হয়েছিল জালিম জমিদার। এই প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় মুসলিম জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়েছিল। এবং পূর্ব বাংলা ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরিস্থিতি অনুকূল নয় বিবেচনায় অনেক জমিদার ও সম্পন্ন শ্রেণির হিন্দু ভারতে চলে যেতে থাকে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে মুসলিম লীগ খুব দ্রুত আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জমিদারী প্রথার অবসান ঘটায়। এর ফলে জমিদার ও মহাজন শ্রেণির বিপুল হিন্দুর পূর্ব বাংলা ত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়া অব্যাহত থাকে। এর মধ্য দিয়ে এদেশের গরীব কৃষকের উপরে চলা দীর্ঘদিনের হিন্দু অর্থনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটে।

কিন্তু এত বড় আর্থ-রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও বাঙালি মুসলমানের উপরে বাঙালি হিন্দুর আধুনিক বাংলা ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব অব্যাহত রয়েই গেল। এর সবচাইতে বড় উদাহরণ হল রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাঙালি মুসলমান যখন একধরণের হীনমন্য, আঞ্চলিক ও সংকীর্ণ মনোভাব দেখাল ১৯৪৮-৫২ সালে। প্রাদেশিক ভাষা হিশেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি নিয়ে কোন বিভেদ তো প্রথম থেকেই ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানের সকল প্রদেশের মধ্যে আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগের মাধ্যম বা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিশাবে উর্দুকে গ্রহণ করতে বাঙালি মুসলমান বেঁকে বসল। পরবর্তীকালে এই অনীহা থেকে জন্ম নিল উর্দুঘৃণা ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বিকশিত মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি বিরাগ। এখানেই নিহিত রয়েছে বাঙালি মুসলমানের মুসলিম জাতীয়তাবাদ পরিত্যাগ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে মুখ ফেরানোর উৎস।

১৯৪৮-৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভেতরে ছিল যার মূল উৎস তা আরো পুষ্টি পেয়েছিল ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। এ প্রসঙ্গে ফাহমিদ-উর-রহমান লিখেছেনঃ “[কাগমারী] সম্মেলন থেকেই মওলানা ভাসানী দেখাতে চেয়েছিলেন বাঙালি সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতিরই অংশ। ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তাই বাঙালি সংস্কৃতি থেকে পৃথক করার কিছু নাই। বাঙালি আর ভারতীয় সংস্কৃতি একই সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ। এ সম্মেলনে ভারত থেকে বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে একটা বিরাট সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল আসে। এদের এনে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল ওদের সাথে আমাদের কোন তফাৎ নেই। ভারত নিজ উদ্যোগে এই বিরাট সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের ব্যয় নির্বাহ করেছিল। এর মতলব ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার।” ফাহমিদ-উর-রহমান আরো লিখেছেনঃ “এ সম্মেলন থেকেই মওলানা ভাসানী প্রকারান্তরে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেন এবং তার ভাষায় ‘পাকিস্তানকে আস-সালামু আলাইকুম বলা ছাড়া আর কোন পথ নেই’।” [ফাহমিদ-উর-রহমান, আ মরি বাংলা ভাষা, বুকমাস্টার, ঢাকা, ২০১৯, পৃষ্ঠা ১৪৭]

সৈয়দ আবুল মকসুদ কাগমারী সম্মেলনে আসা পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্যিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর কথোপকথনের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেঃ “হিন্দুরা ভারতে চলে যাওয়ায় পাকিস্তানের কোন লাভ হয় নাই। ….ব্যানার্জি বাবু আপনি নেহরুকে বলবেন, যদি এখান থেকে যাওয়া হিন্দুরা ফিরে আসতে চায়, আমি সর্বাত্মক সাহায্য করব। ….হাজার মাইল দূরে এক রাষ্ট্র হয় না। আমরা বেরিয়ে আসবই, ১০-১২ বছরের বেশি লাগবে না। পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবেই। নেহরুকে বলবেন, আমাদের দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও শান্তি থাকবেই। অন্নদাশংকর তারাশংকরকে বলেন, ভাসানী সাহেবের পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রসঙ্গ নিয়ে কারও সঙ্গে আপনি আলোচনা করবেন না। তাতে ভাসানীর ‘জান যেতে পারে’।” [সৈয়দ আবুল মকসুদ, কাগমারী সম্মেলন, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭, পৃষ্ঠা ১৬ ও ১২৬]