তেঁতুলিয়ায় কৃষকের ঘরে ৮ গ্র্যাজুয়েট

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ফেব্রুয়ারি ২৭ ২০২০, ১৪:৪৯

এস কে দোয়েল, বিশেষ প্রতিনিধি: হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে এক কৃষক তিন ছেলে ও এক মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন । দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম আর পরিশ্রম। সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত গড়তে বিক্রি করে দিয়েছিলেন প্রায় পাঁচ একর জমি। লক্ষ্য একটাই সন্তানের লেখাপড়া। এতে করে বাবার উৎসাহের

সংস্পর্শে সন্তানরা পূর্বে মেধাবী না থাকলেও ধীরে ধীরে হয়ে উঠে মেধা দক্ষতায় পারদর্শী। বাবা-মায়ের দিনরাত শ্রম দেখে লড়াই করেছে স্বপ্নজয়ের। সকল বাধাকে অতিক্রম করে চার সন্তানই আজ সাফল্যের স্বপ্নচূড়ায়। স্বপ্নপূরণ হয়েছে বাবা-মায়ের, গর্বে ভরেছে বুক। বলছিলাম দেশের সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়ার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের সফল বাবা-মা আমজাদ হোসেন ও আমেনা খাতুনের কথা।

আমজাদ হোসেন পেশায় সামান্য এক কৃষক। স্ত্রী আমেনা খাতুন গৃহিনী। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া সীমাবদ্ধ থাকলেও চার সন্তানকে গড়ে তুলেছেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে। আসামের নওগাঁওয়ে জন্মগ্রহণ করেন আমজাদ হোসেন। বাবা মোহাম্মদ আলী। দেশভাগের পর চলে আসেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। সেখানে আরকে হাইস্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ না করেই বাবার সাথে চলে আসেন সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। এখান থেকে আনুমানিক ২৬ বছর বয়সে অংশ নেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধে অংশগ্রহনপূর্বক প্রশিক্ষণ নেন ভারতে। দীর্ঘ নয় মাস দেশ স্বাধীন হলে কঠিন দারিদ্রতায় চলে সংসার। তবুও হাল ছাড়েননি। তিনি এখন এলাকার একজন সফল চা চাষীও। পাঁচ একর জমিতে লাগিয়েছেন সবুজ চা।

সফল বাবা হিসেবে তাকে দেখে এলাকার মানুষজনও অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। সামান্য কৃষক হয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে চার সন্তানকে করেছেন উচ্চ শিক্ষিত। শুধু উচ্চ শিক্ষিত নয়, উচ্চতর শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনে সবধরণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি। শুধু সরকারি চাকরির জন্য পড়ালেখা করাতে হবে এমনটি ভাবেননি কখনো। চেয়েছিলেন সন্তানরা লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে। নিজের দক্ষতায় কর্মস্থলে সম্মানী পদ অলঙ্কিত করবে। যে শিক্ষায় থাকবে আদর্শ, সততা আর।মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রকৃত মনুষত্ব ও উদার মানবিকতা। যা চেয়েছিলেন, তাই হয়েছে। সন্তানদের কাছেও তিনি একজন সফল বাবা হিসেবে প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছেন। শুধু তাই নয়, তিন ছেলের বউমাও পেয়েছেন উচ্চ শিক্ষিত। এমনকি মেয়ের জামাতাও সম্প্রতি জাপান হতে পিএসডি করে দেশে ফিরেছেন।

সম্প্রতি কৃষকের ঘরে আট গ্রাজুয়েট সংবাদটি জানার পর এ প্রতিবেদক ছুটে যান সফল বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেনের বাসায়। কথা হয় সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করে তোলার বিষয়ে। গল্পে গল্পে জানা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার নানান বিষয়। যুদ্ধে যাওয়ার সময় বয়স ছিল আনুমানিক ২৬ বছর। বিয়ে সংসার। পরেই যুদ্ধে অংশ নিতে চলে যান ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে। প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। নয় মাস যুদ্ধের পর ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। যুদ্ধের তিন বছর পর জন্ম নেন বড় ছেলে মাসুদ আলম (রানা), তারপর আলী আজম রাসেল, মেয়ে রীনা পারভীন ও কনিষ্ঠ মামুন-উর-রশিদ।

এ চার ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা ও বর্তমান কর্মসংস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, বড় ছেলে মাসুদ আলম রানা। থাকে লন্ডনে। একটি সংস্থার ফিনান্স এবং ক্রেডিট কন্ট্রোলার হিসাবে কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রে পার্টনারশীপে গড়ে তুলেছে একাউন্টিং ফার্ম। সে একাউন্টিং ফার্মের প্রধান পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সম্প্রতি লন্ডনের ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস ইউকে (সিআইএমএ) এর অধীনে চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট সম্পন্ন করেছেন। বাংলাদেশের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ইনস্টিটিউট এর অধীনে একটি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টির কোর্সে ভর্তি হন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম কম (ম্যানেজমেন্ট) পাস করেন। চার্টার্ড একাউন্টেন্সি কোর্স শেষ করে দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স সংস্থা লিমিটেডে ডেপুটি ম্যানেজার-অ্যাকাউন্ট-এ দায়িত্ব পালন করেন। ওয়ার্থ গ্রুপে স্যুইচ করে সেখানে ফিনান্স এবং ক্রেডিট কন্ট্রোলার হিসেবে কাজ করেন। ২০০৬ সালে অত্যন্ত দক্ষতা অর্জন করে মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের আওতায় যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন। ২০০৭ সালে চলে যান যুক্তরাজ্যে। সেখানেই তিনি স্ত্রী ও তিন মেয়ে নিয়ে রয়েছেন। তাঁর স্ত্রী হামিদা আক্তার প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।

মেজো ছেলে আলী আজম রাসেল। কাজ করছেন আমেরিকায়। তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে সিএফও হিসাবে কেয়ার ডেন্টিস্ট্রি গ্রুপে কাজ করছেন। আলী আজম রাসেল ২০০৭ সালে ব্যবসায় প্রশাসনের অ্যাংলিয়া রুসকিন বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা শেষ করতে লন্ডনে যান। ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমবিএ সমাপ্ত করেন। পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিভ্রি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর লাভ করেন। সেখানে ভেটেরান্স ফার্স্ট ওসি হিসেবে ফিনান্সিয়াল কন্ট্রোলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়ায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তার স্ত্রী তমা ফারজানাও ক্যালিফোর্নিয়ার অর্গোসি বিশ্ববিদ্যালয় হতে হোটেল ম্যানেজমেন্টের উপর গ্রাজুয়েশন করেছেন।

মেয়ে রিনা পারভীন। ইডেন মহিলা কলেজ স্নাতকোত্তর অর্জন করেছে সেও। তার স্বামী ডা.মো. মোশারফ হোসেন। রাজধানী ঢাকার শেরে বাংলা কৃষি বিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। সম্প্রতি তিনি জাপান থেকে পিএইচডি শেষ করেছেন। খুব শীঘ্রই তিনি অধ্যাপক হবেন।

সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র মামুন-উর-রশিদ মামুন। ২০০৫ সালে তেঁতুলিয়া পাইলট স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ২০০৭ সালে বি এন কলেজ ঢাকা থেকে এইচ এস সি পাশ করেন।তিনি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় এর নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১ম শ্রেণীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। একই বছর ফলাফল প্রকাশের আগেই বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতিতে গবেষণা কর্মকতা হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৭-২০১৮ সালে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

বর্তমানে তিনি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ- ঢাকায় প্রযুক্তি সমন্বয়কারী-পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে কাজ করছেন। চাকুরীর পাশাপাশি ব্যবসা ও সমাজ সেবা কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত। ঢাকার মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে তার “টুংটাং” নামে দুটো কফি শপ আছে। তার স্ত্রী তানিয়া হক তিন্নি ২০১৬ সালে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ হতে এম ফার্ম ডিগ্রি অর্জন করে। বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিলের রেজিস্টার্ড গ্রেড ফার্মাসিস্ট। বর্তমানে সে ফার্মাসিউটিক্যালস ক্যামিক্যালস কোম্পানী ‘ দ্য গ্লোবাল প্রসেসিং সলিউশনস লিমিটেড’-এর জি সিনিয়র এক্সিকিউটিভ-পিএমডি হিসবে দায়িত্ব পালন করছে।

বড় ও মেজো দুই ছেলে লন্ডন ও আমেরিকায় থাকার সুবাদে ঘুরে এসেছেন সফল বাবা-মা আমজাদ হোসেন দম্পতি। এবার তারা স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের স্বপ্ন দেখছেন। ভিসা টিকিটের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে গ্রিন কার্ডের উদ্দেশ্যে শীঘ্রই পারি দিবেন আমেরিকায়।

সফল বাবার জ্যৈষ্ঠ ছেলে মাসুদ আলম বলেন, বাবা-মা আমাদের গর্ব। সকল সাফল্যের প্রেরণা। আজ বাবা-মায়ের জন্য আমরা শিক্ষা-দীক্ষায়, কর্মে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি। আমরা গর্বিত যে, বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান।সন্তানদের বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা আমজাদ হোসেন বলেন, আমাদের আর চাওয়ার কিছু নেই। গর্বে বুক ভরে যায় যে, ছেলে-মেয়েদের উচ্চতর ডিগ্রিতে পড়াতে পেরেছি। তিন ছেলের বউমাও উচ্চতর ডিগ্রীপ্রাপ্ত। সামান্য কৃষকের ঘরে ৮জন গ্রাজুয়েট। এর থেকে আর কি চাওয়ার থাকে। এজন্য তিনি উপর তাআলা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। মা আমেনা খাতুন বলেন, সন্তানদের এ স্থানে নিয়েআসতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত পেরেছি, এটাই ভালো লাগছে।